দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাঁচ আসন
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাঁচটি আসনে জমে উঠেছে প্রচার কার্যক্রম। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা। চষে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনি এলাকার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। করছেন উঠানবৈঠক, পথসভা, মতবিনিময়সহ গণসংযোগের নানা কর্মসূচি। ইতোমধ্যে প্রায় সব দল প্রার্থী ঘোষণা করায় ভোটাররা সুযোগ পেয়েছেন তাদের ভবিষ্যৎ জনপ্রতিনিধির বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের।
ভোটের মাঠে সবচেয়ে বেশি সরব বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা। ব্যাপক শোডাউনসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পেয়েছেন পরিচিতি। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব প্রভাব বলয়। তবে অন্তর্কোন্দল, প্রার্থী বাতিল দাবিতে অব্যাহত আন্দোলন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণার কারণে ভোটের মাঠে বেকায়দায় পড়ছেন ধানের শীষের কান্ডারিরা। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভোটারদের মধ্যেও।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া)
আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনটি সংসদে নির্বাচনে জয়লাভ করেন ধানের শীষের কান্ডারিরা। তবে এবার বিএনপি প্রার্থী কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন বলে মনে করছেন ভোটাররা। কারণ, বিতর্কিত এস আলমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ থাকায় বিএনপি প্রার্থী দলটির দক্ষিণ জেলা শাখার সদস্য এনামুল হক এনাম কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন। এর চেয়েও বেশি ভোগাচ্ছে দলটির নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দোল। এটি এখন তার সামনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা।
এনামুল বরাবরই নেতাকর্মীদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকায় তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পরপরই গণহত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনার ক্যাশিয়ার লুটেরা এস আলমের গ্যারেজ থেকে ১৬টি বিলাসবহুল গাড়ি নিরাপদে সরিয়ে নিতে সহযোগিতা করার দায় আসে তার ওপর। এ অভিযোগে দক্ষিণ জেলার সদস্যসচিবের পদটিও চলে যায় তার। নির্বাচনের মাঠে বিষয়টি তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
জামায়াত এখানে ক্লিন ইমেজের নেতা ডা. ফরিদুল আলমকে প্রার্থী করায় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে গোটা পটিয়ায়। তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের তিনবারের কার্যনির্বাহী সদস্য এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদ নেতাও ছিলেন। মনোনয়ন পেয়ে তিনি এ পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টির বেশি বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্প করেছেন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। জুমার নামাজ, সামাজিক অনুষ্ঠান, উঠানবৈঠক, খেলাধুলা কিছুই বাদ যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন এই চিকিৎসক। তার দলের লোকজনও দাঁড়িপাল্লার পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা ও কর্ণফুলী)
কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনটি ১৯৯৬ সাল থেকে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। সবশেষ তিনটি নির্বাচনে বিএনপি থেকে সরোয়ার জামাল নিজাম বিজয়ী হন। এবারও তাকে দলের টিকিট দিয়েছে বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী আমলের অধিকাংশ সময়ই তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করায় প্রতিদ্বন্দ্বী নেতারা তাকে সুবিধাবাদী আখ্যা দিয়েছেন। বিষয়টি সামনে এনে দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব লায়ন হেলালের অনুসারীরা প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনও করছেন। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
জামায়াত এ আসনে অধ্যক্ষ মাহমুদুল হাসান চৌধুরীকে প্রার্থী ঘোষণার পরই ভোটারদের জাগাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। তার সঙ্গে নেতাকর্মীরাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে কাজ করছেন। ইতোমধ্যে তিনি শক্ত অবস্থানও তৈরি করেছেন বলে বহু ভোটারের মুখে শোনা যাচ্ছে।
ভোটাররা বলছেন, বিএনপি নেতা সরোয়ার হেভিওয়েট প্রার্থী হলেও সুবিধাবাদী হওয়ার অভিযোগ থাকায় জামায়াতের মাহমুদুলের থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। এছাড়া আট দল থেকে জামায়াত ছাড়া অন্য কেউ প্রার্থী না হলে মাহমুদুলও চমক দেখাতে পারেন।
শেষ মুহূর্তে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সদস্য জুবাইরুল আলমকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। জুলাই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকার জন্য নগরজুড়ে তার পরিচিতি আছে। মনোনয়ন দেরিতে পেলেও বেশ আগে থেকেই মাঠে আছেন তিনি।
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া)
দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনটি মূলত বিএনপির ঘাঁটি। ধানের শীষ নিয়ে ২০০৮ পর্যন্ত জোটের প্রার্থী হিসেবে জয় পান এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলী আহমদ। তার প্রভাবের কারণে ধীরে গড়ে ওঠে এলডিপির পৃথক বলয়, কর্নেল ওলির ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি তার জয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। এবার দলটি বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করতে চায়। সে হিসেবে বিএনপিও জোট সঙ্গীকে আসনটি ছেড়ে দেবে বলেই নেতাকর্মীদের ধারণা।
আসনটি এলডিপি পেলেও এবার নির্বাচন করবেন না কর্নেল অলি। তার পরিবর্তে ছেলে ওমর ফারুক সানিকে ভোটের মাঠে নামাতে চান তিনি। কিন্তু ভোটাররা অলির আসনে তার ছেলেকে বসাবেন কিনা তা নিয়ে নানা মত আছে। এছাড়া বিএনপির অন্তত ছয় নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী। তারা এখনো আলাদা করেই প্রচার চালাচ্ছেন। আসনটিতে এখনো বিএনপি প্রার্থী না দেওয়ায় চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন বিএনপি ও এলডিপির নেতারা।
জামায়াত এখানে ডা. শাহাদাৎ হোসেনকে প্রার্থী করেছে। আগেই তার নাম ঘোষণা করায় এক বছর ধরে চক্ষু চিকিৎসার নানা ক্যাম্পসহ ব্যতিক্রমী সব কর্মসূচির মাধ্যমে প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই নির্বাচনি মাঠে নামায় অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছেন জামায়াত প্রার্থী। এর বাইরে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের (মোমবাতি) প্রার্থী তিনবারের সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সোলাইমান ফারুকীও প্রচার চালাচ্ছেন।
এনসিপির হয়ে নির্বাচনে লড়বেন দলটির দক্ষিণ জেলার প্রধান সমন্বয়কারী মুহাম্মদ হাসান আলী। তিনিও নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া)
আসনটি জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ২০১৩-২৪ সাল পর্যন্ত সবকটি আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে তোলেন দলটির নেতাকর্মীরা। বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলও সাতকানিয়া-লোহাগাড়াকে জামায়াতের দুর্গ আখ্যা দিতে কার্পণ্য করে না। ২০০৮ সালে জামায়াত নেতা আ ন ম শামসুল ইসলাম এমপি নির্বাচিত হন। যদিও এবার আরেক পুরোনো প্রার্থী জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য শাহজাহান চৌধুরীকে মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। ঘাঁটি পুনরুদ্ধারে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা রাত-দিন পরিশ্রম করছেন। যে কোনো মূল্যে আসনটি ধরে রাখতে চায় জামায়াত।
বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছে দলটির দক্ষিণ জেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নাজমুল মোস্তফা আমীনকে। তার মনোনয়ন ঘিরে এলাকায় উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। এমনিতেই সাতকানিয়া-লোহাগাড়া বিএনপিতে নানা গ্রুপিং আছে। এ কারণে তার প্রচার কার্যক্রম এলাকায় খুব একটা সাড়া জাগাতে পারেনি। দলটির নেতাকর্মীরাও ঐক্যবদ্ধভাবে নামছে না। শুধু তাই নয়, তার মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে একাংশের নেতাকর্মীরা আন্দোলনও করছেন। বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমানের অনুসারীরা প্রায় প্রতিদিনই নিয়ম করে মহাসড়ক সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন না পেলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন বলেও গুঞ্জন আছে। আর এমনটা হলে বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়বে বিএনপি।
এনসিপির প্রার্থী হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মাবুদ সৈয়দ। তিনি দলটির কোনো কমিটিতে নেই। তবে ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন তিনি। এর আগে ১৯৮৩ সালে বাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী)
আসনটি ঐতিহাসিকভাবেই বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার পর থেকে এখানে দলটি পাঁচবার সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে। কেবল প্রয়াত বিএনপি নেতা জাফরুল ইসলাম চৌধুরীই বিজয়ী হয়েছিলেন চারবার। তবে দলটির এই ঘাঁটিতে এবার নতুন চমক দেখাতে চায় জামায়াত। দলটি এবার প্রার্থী ঘোষণা করে এরই মধ্যে নির্বাচনি সব প্রস্তুতি সেরেছে। বিএনপির অন্তর্কোন্দল আর সংগঠনের পাশাপাশি ব্যক্তি বিশেষের আলাদা জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বাঁশখালীতে ভোটের ফসল ঘরে তুলতে চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াত।
ভোটাররা বলছেন, এবার বাঁশখালীতে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী মাওলানা জহিরুল ইসলামের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ, জোটের কারণে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জামায়াত আলাদা প্রার্থী না দিলেও ২০০১ সালের পর থেকেই এই এলাকায় শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে দলটি। ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হন দলটির প্রার্থীরা। ওই পরিষদের চেয়ারম্যানই এবার দাঁড়িপাল্লার কান্ডারি।
বিপরীতে এই আসনে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য প্রয়াত জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পাকে প্রার্থী করা হয়েছে। যদিও এখানে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন লিয়াকত আলী। এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করে পুরো বাঁশখালী জুড়ে জনপ্রিয়তা পান তিনি। পাপ্পাকে প্রার্থী ঘোষণা করায় নির্বাচনের মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন লিয়াকত। এতে বিএনপির প্রার্থীর জয় আরো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব মীর আরশাদুল হককে ভোটের মাঠে প্রচার চালাতে দেখা যাচ্ছে। তবে খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেননি।