দুর্গম পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ, গর্জন-শাল বন আর ঝিরি- ঝরনার মাঝখানে বসবাস করা মানুষ আজও আধুনিক চিকিৎসা সেবার নাগাল থেকে বহুদূরে। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালী ও বাঘাইছড়ি উপজেলার দুর্গম পাড়ার মানুষের জীবনে চিকিৎসা পাওয়া মানে এক রকম ভাগ্যের ব্যাপার। এই বাস্তবতার মধ্যেই চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে সেনাবাহিনী। কিন্তু পাড়ারের মানুষদের চিকিৎসাসেবা না নিতে হুমকি ও বাধা দিচ্ছে ইউপিডিএফ।
কাউখালী ও বাঘাইছড়ির উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এখান থেকে প্রায় নয় থেকে দশ কিলোমিটার দূরে; মাঝখানে খাড়া পাহাড়ি রাস্তা, সেতুহীন ঝিরি ও প্রতিকূল ভৌগোলিক বাস্তবতা। ঘাগড়া ইউনিয়নের রিফিউজিপাড়া, লেভারপাড়া, নোয়া আদম, বাদলছড়ি ও মইনে পাড়া ও বাঘাইছড়ির ভুয়াছড়িতে নিয়মিত চিকিৎসা সেবা ক্যাম্প চালু করেছে সেনাবাহিনী।
গত ১০ নভেম্বর থেকে এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে। কিন্তু স্থানীয়দের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা বাধা দিচ্ছে। ভুয়াছড়ি এলাকাটি দুর্গম হওয়ায় এখানে ইউপিডিএফ ঘাঁটি গেড়েছে।
রাঙামাটি রিজিয়নের আওতাধীন রাঙামাটি সদর জোনের উদ্যোগে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ঘাগড়া ইউনিয়নের হারাঙ্গীপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয় বিনামূল্যের চিকিৎসা সেবা ক্যাম্প। ক্যাম্পে নেতৃত্ব দেন রাঙামাটি জোনের মেজর মিনহাজুল আবেদিন।
তার সঙ্গে ছিলেন রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আবিদ দাশ, গাইনি বিশেষজ্ঞ মেজর জান্নাতুন নাঈম (ডিজিও) এবং মেডিকেল অফিসার ক্যাপ্টেন নাহিদা আক্তার। নারী, শিশু, প্রবীণসহ এলাকার অসুস্থ মানুষদের চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় প্রায় দুই লক্ষ টাকার ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) মেডিকেল ক্যাম্প শুরুর আগেই এলাকার মানুষকে ভয়ভীতি দেখায়, যাতে তারা সেনাবাহিনীর পরিচালিত এই মানবিক সেবায় অংশ না নেয়। সংগঠনের সদস্যরা নোয়া আদম, রিফিউজিপাড়া ও মইনে পাড়ায় গিয়ে ঘরে ঘরে হুমকি দেয়, ‘সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে গেলে জরিমানা ও শাস্তি পেতে হবে।
এই হুমকির কারণে লোকজনের উপস্থিতি ছিল সীমিত। একজন স্থানীয় শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা বুঝতে পারছিলাম, লোকজন ভয়ে ঘর থেকে বেরোতে চাচ্ছে না। কেউ কেউ বলছিল, ইউপিডিএফের কর্মীরা নজর রাখছে। কিন্তু দুপুরের পর মানুষ বুঝতে পারে, সেনাবাহিনী কোনো ক্ষতি করতে নয়, সেবা দিতে এসেছে। তখন ভিড় বাড়তে থাকে।
রাঙামাটি রিজিয়নের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের কল্যাণে নিবেদিত। শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তার প্রতি সেনাবাহিনীর অঙ্গীকার অটুট। কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর ভয়ভীতি বা বিভ্রান্তিমূলক কর্মকাণ্ড জনগণের সেবায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
মেজর মিনহাজুল আবেদিন বলেন, দুর্গম পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে চিকিৎসা, শিক্ষা ও মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে। আজকের মেডিকেল ক্যাম্পও সেই ধারাবাহিকতার অংশ। আমরা চাই, মানুষ যেন বুঝতে পারে সেনাবাহিনী জনগণেরই অংশ তাদের শত্রু নয়, বন্ধু।
তিনি আরও বলেন, এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া কঠিন। তাই সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে এ ধরনের মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজনের পরিকল্পনা করছে।”
এক নারী রোগী লালমনি চাকমা বলেন, মাসের পর মাস আমার শিশুর জ্বর ছিল। আজ সেনাবাহিনীর ডাক্তাররা ওষুধ দিয়েছে, পরামর্শ দিয়েছে। আমরা কৃতজ্ঞ।
চিকিৎসা সেবা প্রদানের সময় উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মন্টু রঞ্জন চাকমা, শিক্ষক প্রদীপ চাকমা, ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তারা সেনাবাহিনীর মানবিক ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং এ ধরনের উদ্যোগ নিয়মিত করার আহ্বান জানান।