হোম > ফিচার > নারী

খালেদা জিয়ার বহুমাত্রিক সংগ্রামী জীবন

মা, স্ত্রী ও নেত্রী

মুহাম্মদ কামাল হোসেন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাদের জীবন চলার পথ মোটেও সহজ, সুন্দর ও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তাদের পথ বাঁক নেয় ক্ষণে ক্ষণে, মোড় ফেরে অপ্রত্যাশিতভাবে। বেগম খালেদা জিয়া বিরল ব্যক্তিত্বদের একজন। একজন সাধারণ গৃহিণী থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের আসনে আসীন—এই যাত্রা কেবল একটি রাজনৈতিক উত্থানের গল্প নয়, লাখ লাখ নারীর কাছে একটি নীরব অনুপ্রেরণার ইতিহাস। নারীর চিরায়ত ভূমিকাগুলো পালন করতে করতেই তিনি এক কঠিন জনজীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন।

১৯৪৫ সালে জন্ম নেওয়া এই নারী হয়তো কোনোদিনই ভাবেননি, তার জীবনের ক্যানভাসে রাজনীতির প্রখর রঙ এভাবে মিশে যাবে। তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে অনেকটা শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশে। এরপর তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। তখন তার জগৎ ছিল সংসার, স্বামী আর সন্তানের মমতাভরা ছায়ায়। সাধারণ বাঙালি বধূর মতো তিনিও যত্ন নিয়েছেন স্বামীর, তৈরি করেছেন সন্তানদের জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়। সেই সময়ে রাজনীতি বা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে তার কোনো আগ্রহ ছিল না, ছিল না কোনো দৃশ্যমান প্রস্তুতি।

বেগম জিয়ার জীবনের প্রথম বড় পরিবর্তন আসে ১৯৭৫ সালের সামরিক পট পরিবর্তনের পর। স্বামী জিয়াউর রহমান যখন দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে আসীন হলেন, তখন বদলে গেল তার জীবন। রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হওয়া মানেই শুধু গ্ল্যামার আর প্রটোকল নয়, এর পেছনে থাকে এক বিশাল চাপ আর নীরব ত্যাগ। তাকে দেখতে হতো কীভাবে স্বামী দেশের কঠিনতম সময় পার করছেন, কীভাবে তিনি একইসঙ্গে সামরিক শৃঙ্খলা আর রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করছেন। একজন স্ত্রী হিসেবে তিনি তখনো পর্দার আড়ালে ছিলেন, কিন্তু স্বামীর প্রতিটি পদক্ষেপে তার মানসিক সমর্থন ছিল অপরিহার্য। তারপর এলো ১৯৮১ সালের সেই মর্মান্তিক ঘটনা—রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আকস্মিক শাহাদাত। এই ঘটনা কেবল তাকে ব্যক্তিগতভাবে শোকাহত করেনি, বরং তাকে ঠেলে দিয়েছিল এক গভীর অনিশ্চয়তার মুখে। এ যেন ছিল এক মহাবিপর্যয়। ব্যক্তিগত ক্ষতি ও শোকের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল জাতীয় রাজনীতিতে এক বিরাট শূন্যতা। যে নারী এতদিন ছিলেন নিছক পত্নী ও জননী, তাকে হঠাৎই আবিষ্কার করতে হলো এক বিশাল জনসমুদ্রের সামনে, যারা দিকনির্দেশনার জন্য তার দিকে তাকিয়ে আছে।

স্বামীর মৃত্যুর পর তার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। প্রথমত, সন্তানদের নিয়ে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও শান্ত জীবনে ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, রাজনীতির কাঁটায় ভরা পথে নেমে আসা। একজন মা হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন সন্তানদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা। কিন্তু নিয়তি তাকে ব্যক্তিগত সুখের পথে বেশি দিন থাকতে দিল না। জিয়াউর রহমানের দল ও আদর্শ যখন বিপর্যয়ের মুখে, তখন দলের নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের প্রবল চাপ তাকে ঘর ছেড়ে বাইরে আসতে বাধ্য করল। জিয়াউর রহমানের প্রতিচ্ছবি ও আদর্শ রক্ষার শেষ ভরসা মানুষ তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল।

শুরু হলো তার জীবনের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে কঠিন সংগ্রাম। যিনি কখনো প্রকাশ্যে রাজনীতি করেননি, বক্তৃতা দিতে অভ্যস্ত ছিলেন না, সেই তাকেই দাঁড়াতে হলো সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে তিনি দেশনেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। এই পর্বটি ছিল তার জন্য এক অসাধারণ রূপান্তর। তিনি কেবল একটি দলের প্রধান হননি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক মূর্ত প্রতীক। সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পথে নামা, দলের হাল ধরা এবং সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান নেওয়া—এভাবেই শুরু হলো বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের পথচলা।

বেগম খালেদা জিয়া অনেকটা বাধ্য হয়ে রাজনীতির কঠিন কণ্টকাকীর্ণ পথে নেমে এলেন। এই পথ ছিল সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু, জেল-জুলুমের ভয় এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ঝুঁকি। গৃহকোণের শান্ত জীবন ছেড়ে আসা এই নারী তখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতীক। তিনি রাজপথে হাঁটছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন আর জনতাকে আশার আলো দেখাচ্ছেন।

তবে এই নেত্রীর ভেতরে সবসময় একজন মা লুকিয়ে ছিলেন। যখন তিনি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে ব্যস্ত, অথবা স্বৈরাচারী সরকারের নির্দেশে তাকে গৃহবন্দি করা হচ্ছে, তখন তার মন পড়ে থাকত সন্তানদের কাছে। একজন জননী হিসেবে সন্তানদের বেড়ে ওঠার প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী হতে না পারার যে যন্ত্রণা, তা হয়তো বাইরের মানুষের কাছে দৃশ্যমান ছিল না। দেশ ও দলের প্রতি তার যে দায়িত্ববোধ, তা তাকে ব্যক্তিগত সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করতে শিখিয়েছিল। একজন নারী হিসেবে এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং ত্যাগ ছিল তার সংগ্রামী জীবনের এক গভীরতম দিক। রাজনীতি তার কাছে নিছক ক্ষমতা দখলের খেলা হয়ে থাকেনি, এটি পরিণত হয়েছিল একটি পবিত্র দায়িত্বে, যা তিনি স্বামীর আদর্শ ও দেশবাসীর ভালোবাসার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পালন করেছেন।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তার আন্দোলন ছিল দীর্ঘ ও ক্লান্তিহীন। তিনি জানতেন, আপস করলে মুহূর্তেই সব সহজ হয়ে যেত, কিন্তু তিনি আপস করেননি। এই আপসহীনতাই তাকে দেশের জনগণের কাছে দেশনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। তার দৃঢ়চেতা মনোভাবই তাকে অন্য সব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে আলাদা করে তোলে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হলো, তখন জনতার রায় তার পক্ষেই এসেছিল।

১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। সামরিক অফিসারের পত্নী ছিলেন এবং পরে শোকের ভারে গৃহকোণ ছেড়েছিলেন, তিনিই হলেন দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। এটি কেবল তার জীবনের সাফল্য নয়, এটি ছিল নারীর ক্ষমতায়নের এক বিশাল বার্তা। এই বহুমাত্রিক সংগ্রামে তিনি কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করেননি, তাকে লড়তে হয়েছে সমাজের সেই চিরায়ত ধারণার বিরুদ্ধেও, যেখানে নারীকে কেবল ঘরের কাজ বা কোমল পেশার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ভাবা হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার পথচলাও মসৃণ ছিল না। দেশ পরিচালনায় তাকে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে তার নেতৃত্ব সর্বদা ছিল দৃঢ় ও কৌশলী।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যেমন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ করতেন, তেমনি রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততা শেষে তিনি ছিলেন তার পরিবারের গৃহকর্ত্রী। তার এই দ্বৈত ভূমিকা পালন করা ছিল এক কঠিন কাজ—একদিকে দেশ শাসন করার চাপ, অন্যদিকে পারিবারিক সম্পর্ক রক্ষা। তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন নারী চাইলে সফলভাবে দুটি ভিন্ন জগৎ সমানভাবে সামলাতে পারেন। কারণ তার আছে রাজনৈতিক তীক্ষ্ণতা এবং পারিবারিক মমত্ববোধ। বেগম জিয়া তার জীবনে কঠিন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা দেশের গতিপথ পরিবর্তন করেছে। তিনি দেশ ও দলের প্রতি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার এই সংগ্রামী জীবন একটি কথাই বলে—‘নারী চাইলে নিজের গণ্ডি পেরিয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।’

ক্ষমতার পালাবদলে তার জীবনে নতুন করে প্রতিকূলতা নেমে আসে। ১৯৯৬ সালে এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি আবারও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। বেগম জিয়ার জীবনেও বারবার এসেছে পরীক্ষা, যেখানে তার ধৈর্য, মনোবল ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা প্রমাণিত হয়েছে।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি একাধিকবার জেল-জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করেছেন। এই সময়গুলোতে তার নেত্রীসত্তার পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত সত্তাটি ছিল আরো বেশি একা ও নিঃসঙ্গ। বার্ধক্যের চাপ, অসুস্থতা এবং পারিবারিক বিয়োগবেদনা তাকে দুর্বল করতে পারেনি; বরং প্রতিটি প্রতিকূলতা যেন তার মধ্যে নতুন করে এক ধরনের দৃঢ়তা এনে দিয়েছে। দেশের জন্য লড়াই করার যে অঙ্গীকার তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর করেছিলেন, তা তিনি শেষ দিন পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রাজনীতিতে তার অবস্থান কেবল ক্ষমতার প্রশ্নে নয়, নীতির প্রশ্নেও তাকে এক অনড় ও দৃঢ় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

বেগম খালেদা জিয়া তার বহুমাত্রিক জীবনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। তার সংগ্রাম কেবল দলীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি, এটি দেশের নারীদের জন্য এক নীরব বার্তা বহন করেছে। এই বার্তা হলো, নারী চাইলে গৃহের দায়িত্ব এবং দেশের নেতৃত্ব উভয় ক্ষেত্রেই সফল হতে পারে। তার জীবন দেখিয়েছে, একজন নারী তার আবেগ, সংবেদনশীলতা এবং একইসঙ্গে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে একটি জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে সক্ষম।

তার জীবনের এই তিন ভূমিকা—মা, স্ত্রী ও নেত্রী, একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। স্বামীর আদর্শ রক্ষা এবং সন্তানদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাড়না তাকে রাজনীতিতে আসতে বাধ্য করেছিল। রাজনীতিতে এসে তিনি দেশের কোটি কোটি মানুষকে নিজের পরিবারের অংশ হিসেবে দেখেছেন, তাদের জন্য সংগ্রাম করেছেন। এভাবেই তার ব্যক্তিগত মমতা ছড়িয়ে পড়েছে বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে।

আজ বেগম খালেদা জিয়া সরাসরি রাজনীতির মাঠে ততটা সক্রিয় না হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার প্রভাব সর্বদা অনস্বীকার্য। তার বহুমাত্রিক সংগ্রামী জীবন নতুন প্রজন্মের নারীদের জন্য একটি বিশাল শিক্ষণীয় অধ্যায়। তার উত্তরাধিকার শুধু দলীয় কাঠামোতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সাহস, আপসহীনতা ও আত্মত্যাগের প্রতীক।

বেগম জিয়া এক সাধারণ বাঙালি বধূ থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠা এবং কঠিন সময়েও আদর্শের প্রশ্নে অবিচল থাকা—তার এই জীবনগাথা নিঃসন্দেহে দেশের কোটি কোটি নারীর জন্য এক হৃদয়গ্রাহী অধ্যায়। তার বর্ণিল সংগ্রামী জীবনের এই গল্প অগণিত নারীকে সাহস জোগাবে, নিজেদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক ভূমিকা পালনে নিশ্চিত অনুপ্রেরণা দেবে। তার এই বহুমাত্রিক সংগ্রাম বাংলাদেশের নারী জাগরণের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

শিক্ষাব্রতী ও নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া

উদ্যোক্তাদের হেমন্ত উৎসব

দুই মুক্তিযোদ্ধার কথা

এবার বেগম রোকেয়া পদক পাওয়া কে এই নাবিলা ইদ্রিস

মেট্রোরেলে চলার সহবত

নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ উপলক্ষে ১৫ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা

আফরিদার সাফল্যের রহস্য

কর্মব্যস্ত নারীর জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন

আনন্দ অশ্রুতে শহীদদের মায়েরা

নারী ও প্রকৃতির মেলবন্ধনে সামিনার শিল্পযাত্রা