দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এর মধ্যে অন্তত ৭৫ শতাংশই আবার হয় বহির্নোঙরে বা গভীর সাগরে, বাকি মাত্র ২৫ শতাংশ হয় কনটেইনারে। মাদার ভেসেল থেকে ছোট ছোট লাইটার জাহাজে পণ্য খালাস করে নিয়ে যাওয়া হয় দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে। এ পুরো কাজটি করেন শিপ হ্যান্ডলিং ও বার্থ অপারেটররা।
বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে ২৭টি প্রতিষ্ঠান বিশাল এ কর্মযজ্ঞটি করে থাকে। তবে সংগঠনের বাইরে আরো চারটি করপোরেট গ্রুপ নিজেরাই নিজেদের কার্গো লোড-আনলোড করে থাকে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ওই ২৭টি প্রতিষ্ঠান। গত ১৭ বছর ধরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিনা নির্বাচনে একটি সিন্ডিকেট সংগঠনটি দখল করে রাখে। জুলাই বিপ্লবে ছাত্র আন্দোলন দমাতে বিনিয়োগও করে সংগঠনটির নেতারা। সরকার পতনের পর পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মামলার আসামি হয়ে গা-ঢাকা দেন সংগঠনটির অধিকাংশ নেতা। তবে দেড় বছর পর নির্বাচনের নামে নিজেদের সহযোগীদের দিয়ে নতুন করে কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংগঠনটি দখলে নিতে তারা অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
বন্দর সূত্র জানায়, শিপ হ্যান্ডলিং ও বার্থ অপারেটররাই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালনা করে। কোনো কারণে বহির্নোঙরে পণ্য খালাস বন্ধ হলে থমকে দাঁড়াবে জাতীয় অর্থনীতির চাকা। আর এ সুযোগকে কাজে লাগাতেই যে কোনো মূল্যে সংগঠনটির নেতৃত্ব দখলে রাখতে চায় পতিত সরকারের সহযোগীরা। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয় শুরুতেই।
নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু থেকে কমিশন গঠন, মনোনয়ন জমা, আচরণবিধি লঙ্ঘন করে অস্ত্রের মহড়া, গঠনতন্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ভুয়া ভোটার তৈরিসহ প্রতিদ্বন্দ্বী একাধিক প্রার্থীর মনোনয়নপত্রের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। এ নিয়ে ডবলমুরিং থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের পুরো কার্যক্রমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানায়, আগামী ২০ ডিসেম্বর বিএসবিওএর পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন। কমডোর (অব.) আরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি নির্বাচন কমিশন নির্বাচনটি পরিচালনা করছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পুরোটা সময় অ্যাসোসিয়েশনটি দখল করে রাখে একেএম শামসুজ্জামান রাসেলের নেতৃত্বে ছয়-সাতজনের একটি দল। রাসেল ছিলেন এর স্বঘোষিত চেয়ারম্যান। তবে পেছন থেকে এসবের কলকাঠি নেড়েছিলেন পতিত এমপি এম এ লতিফ।
জুলাই বিপ্লবে গণহত্যায় হাসিনার সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন মামলায় আসামি হন রাসেলসহ কমিটির অনেকে। এক বছরের বেশি সময় ঘাপটি মেরে থেকে ফের সক্রিয় হয়েছেন তারা। অ্যাসোসিয়েশনের কর্তৃত্ব দখলে নিতে নিজেদের পছন্দমতো তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন ও তিন সদস্যের আপিল বোর্ড গঠন করা হয়। দুটি বোর্ডের ছয় সদস্যের একজনেরও অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে দূরতমও কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সদস্যরা জানান, নির্বাচন কমিশনের কোনো সদস্য তফসিলের সময় অনুযায়ী অ্যাসোসিয়েশনে উপস্থিত হননি। কেবল একজন কর্মচারীকে দিয়ে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হয়। জমাদানের শেষ দিন পর্যন্ত মোট সাতটি মনোনয়নপত্র জমা পড়ে এবং ওই কর্মচারী সাতটি মনোনয়নপত্র জমা পড়ার তালিকা তৈরি করে তা ক্লোজ লিখে স্বাক্ষর করে দেন। অথচ পরে জানানো হয়, মোট ১৭ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বাকি ১০ জন কোন প্রক্রিয়ায় মনোনয়ন জমা দিলেন, তার সঠিক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।
এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি পরপর গত দুই মেয়াদে নির্বাহী পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরপর দুবার কোনো প্রতিষ্ঠান নির্বাহী পরিষদে থাকলে তৃতীয়বার ওই প্রতিষ্ঠানের কেউ প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না। কিন্তু আগামী নির্বাচনে ওইসব প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ব্যক্তিকে দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পাঁয়তারা করছে। এছাড়া চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সরওয়ার হোসেন সাগরের মনোনয়নপত্রের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচনে শুধু মালিকপক্ষই প্রার্থী হতে পারেন। কিন্তু সারওয়ার হোসেন একটি কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার মাত্র।
তবে সারওয়ার হোসেনের দাবি, প্রতিষ্ঠানের মালিকরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। শেয়ারহোল্ডার প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরই একজন। এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী মালিকপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করতে বোর্ড অব ডাইরেক্টরর্সের রেজুলেশন নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও আপিল বোর্ডে সব ডকুমেন্ট জমা দেওয়া হয়েছে। সবাই তার প্রার্থিতা বৈধ বলে ঘোষণা করেছে। এরপরও নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়ে একটি পক্ষ অযাচিত বিষয়গুলো সামনে আনছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক পক্ষের চেয়ারম্যান প্রার্থী এএইচএম মঞ্জুর আলম জানান, বহির্নোঙর যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, দেশের জাতীয় অর্থনীতিও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ১৯৯৬ সালে বহির্নোঙরকে অচল করে সরকারকে বিপদে ফেলেছিল এই সিন্ডিকেট। দেশের টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বন্দরের মতো স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে রাখতে জুলাই বিপ্লবে গণহত্যার আসামিরা সাজানো নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাঁয়তারা করছে। অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সদস্যরা এ নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের পাশাপাশি নতুন প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে সরকারের তত্ত্বাবধানে সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসবিওর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কমডোর (অব.) সৈয়দ আরিফুল ইসলাম জানান, নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করা হচ্ছে। এখানে দুটি প্যানেল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তবে একটি পক্ষ অন্য পক্ষকে দমাতে তারা যেন মনোনয়নপত্রই জমা না দিতে পারে, সে জন্য নানা ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা করেছিল। নির্বাচন কমিশন শক্ত থাকায় সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এরপর তারা আপিল বিভাগে অভিযোগ করেছিল। কিন্তু অভিযোগের কোনো যৌক্তিকতা না থাকায় আপিল বোর্ড তা আমলে নেয়নি। এখন নানা ধরনের অভিযোগ করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করছে।