হোম > জুলাই বিপ্লব

যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ

জুলাই বিপ্লবে ঢাকার রণক্ষেত্র-৩

মাহমুদা ডলি

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে জুলাই বিপ্লব রূপ নিয়েছিল রণক্ষেত্রে। আন্দোলনের পুরোটা সময় বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিলেন ওই এলাকার মানুষ। পুলিশ এবং সরকারদলীয় অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মুহুর্মুহু নির্বিচার গুলি চালায় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর। বাড়ে লাশের মিছিল।

ইটের টুকরা হাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলায় স্লোগান দিচ্ছিল কিশোর সবুজ (১৪)। তখন যাত্রাবাড়ী থানার সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছুড়ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ইট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরের বুকের বাঁ পাশে হঠাৎ এসে গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। তখন আরেক আন্দোলনকারী সবুজকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কাজলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছোড়া গুলি মিনিটে মিনিটে আন্দোলনকারীদের শরীরে বিঁধছিল। আহত আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে রেখে আবার কাজলার রোডে ফিরছিলেন সহযোদ্ধারা।

ছাত্র-জনতার জীবনবাজি রেখে রাস্তায় গিয়ে গুলিতে হতাহতের ঘটনার শুরু ১৭ জুলাই সকাল ১০টায়। ১৭ থেকে ২২ জুলাই এবং ৩ থেকে ৫ আগস্ট দুই দফায় ৯ দিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার কিলোমিটার এলাকায় অস্ত্র ও গুলির মুখে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ছাত্র-জনতা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যাত্রাবাড়ীতে প্রতিদিনই মানুষের লাশ সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যাত্রাবাড়ীতে জুলাই বিপ্লব দিবস উপলক্ষে আয়োজিত স্থানীয় এক সমাবেশে বিভিন্ন ভিডিও ও স্থিরচিত্রে তুলে ধরা সেই চিত্রগুলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। গলির মধ্যে থেকেও গোয়ালবাড়ী মোড়সহ কয়েকটি স্থানে গুলিতে নিহত অন্তত ১০ জনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন স্থানীয় লোকজন। যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ১৮ জুলাই বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র‌্যাব ও এপিবিএন সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় মোতায়েন ছিল। আন্দোলনকারীরা থানার কাছে সড়ক দখল করে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। মাছের আড়তে ঘুমিয়ে থাকা এক কর্মচারীর মাথায় গুলি লাগে। ঘুমের মধ্যেই চিরঘুমে চলে যান তিনি।

পুলিশের গুলি আর সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যার পরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। তখন পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে কাজলার উড়ালসড়কের কাছে পেশাগত দায়িত্ব পালনরত ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদী হাসানের বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়। গুলিতে হতাহত মানুষের ঠাঁই হয় হাসপাতালে।

১৮ ও ১৯ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পড়েছিল অনেকের লাশ। আবার ৩ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার কিলোমিটার মহাসড়ক দখলে নেন ছাত্র-জনতা। শুরু হয় র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তুমুল সংঘর্ষ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন সকাল ১০টার দিকে হাজারো ছাত্র-জনতা কাজলায় অবস্থান নেন। দুপুর ১টার পর পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে যাত্রাবাড়ী থানার সামনের সড়কে এক পাশে লুকিয়ে থাকা ৩০-৩৫ জন আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এসব লাশ অনেকক্ষণ যাত্রাবাড়ী থানার সামনের সড়কে পড়েছিল। পরে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকাল ৪টার পর আন্দোলনকারীরা লাশগুলো ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান।

যাত্রবাড়ীতে ৫ আগস্টে শহীদ হওয়া ইমাম হোসেন তাঈমের ভাই রবিউল আউয়াল আমার দেশকে বলেন, ১৬ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত তার ভাই আন্দোলন করেছিলেন। একটি বুলেটে তার জীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। ২০ জুলাই তাঈমের শরীরে ২০০টির বেশি ছররা গুলি লাগে। ওই ঘটনায় তাঈমের বাবা সাব-ইন্সপেক্টর ময়নুল হাসান তার সিনিয়র অফিসারকে বলেছিলেনÑ‘একটি মানুষ মারতে কয়টা গুলি লাগে স্যার?’

একদিনেই পুলিশের হাতে ৫২ জন নিহত

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে কমপক্ষে ৫২ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। গত ১৫ জানুয়ারি দ্য টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট, ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রোজেক্ট এবং আউটসাইডার মুভি কোম্পানি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট দুপুর ১টা ৫৬ মিনিট থেকে বিকাল ৩টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থানার বাইরে আসলে কতজন নিহত হয়েছিলেন, তাদের পরিচয় এখনো প্রকাশ হয়নি। ওই গুলিবর্ষণের জন্য কোন পুলিশ কর্মকর্তারা দায়ী এবং কার নির্দেশে পুলিশ এভাবে ব্যবস্থা নিয়েছিলÑএ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।

মার্কেটের মধ্যে ঢুকে বেপরোয়া গুলি পুলিশের

সরেজমিন দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ীতে সেদিনের বর্বরতার চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। ঝরে পড়া পাতার মতো সময়ের স্রোতে দাবানল নিভে গেলেও আগ্নেয়রসদ এখনো স্মৃতি হয়ে রয়েছে। সাঁজোয়া যান নিয়ে ৪ আগস্ট পুলিশ যেভাবে এলোপাতাড়ি বুলেট ছুড়েছিল, তার সাক্ষী হয়ে রয়েছে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া মাছের আড়তের ছাতাগুলো।

বুলেটে আহত মাছ ব্যবসায়ী সোহেল আমার দেশকে জানান, তার ভাই সবুজ (১৭) এখনো হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত বুলেট নিয়ে পঙ্গু অবস্থায় ঘরে পড়ে রয়েছে। সোহেল জানান, সবুজ ৪ আগস্ট মিছিল নিয়ে থানার সামনে থেকে যাওয়ার সময় পুলিশ ধাওয়া করে। ওই সময় তারা পালিয়ে সামনের মহানগর মার্কেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে। পুলিশ মার্কেটের মধ্যে ঢুকে যাকে পেয়েছিল তাকেই ঠেকিয়ে গুলি করেছিল। সবুজকে ঠেকিয়ে কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত গুলি করে। এখন পর্যন্ত সবুজের হাঁটুর হাড় থেকে বুলেট বের করা সম্ভব হযনি।

আরেক মাছ ব্যবসায়ী বেল্লাল জানান, পুলিশ প্রতিদিন সাঁজোয়া যান নিয়ে থানা থেকে বের হতো গুলি করতে করতে। সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই মেরেছে। আড়তের দিকে তাক করে ইচ্ছামতো গুলি ছোড়ে। তাতে মানুষ থাকুক আর না থাকুক।

যাত্রাবাড়ীর জুলাই বিপ্লবের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আল আমীন আটিয়া। তিনি আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনের সদস্য সচিব এবং মোদিবিরোধী আন্দোলন ও ছাত্র অধিকার পরিষদের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা। আল আমীন বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ীতে শহীদদের তালিকাটা প্রকৃতভাবে হয়নি। আন্দোলনের সময় নিহতদের অনেক লাশ পুলিশ তুলে নিয়ে গুম করে ফেলে।’ তিনি বলেন, ‘১৬ জুলাই সন্ধ্যায় আমরা দনিয়া কলেজ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। তখন পুলিশের সঙ্গে আমাদের ধাক্কাধাক্কি ও বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। এরপর ১৭ জুলাই সকাল থেকে শুরু হয় রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষ। আমরা ইটপাটকেল হাতে নিলাম। পুলিশ আমাদের ওপর গুলি ছুড়ল। অনেক আন্দোলনকারীর দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পুলিশের গুলিতে। দেখা যায়, যেখানে আমরা জমায়েত হচ্ছি ওই জায়গায় পুলিশ সাঁজোয়া যান নিয়ে আমাদের ওপর গুলি ছুড়ছে।’

আল আমীন বলেন, ‘দুই-চারজন যারা ছুটে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, তাদের ওপর গুলি করে পুলিশ। আবার ওই বুলেটে আহত হওয়া ছেলেটির ওপর দিয়ে সাঁজোয়া যান চালিয়ে নিয়ে যায়। তখন আমরা চিৎকার করে কেদেঁছি। পুলিশ চলে যাওয়ার সময় ওই নিথর দেহটি তুলে নিয়ে যায়। আমরা তাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পাইনি।’

১৭ থেকে ২১ তারিখের মধ্যেই যাত্রাবাড়ীতে ৫০-৬০ জনকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ উল্লেখ করে আল আমীন বলেন, ‘যে লাশগুলো পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সেগুলোর হদিস পাইনি। লাশগুলো গুম করা হয়েছে।’

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে হেফাজতের ১৭-১৮ জন শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছেন। এখনো পর্যন্ত সবার পরিচিতি খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে তারা নাম চূড়ান্ত করতে পারেননি।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ডেমরা-যাত্রাবাড়ীর সংগঠক ও সমন্বয়ক বিএনপি নেতা ফেরদৌস হোসেন রনি বলেন, ‘একজন অপরিচিত ব্যক্তির (৩৮) মাথার এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে গুলি বের হয়ে যায়। আমি তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিছুক্ষণ পর ওই ব্যক্তি মারা যান। পরে তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু আন্দোলনের পর আর তার খোঁজ পাইনি। কী হলো না হলো কিছুই জানি না। তার শরীরের রক্তে আমার পুরো হাত ভরে যায়। বিষয়টি আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে। মাঝেমধ্যেই বির্মষ হয়ে পড়ি এসব মনে পড়লে।’

যাত্রাবাড়ীর ঘটনায় ১৯টি ভিডিওচিত্র পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি ভিডিওতে যাত্রাবাড়ী থানার মূল ফটকে বিক্ষোভকারীদের সামনে সেনাবাহিনীর একটি দলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর হঠাৎ করেই তারা ওই এলাকা থেকে সরে যায়। এ ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রাবাড়ী থানার ভেতরের পুলিশ সদস্যরা ফটকের সামনে অবস্থানরত বিক্ষোভকারী জনতার ওপর আকস্মিকভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করে।

থানার উল্টো দিকে অবস্থিত একটি ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ গুলি শুরু করার পর প্রাণ বাঁচাতে গলির ভেতর দিয়ে ছুটে পালাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। ওই সময়ের আরেকটি ভিডিওতে আহতদের শরীরে লাথি মারতেও দেখা যায় পুলিশ সদস্যদের।

জুলাই যোদ্ধাকে বাদী সাজিয়ে বানোয়াট মামলা

অর্থাভাবে অপারেশন করাতে পারছেন না জসিম

মাদরাসা ও সংসার হারিয়ে দিশেহারা জুলাইযোদ্ধা শফিকুর

গুলি খেয়ে কাতরাচ্ছিলেন তাইম, দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিল পুলিশ

স্বামী হত্যাকারীদের ফাঁসি চান শহীদ মিজানুর রহমানের স্ত্রী

টিয়ারশেলের স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন রাফি

অবহেলার শিকার শহীদ নুরুল মোস্তফার পরিবার

আসরের আজান হলেই উত্তরায় হিংস্র হয়ে উঠত পুলিশ

পালানোর আগে দিল্লির নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন হাসিনা

‘পুলিশ লোড করে দেয়, আর গুলি করে আ.লীগ সন্ত্রাসীরা’