গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ২৪ নম্বর সোনাসুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারপাশে যতদূর চোখ যায়— থই থই পানি। শতবর্ষী বিদ্যালয়টি যেন জলমগ্ন জনপদের নিঃসঙ্গ এক প্রহরী। চারদিকের পানিবন্দি অবস্থার কারণে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগ যেন চিরচেনা বাস্তবতা। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়—‘না চলে নাও, না চলে পাও।’
আওয়ামী লীগ সরকার একটানা ১৭ বছর ক্ষমতায় থাকলেও গোপালগঞ্জের বিদ্যালয়টি যেন সমস্যায় ভরপুর। এসব সমাধানে দীর্ঘদিনেও নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে এলাকাবাসীর।
১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৮৭ জন শিক্ষার্থী ও ৪ জন শিক্ষক রয়েছেন। কিন্তু স্কুলে যাওয়ার কোনো ভালো রাস্তা নেই। বর্ষা মৌসুমে হাঁটু সমান কাদা ও বুক সমান পানি পেরিয়ে প্রতিদিন নৌকায় চড়ে ক্লাসে পৌঁছাতে হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। স্কুলমাঠও বছরের বেশিরভাগ সময় থাকে পানির নিচে, ফলে ক্লাসরুমেই অনুষ্ঠিত হয় প্রতিদিনের সমাবেশ বা অ্যাসেম্বলি।
প্রতিবছর আষাঢ় থেকে কার্তিক—এই পাঁচ মাস বিদ্যালয়টি জলাবদ্ধ থাকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত বর্ষাকালে একই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়দের। কোথাও হাঁটু সমান কাদা, কোথাও আবার বুক সমান পানি, এ পথ পেরিয়েই স্কুলে আসতে হয় শিশুদের। বর্ষাকালে নৌকা না থাকলে শিক্ষার্থীরা প্রায়ই স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। ফলে এ সময়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যায়, পাঠদানের মানেও পড়ে বিরূপ প্রভাব।
এ সময়ে পানিবাহিত রোগ, সর্দি-জ্বর ও চর্মরোগের প্রকোপ বাড়ে। মাঝে-মধ্যে ঘটে ছোট-খাটো দুর্ঘটনাও, নৌকা ডুবির ঘটনাও বিরল নয়। ফলে অভিভাবকদের মধ্যে ভীতি কাজ করে, যার প্রভাব পড়ছে ভর্তি শিক্ষার্থীর সংখ্যাতেও। অনেক পরিবার বর্ষাকালে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফেরদাউস মোল্লা জানায়, প্রতিদিন নৌকায় আসতে হয়, অনেক কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে বই-খাতা ভিজে যায়, জ্বর হয়। আমাদের স্কুলে যাওয়ার একটা রাস্তা খুব দরকার। একই শ্রেণির শিক্ষার্থী বর্ষা খানম জানায়, নৌকা না থাকলে স্কুলে যেতে দেরি হয়। একটা রাস্তা করলে সময়মতো ক্লাসে যেতে পারব। পড়াশোনাও ভালো হবে।
বিদ্যালয়টির একাধিক অভিভাবক জানান, সন্তানদের প্রতিদিন নৌকায় পাঠাতে ভয়ে থাকতে হয়। সামান্য অসাবধানতাতেই বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
একটানা ১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও শতবর্ষী এই বিদ্যালয়ের যাতায়াত-সংকটের সমাধান হয়নি। স্থানীয়দের জোর দাবি—বিদ্যালয়ের জন্য একটি নিরাপদ রাস্তা তৈরি করা হোক, যাতে শিশুরা ঝুঁকি ছাড়াই শিক্ষার আলোয় ফিরতে পারে।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শেখ মজিবুর রহমান বলেন, বর্ষাকালে স্কুলে পৌঁছতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ই বিপাকে পড়েন। সময়মতো ক্লাস শুরু করা যায় না, উপস্থিতিও কমে যায়। পরীক্ষার ফলেও এর প্রভাব পড়ে। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থী ভর্তির হারও দিন দিন কমছে। আমরা বহুবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রাস্তা নির্মাণের দাবি জানিয়েছি, আশা করি এবার সমাধান হবে।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, জেলার ৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সোনাসুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ও এর আওতায় রয়েছে। ইতোমধ্যে যাতায়াত-সংকট দূর করতে রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শিগগির কাজ শুরু করা হবে।