জামায়াতে ইসলামীর প্রয়াত নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির রায় ঘোষণার পর বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন দেশবাসী। সারা দেশের মতো কক্সবাজারের ঈদগাঁয়েও ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। দলমত নির্বিশেষে রাজপথে নেমে আসা মানুষের বিরুদ্ধে দানবরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন ঈদগাঁও থানার কয়েক পুলিশ সদস্য। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা সদর থানার এসআই বাবুল আজাদ। তার গুলিতে নিহত হন আবদুর রশিদ ও নুরুল হক নামে দুই জামায়াত কর্মী। গুলিতে আহত হন আরো অন্তত ৩০ জন।
এর আগে একই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত-বিএনপির আরেকটি মিছিলে গুলি চালিয়ে তোফায়েল ইসলাম নামে আরেক ব্যক্তিকে হত্যা করে পুলিশ। এই বাহিনীর পক্ষে ওই হামলারও নেতৃত্ব দেন এসআই বাবুল আজাদ। এককথায় আওয়ামী আমলের টানা ১৬ বছর যে থানায়ই গেছেন সেখানেই বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের দমনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি।
এসব কারণে দ্রুত পদোন্নতিও পান। জুলাই বিপ্লবে হাসিনার পতনের পর রাতারাতি ভোল পাল্টে বিএনপি-জামায়াতপন্থি পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সবচেয়ে প্রভাবশালী ওসি হিসেবে পরিচিত।
সম্প্রতি তিনি আবার আলোচনায় এসেছেন ফেসবুকে পুলিশের সমালোচনা করে পোস্ট দেওয়ার অপরাধে এক নিরীহ ব্যক্তিকে ধরে এনে ছাত্রলীগ ট্যাগ দিয়ে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে। এর আগে জুলাই বিপ্লবের পরও বিএনপিপন্থি এক ব্যবসায়ী নেতা মামুন আলীর কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা না পেয়ে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠান। এরপর তার ওয়্যারহাউস থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার পাথর লুটের অভিযোগ রয়েছে বাবুল আজাদের বিরুদ্ধে।
এছাড়া সিএমপি গঠিত সিটিজেন ফোরাম (সাবেক কমিউনিটি পুলিশিং) সদস্য ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলমকে মিথ্যা অভিযোগে মামলা দিয়ে আড়াই লাখ টাকার চাঁদা দাবিসহ দুই সাংবাদিককে থানায় আটকে পেটানোর মতো নানা অভিযোগ রয়েছে ওসি বাবুল আজাদের বিরুদ্ধে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার সদর থানায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্টেশন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী ও সাঈদী ভক্তরা। এসআই বাবুল আজাদের নেতৃত্বে কতিপয় পুলিশ সদস্য সেই বিক্ষোভে হামলা চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে জামায়াত কর্মী আবদুর রশিদ ও নুরুল হককে।
এর আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি একই এলাকায় নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা মিছিল বের করলে তাতেও হামলা চালায় বাবুল আজাদ। পুলিশের ছোড়া গুলিতে নিহত হন তোফায়েল নামে আরো এক যুবক।
এ ঘটনায় নিহত জামায়াত কর্মী আবদুর রশিদের বাবা ইলিয়াছ মিয়া মিস্তিরি বাদী হয়ে কক্সবাজার আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন। এতে এসআই বাবুল আজাদসহ ছাত্রলীগ, যুবলীগের হামলাকারীদের আসামি করা হয়।
জানা যায়, ওই সময় বাবুল আজাদের ভূমিকার জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তার সেই দানবীয় ভূমিকার প্রশংসা করে পত্রিকায় বিবৃতি পর্যন্ত দেয়। জামায়াত-বিএনপি নেতাকর্মীদের হত্যার পুরস্কার হিসেবে পদোন্নতিও পান তিনি।
সে সময় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের আজাদ বলেছিলেন, এসআই বাবুল আজাদ ২৮ ফেব্রুয়ারি ঈদগাঁ উপজেলায় যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ভূমিকা রাখেন তা কক্সবাজারবাসী আজীবন মনে রাখবে। তিনি বাধা না দিলে নাশকতাকারীরা পুরো কক্সবাজার জ্বালিয়ে দিত।
বাবুল আজাদের নেতৃত্বে চালানো হামলায় নিহত জামায়াত কর্মী আবদুর রশিদের ছেলে লোকমান হোসেন আমার দেশকে জানান, সাঈদীর রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সর্বস্তরের জনতা মিছিল বের করলে বাবুল আজাদ গুলি চালিয়ে আমার বাবাকে হত্যা করে। তার কারণে আজ আমরা এতিম। আমরা তার বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে হত্যা মামলা করেছি। আওয়ামী লীগের নির্দেশে সে আমার বাবাকে হত্যা করে পরে পদোন্নতি পায়। আমরা তাকে পুলিশ থেকে বরখাস্তসহ তার বিচার চাই।
ঈদগাঁ উপজেলা জামায়াতের আমির ছলিমুল্লাহ জিহাদী জানান, আমাদের মোট তিনজন কর্মী রায়কে ঘিরে আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে আবদুর রশিদ ও নুরুল হক দুজনেই জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ছিলেন। আওয়ামী লীগ আমলে এসব মামলার কোনো কার্যক্রম ছিল না। এখনো মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই বলে ক্ষোভ জানান তিনি।
এছাড়া ২০১২ সালে কক্সবাজারের স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক ও বর্তমানে সাংবাদিক ইউনিয়ন কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা সরোয়ারকে অফিস থেকে তুলে নিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায় এসআই বাবুল আজাদ। মোস্তফা সরোয়ারের অভিযোগ, মিয়ানমারে ৫০টি মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ও সীমান্তে চোরাকারবারিদের নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের জেরে ক্ষিপ্ত হন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। তাদের কথা মতো এসআই বাবুল আজাদ তাকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালায়।
গত ২০ আগস্ট রাতে ডবলমুরিং থানায় পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে যায়যায়দিন-এর সাংবাদিক সাহিদুল ইসলাম মাসুমকে গলা ধরে লকাপে ঘণ্টাখানেক আটক করে রাখে। পরে সাংবাদিক নেতারা গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন।
পরে বাঁশখালী থানায় থাকাকালীন এক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৫০ লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে বাবুলের বিরুদ্ধে। টাকা দিয়ে প্রাণে বাঁচলেও হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে পারেননি তিনি। অবশেষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন ওই ব্যবসায়ী।
ইউরোপে বসবাস করা ওই ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আমাকে অস্ত্র ও ডাকাতি মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছেন তিনি। আমার যেন জামিন না হয় সেজন্য তিনি কঠিনভাবে চার্জশিট দিয়েছেন। সেখানে লেখা ছিল, আমার জামিন হলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা নিরাপদে থাকতে পারবে না।
এদিকে জুলাই বিপ্লবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাবুল আজাদ নিজেকে রাতারাতি বিএনপিপন্থি পুলিশ অফিসার হিসেবে জাহির করতে শুরু করেন।