সংবেদনশীল স্থানে ভ্রমণ বা ডার্ক ট্যুরিজম হলো এমন এক ধরণের ভ্রমণ, যেখানে পর্যটকরা দেশের জন্য বীর যোদ্ধাদের আত্মত্যাগ, বিপর্যয়, দুর্ভোগ বা ঐতিহাসিক স্পর্শকাতর ঘটনাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত স্থানগুলো দর্শন করেন। সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্র, স্মৃতিসৌধ, গণকবর, জাদুঘর বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের স্থানগুলোই এই পর্যটনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।
ডার্ক ট্যুরিজম কোনো নতুন ধারণা নয়। প্রাচীন যুগ থেকে মানুষ বহু শতাব্দী ধরে যুদ্ধের ময়দান, শাস্তির স্থান, নির্যাতনের স্থান, ফাঁসির মঞ্চ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুর ঘটনাসংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করে আসছে। উদাহরণস্বরূপ, রোমান সাম্রাজ্যের কলোসিয়ামে (Colosseum) মানুষ গ্লাডিয়েটরদের লড়াই দেখতে যেত। মধ্যযুগে ফরাসি বিপ্লবের সময়ে ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দৃশ্য দেখতে যেত। উনিশ ও বিংশ শতাব্দীতে নেপোলিয়নের যুদ্ধক্ষেত্র, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের স্থান ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ট্রেঞ্চগুলোয় পর্যটকরা ভ্রমণ শুরু করেন।
আধুনিক ডার্ক ট্যুরিজম শুরু হয়েছে ১৯৯৬ সাল থেকে। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন লেনন ও মালকম ফোলি প্রথম ডার্ক ট্যুরিজম শব্দটি ব্যবহার করেন এবং এটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। ডার্ক ট্যুরিজম জনপ্রিয়তা পাওয়া শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন পোল্যান্ডের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এরপর ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার স্থান বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে। ২০০১ সালের কথিত ‘৯/১১ হামলা’র পর গ্রাউন্ড জিরো মেমোরিয়াল পর্যটনের একটি অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
বর্তমানে ডার্ক ট্যুরিজম বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এবং একটি বড় পর্যটন খাত হিসেবে গড়ে উঠছে। যদিও ডার্ক ট্যুরিজমের জন্য সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবে কিছু গবেষণা ও প্রতিবেদন অনুযায়ী এটি মোট পর্যটনের পাঁচ শতাংশের বেশি বলে অনুমান করা হচ্ছে।
ডার্ক ট্যুরিজমের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেমন—ঐতিহাসিক জ্ঞান অর্জন, শিক্ষা এবং কিছু পর্যটকের নতুন ও ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা। এছাড়া বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে ডার্ক ট্যুরিজমের গন্তব্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেমন বন্দিশিবির, যুদ্ধক্ষেত্র, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের স্থান ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানগুলোয় ভ্রমণ। বিশ্বজুড়ে ডার্ক ট্যুরিজমের বিষয়ে গবেষণা ও শিক্ষা প্রচারের কারণে এর প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। বিভিন্ন ট্যুর অপারেটর ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের ভ্রমণের আয়োজন করছে। এটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ডার্ক ট্যুরিজম বেশিরভাগ পর্যটকের জন্য প্রধান গন্তব্য হিসেবে থাকে না, বরং এটি তাদের ভ্রমণের একটি অংশ বা অতিরিক্ত সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের ডার্ক ট্যুরিজম ব্যবসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এ দেশে ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, যা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারে।
বাংলাদেশের সম্ভাব্য ডার্ক ট্যুরিজমের স্থান
ডার্ক ট্যুরিজম একটি সংবেদনশীল ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন খাত। এ কারণেই এই খাতের উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১. ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ ও উন্নয়ন
২. গবেষণা ও তথ্য উপস্থাপন
৩. পর্যটন শিল্পের প্রচারণা ও প্রসার
৪. এই বিষয়ে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন
ডার্ক ট্যুরিজমকে টেকসই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি সংবেদনশীল স্থানগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং একই সঙ্গে পর্যটনশিল্পকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়ক রাখে। টেকসই ডার্ক ট্যুরিজম নিশ্চিত করতে কয়েকটি বিষয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
৫. ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ
৬. পর্যটকদের জন্য শিক্ষা ও সংবেদনশীলতা সৃষ্টি
৭. স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ও লাভ নিশ্চিতকরণ
৮. পর্যটনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা
৯. পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পরিবহন ব্যবস্থা
ডার্ক ট্যুরিজমকে টেকসই করা সহজ কাজ নয়। এটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানগুলোর মর্যাদা রক্ষা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ইতিবাচক পরিকল্পনা ও স্থানীয় জনগণের সহযোগিতার মাধ্যমে ডার্ক ট্যুরিজমকে টেকসই ও স্থায়ী রূপ দিতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি একটি সফল, শিক্ষামূলক ও টেকসই পর্যটন শিল্পে পরিণত হতে পারে। ইতিহাস, শোক ও মানবিকতার সঙ্গে সংযুক্ত স্থানগুলোয় পর্যটকদের শিক্ষা ও মূল্যবোধ সৃষ্টি করা জরুরি, যাতে ডার্ক ট্যুরিজম শুধু একটি লাভজনক শিল্প না হয়ে মানব ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে।
সরকার যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করলে ডার্ক ট্যুরিজম ইতিহাস সংরক্ষণের পাশাপাশি একটি শিক্ষামূলক, গবেষণাধর্মী ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক খাতে পরিণত হতে পারে। এর মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা সম্ভব হবে। ফলে পুরো পর্যটন খাতের উন্নয়ন ও বিকাশ আরো প্রসারিত হবে।
লেখক : উপদেষ্টা, ট্যুরিজম ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিডাব)