হোম > সাহিত্য সাময়িকী > গল্প

অপেক্ষা ও অশরীরী জ্যামিতি

আল পারভেজ

জীবন এক নিপুণ জ্যামিতি। আমরা বিন্দু থেকে বৃত্ত আঁকি, আবার সেই বিন্দুতেই ফিরে যাই। পার্থক্য শুধু এই যে, শুরুর বিন্দুটি থাকে আলোয় ঝলমলে, আর শেষেরটি ডুবে থাকে গাঢ় অন্ধকারে। সেই অন্ধকারের নামই মৃত্যু। কিন্তু কিছু মৃত্যু স্বাভাবিক বৃত্ত পূর্ণ করে না; তারা সরলরেখা হয়ে অসীমের দিকে ধাবিত হয়। অর্ণব ছিল সেই অসীমের এক যাত্রী।

অর্ণবকে আমি চিনতাম। ছিপছিপে গড়ন, চোখের কোণে এক চিমটি বিষণ্ণতা সর্বদাই লেপ্টে থাকত। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে ছেলেটার পৃথিবীটা ছোট হতে হতে এক চিলতে বারান্দায় এসে ঠেকেছিল। মা-বাবার শূন্যতা যে কী ভয়ঙ্কর হাহাকার তৈরি করে, তা অর্ণবকে না দেখলে বোঝা যেত না। সে প্রায়ই বলত, ‘জানেন লেখক সাহেব, মাঝরাতে মনে হয় মা আমার শিয়রে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমি স্পষ্ট তার হাতের চুড়ির শব্দ শুনি। অথচ মা তো নেই!’

আমি হাসতাম। বলতাম, ‘ওটা মনের ভুল, প্যারাসাইকোলজি একে ‘গ্রিফ হ্যালুসিনেশন’ বলে।’

অর্ণব ম্লান হেসে উত্তর দিত, ‘ভুল যদি এতই সুন্দর হয়, তবে সত্যি হওয়ার দরকার কী?’

অর্ণবের বিয়ে হলো। ভেবেছিলাম এবার হয়তো সে এক চিলতে মাটি খুঁজে পাবে। কিন্তু মানুষের ভাগ্য বড় বিচিত্র। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হলো। যে ছেলেটা সারা জীবন শুধু একটু ভালোবাসা আর আশ্রয় চেয়েছিল, সে পেল তুচ্ছতাচ্ছিল্য। গত শুক্রবার সে গ্রামে ফিরল। কিন্তু তার চোখে সেই চিরচেনা মায়াটা আর ছিল না, ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা। যেন সে এই জগতের কেউ নয়, শুধু ভুল করে এখানে এসে পড়েছে।

শনিবার থেকে অর্ণব নিখোঁজ। চারদিকে খোঁজাখুঁজি চলল। সবাই ভাবল অভিমানী ছেলেটা হয়তো কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু সোমবার ভোরে গ্রামের নির্জন খালের ওপর পুরোনো কালভার্টটার নিচে যা দেখা গেল, তা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়। অর্ণব ঝুলে আছে। তার নিথর দেহটা বাতাসের দোলায় দুলছে।

আমি যখন সেখানে পৌঁছালাম, তখন ভোরের কুয়াশা কাটেনি। খালের পানি স্থির, যেন কোনো এক অজানা শোকাতুর সত্তা সেখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের তৎপরতা, মানুষের গুঞ্জন—সবকিছু ছাপিয়ে আমার মাথায় এক দীর্ঘ কবিতার চরণ বারবার আছড়ে পড়ছিল:

“শ্যাওলা ধরা স্মৃতির ঘরে নিভল যখন আলো,
মা ডাকল অন্ধকারে— ‘আয়রে খোকা, আয়রে আমার ভালো।’
বাবার হাতের সেই ঘড়িটা থমকে গেছে আজ,
জলের তলে লিখছে রেখা মৃত্যুর কারুকাজ;
রক্ত-মাংসের এই খাঁচাটা যখন হবে শেষ,
ছায়ার দেশে মিলবে ছায়া, ঘুচবে সব ক্লেশ।”

কিন্তু রহস্যটা এখানে নয়। রহস্যটা শুরু হলো যখন পুলিশ পোস্টমর্টাম রিপোর্ট থেকে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করল। অর্ণব যে রশি দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়েছে, সেটি কোনো রশি নয়। সেটি একটি পুরোনো শাড়ি—হলুদ রঙের জামদানি। অর্ণবের দাদি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ওরে, এইটা তো ওর মায়ের শাড়ি! মা মরার পর এইটা সিন্দুকে তালা দেওয়া ছিল। চাবি তো আমার কাছেই থাকে। ও এইটা পাইলো কই?’

আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু তার চেয়েও বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছিল অর্ণবের পকেটে পাওয়া এক চিরকুটে। চিরকুটটা পুলিশের হাতে। আমি পাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম। সেখানে কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা—

‘মা-বাবা কাল রাতে এসেছিলেন। বললেন, ব্রিজটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে। তারা আমাকে নিতে আসবেন। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু অবাক কাণ্ড, আমি নিজেকেই নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। যে ঝুলছে সে আমি নই, অথচ সে-ই তো আমি! মা আমার হাত ধরে বললেন—চলো খোকা, তোমার আসল বাড়ি যাবে।’

ওসি সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘পাগলের প্রলাপ! শনিবার থেকে নিখোঁজ, আর চিরকুটে লিখেছে কাল রাতের কথা? তার মানে মারা যাওয়ার পরেও সে চিঠি লিখেছে?’

কিন্তু আমার বুক ধড়ফড় করে উঠল অন্য একটি কারণে। অর্ণব যখন ঝুলছিল, তখন তার পায়ের জুতো দুটো ছিল একেবারে চকচকে, তাতে এক বিন্দু কাদা নেই। অথচ আগের রাতে সেই এলাকায় প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে, কালভার্টের নিচের মাটি ছিল কাদায় মাখামাখি।

গল্পের রেশটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু শেষ হলো না। মাসখানেক পর আমি সেই কালভার্টের পাস দিয়ে যাচ্ছিলাম। সন্ধ্যা নামো নামো। হঠাৎ দেখলাম, কালভার্টের রেলিংয়ে এক যুবক বসে আছে। হুবহু অর্ণব! আমি ভয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালাম।

ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই পরিচিত ম্লান হাসি। সে বলল, ‘লেখক সাহেব, জীবন আর মৃত্যুর মাঝে যে পর্দাটা থাকে, সেটা আসলে খুব পাতলা। আমি তো ফিরে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মা যেতে দিলেন না। মা বললেন— তুই তো আর ঝুলছিস না, তুই তো মুক্ত।’

আমি কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘তবে ওখানে কে ঝুলে ছিল?’

অর্ণব নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিল, ‘ওটা আমার একাকিত্ব। মানুষ ভাবে সে নিজে মরেছে, আসলে মরে যায় তার দীর্ঘদিনের জমানো কষ্টগুলো। শরীর তো শুধু একটা অজুহাত।’

কথাটা শেষ করেই সে কুয়াশার মাঝে মিলিয়ে গেল। আমি কালভার্টের নিচে তাকালাম। পানি নেই, শুধু জমাট বাঁধা অন্ধকার। আমার মনে হলো, আমরা যারা বেঁচে আছি, তারাই আসলে এক একটা কাল্পনিক অণুগল্পের চরিত্র, যার শেষ লাইনের টুইস্টটা সৃষ্টিকর্তা নিজেই লিখে রেখেছেন।

অর্ণব মারা গেছে না কি তার একাকিত্ব—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমি যখন ফিরছি, তখন হঠাৎ মনে হলো, আমার কাঁধে কেউ একটা হাত রাখল। তাকালাম, কেউ নেই। শুধু বাতাসে ভেসে এলো একটা পুরোনো জামদানি শাড়ির ন্যাপথলিন মাখা ঘ্রাণ।

ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গঠনে এগিয়ে আসাই হবে শহীদদের প্রতি প্রকৃত সম্মান

না-করা সংসার

জাতিসত্তার বুদ্ধিজীবী

যে স্বপ্ন ছফাকে ঘুমোতে দেয়নি

প্রিয় হাদি

সবাই এবার হাদি হবো

শহীদ ওসমান হাদির লেখা সেই বিখ্যাত কবিতা

বই কীভাবে বিপ্লবকে প্রভাবিত করে?

কবিরা যা বলেন

পতাকা