আজ পার্বত্য চুক্তির বর্ষপূর্তি
আজ পার্বত্য চুক্তির ২৮ বছর পূর্তি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন হাসিনা সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র গেরিলা নেতা সন্তু লারমার মধ্যে এ চুক্তি সম্পাদন হয়।
এই চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে পাহাড়ি অঞ্চলে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্য ছিল সংশ্লিষ্টদের। তবে ২৮ বছরেও পার্বত্য চুক্তি পাহাড়ে শান্তি ফেরাতে পারেনি। উল্টো বেড়েছে খুন অপহরণ ও চাঁদাবাজি।
অন্তত ছয়টি পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপ বাঙালি-পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনকে অস্থির করে রেখেছে। চলছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন করার নানা ষড়যন্ত্র। আর এতে ভারত ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
পার্বত্য চুক্তির পর চুক্তির শর্ত মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পর্যায়ক্রমে ২৫০-এর অধিক সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে পাহাড়ে নতুন করে আরো ছয়টি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে উঠেছে। তারা বেপরোয়া চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুনে মেতে উঠেছে। এছাড়া আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত হয় ছয় পাহাড়ি গ্রুপ।
তিন পার্বত্য জেলায় ১৩ হাজার বর্গমাইল সীমান্ত অরক্ষিত থাকায় সন্ত্রাসীরা ভারতের ওপারে বসে অস্ত্র পাচার ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ অবস্থায় পাহাড়ে নতুন করে সেনাক্যাম্প স্থাপন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান ও ভারত সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে পার্বত্য চুক্তিকে কেন্দ্র করে এখনো মুখোমুখি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী জেএসএস, সরকার ও স্থানীয় বাঙালিরা। দীর্ঘ সময়েও অবসান হয়নি চুক্তি নিয়ে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ।
সরকার চুক্তির ৭৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে দাবি করলেও এ বিষয়ে জেএসএস-এর অসন্তোষ আছে। তাদের দাবিÑ চুক্তির মৌলিক বিষয় সরকার বাস্তবায়ন করেনি। অপরদিকে স্থানীয় বাঙালি নেতৃবৃন্দের অভিযোগ, পার্বত্য চুক্তি একপেশে ও দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। চুক্তিতে পাহাড়ের অর্ধেক জনগোষ্ঠী বাঙালিদের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে।
পার্বত্য চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ’-এর কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান কাজি মুজিবর রহমান আমার দেশকে বলেন, মূলত ভারতের ইন্ধনে বৈষম্যমূলক পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। পাহাড়ে বসবাসরত বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী বাঙালি ও পাহাড়িদের মতামত না নিয়ে এ চুক্তি সম্পাদন করায় পাহাড়ে শান্তি আসেনি। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এ চুক্তি বাতিল না হলে পাহাড়ে শান্তি স্থাপন সম্ভব নয় বলে মত দেন কাজি মুজিবর।
অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অভিযোগ, চুক্তির মূল বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে শান্তি ফিরছে না। তাদের দাবি চুক্তি মোতাবেক পাহাড় থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়নি। পার্বত্য এলাকাকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে বিশেষ প্রশাসনিক স্বীকৃতি দেওয়া, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে বিশেষ ক্ষমতা হস্তান্তরে অগ্রগতি নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি এবং সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর পাঁচটি রাজনৈতিক সরকার এবং দুইটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো সরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, বাঙালি বসতি স্থাপনকারী ও স্থানীয় পাহাড়িদের মধ্যকার অবিশ্বাস এবং ভূমি নিয়ে বিরোধ শান্তি প্রক্রিয়ার প্রধান বাধা। এছাড়া পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং নতুন করে সৃষ্ট সশস্ত্র গ্রুপগুলোর তৎপরতাও শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করেছে। পূর্ণাঙ্গ শান্তি বাস্তবায়নের জন্য ভূমি কমিশনকে দ্রুত কার্যকর করা, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া এবং সব পক্ষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
রাঙামাটির বাসিন্দা প্রফেসর হারুনুর রশীদ বলেন, সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি ২৮ বছর অতিবাহিত করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতিতে খুব বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেনি। সরকার কিছু বিষয় হস্তান্তর করলেও নানা আইনী জটিলতায় অনেক বিষয় হস্তান্তরে আগ্রহী হয়নি। তাছাড়া পাহাড়ে সশস্ত্র নানা দল এবং উপদলের কোন্দলে এখানকার মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এক কথায় বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির এ পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। চুক্তির ফলে প্রাথমিকভাবে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। তখন সরকার তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ওই সময় পার্বত্য চুক্তিকে কালো চুক্তি আখ্যায়িত করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় ঐক্যজোট। পরবর্তীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও পার্বত্য চুক্তি বাতিল বা সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।