হোম > সাহিত্য সাময়িকী > বইপত্র

‘আবদুল্লাহ্‌’ ও বাঙালি মুসলমান সমাজ

শাহাদাৎ সরকার

বিশ শতকের সূচনালগ্নে বাঙালি মুসলমানের যন্ত্রণাজর্জর যুগ-প্রতিবেশে বাংলা সাহিত্য-ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন খান বাহাদুর কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২-১৯২৬)। কাজী ইমদাদুল হক ছিলেন সংস্কারমুক্ত, মননশীল ও যুক্তিবাদী শিল্পদৃষ্টিসম্পন্ন ঔপন্যাসিক। শিল্প-উপাদান সংগ্রহে তিনি মনোযোগী হন সমকালের এবং নিজ সমাজের প্রতি। তিনি সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ-অঙ্গনে দ্রোহী সত্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তবে সেই দ্রোহী সত্তা কাজী নজরুল ইসলামের মতো নয়, সমাজ ভাঙার ডাক নেই তার কর্মে, বরং মুসলিম সংস্কার তার লক্ষ্য।

শরৎচন্দ্র পল্লী-সমাজে (১৯১৬) যেমন সামন্ত হিন্দু সমাজকে চিত্রায়িত করেছেন, তেমনি ইমদাদুল হক তার উপন্যাসে অবশ্যই মুসলিম সমাজ। আবদুল্লাহ্‌ বিষয়ে সৈয়দ আলী আহসানের মন্তব্য স্মরণীয়—‘শরৎচন্দ্রের মতো পরিচ্ছন্ন চিন্তা তার সমকালবর্তী দুজন মুসলমান সাহিত্যিকের ভেতরে ফুটেছে। তাদের একজন খুলনার কাজী ইমদাদুল হক এবং অন্যজন যশোরের লুৎফুর রহমান। শরৎচন্দ্র যেমন হিন্দু সমাজের একটি জটিল ক্ষতের ওপর অস্ত্রোপচার করেছিলেন, কাজী ইমদাদুল হক ও লুৎফুর রহমানও তেমনি বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সমাজের নানা দোষত্রুটি সহানুভূতি দিয়ে অঙ্কিত করেছেন।’

ইমদাদুল হকের মধ্যে ছিল ঔপন্যাসিকের অদ্ভুত শক্তি এবং জীবনকে দেখার মতো তন্ময় অনুধ্যান। তার ‘আবদুল্লাহ্‌’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। সাহিত্য সমালোচনার মানদণ্ডে শরৎচন্দ্রের ‘পল্লী সমাজ’-এর সঙ্গে ‘আবদুল্লাহ্‌’র একই আসন নির্ধারিত হবে। এ উপন্যাসে ইমদাদুল হক বাঙালি মুসলিম সমাজের আশরাফ-আতরাফ প্রসঙ্গ, পর্দা, অন্ধ পীরভক্তি ও গুরুপূজা এবং ধর্মের নামে সংস্কারপ্রিয়তা প্রভৃতি নানা দোষত্রুটির প্রতি তীব্র কটাক্ষ করেছেন এবং কতকগুলো ঘটনা ও চরিত্র অবলম্বন করে মুসলমান সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন।

ইমদাদুল হক যেকালে এ উপন্যাস রচনা করেছিলেন, সেকালে বাংলার মুসলিম সমাজের এ সমস্যাগুলো প্রবলভাবে না হলেও বিশেষভাবে ছিল। ‘আবদুল্লাহ্‌’ উপন্যাসে সমাজজীবনের এ ত্রুটিবিচ্যুতির সংস্কার পরিপন্থী নবীন ও প্রবীণের দ্বন্দ্বে নবীনের জয় এবং প্রাচীনের পরাজয়ের শুভ সূচনা করে গেছেন ইমদাদুল হক। আবদুল্লাহ্‌, আবদুল কাদের ও হালিমা এ নবীন দলের মুখপাত্র এবং আবদুল্লাহ্‌ এ দলের মূর্তিমান নায়ক। আর আবদুল্লাহ্‌র শ্বশুর সৈয়দ সাহেব অতীত আচার-আচরণ এবং প্রাচীনপন্থিদের শক্তিশালী প্রতিনিধি। সৈয়দ সাহেব ও তার কন্যা সালেহা প্রমুখ প্রাচীনপন্থিদের চিত্রিতকরণ কিংবা তাদের ধর্ম ও সমাজমনের রূপায়ণে ইমদাদুল হক কোথাও তাদের বিদ্রুপ করেননি; আশ্চর্য কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় ও সহানুভূতিশীল দৃষ্টি দিয়ে প্রাচীন সমাজ পরিবেশ এবং সেই পরিবেশে তাদের বিশ্বাসানুসারী চালচলনের কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। হিন্দু-মুসলমান সমস্যা-সংক্রান্ত যে দু-একটি চিত্র তিনি এ উপন্যাসে ফুটিয়েছেন, সেখানেও তার পরিমিত কাণ্ডজ্ঞান এবং উদার মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

মীর-পরবর্তী মুসলিম ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হকের প্রধান কীর্তি আবদুল্লাহ্ উপন্যাস (১৯৩৩)। চুয়াল্লিশ বছরের কর্মচঞ্চল জীবনে একটিমাত্র উপন্যাস লিখে ইমদাদুল হক বাংলা সাহিত্যে রেখেছেন স্বতন্ত্র প্রতিভার স্বাক্ষর। আবদুল্লাহ্‌ উপন্যাস বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের সময়সীমায় প্রবাহিত মুসলিম জীবনবিশ্বাস এবং জীবনযন্ত্রণার শিল্পিত ভাষ্য। একটি বিশেষ যুগবাস্তবতাকে ধারণ করে রচিত হলেও আবদুল্লাহ্ স্ব-কালের সীমা পেরিয়ে অভিষিক্ত হয়েছেন কালোত্তীর্ণ শিল্পের মর্যাদায়।

আবদুল্লাহ্‌ উপন্যাস পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, ‘আবদুল্লাহ্‌ বইখানি পড়ে আমি খুশি হয়েছিÑবিশেষ কারণ, এই বই থেকে মুসলমানদের ঘরের কথা জানা গেল । এ দেশের সামাজিক আবহাওয়া-ঘটিত একটা কথা এই বই আমাকে ভাবিয়েছে। দেখলুম, ঘোরতর বুদ্ধির অন্ধতা হিন্দুর আচারে হিন্দুকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করেছে, সেই অন্ধতাই ধূতি-চাদর ত্যাগ করে লুঙ্গি ও ফেজ পরে মুসলমানের ঘরে মোল্লার অন্ন জোগাচ্ছে। এ কি মাটির গুণ? এই রোগ-বিষে ভরা বর্বরতার হাওয়া এদেশে আর কতদিন চলবে? আমরা দুপক্ষ থেকে কি বিনাশের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরস্পর পরস্পরকে আঘাত ও অপমান করে চলব? লেখকের লেখনীর উদারতায় বইখানিকে বিশেষ মূল্য দিয়েছে।’

আবদুল্লাহ্ উপন্যাসে ইমদাদুল হক ব্যক্তিচরিত্র নির্মাণ অপেক্ষা সমাজমানসের প্রতি অধিক মনোযোগী ছিলেন। তিনি চেয়েছেন গ্রামবাংলার মুসলমানদের বিশেষ সমাজ ও বিশেষ কালের ছবি আঁকতে। ফলে একটি মহাকাব্যিক পটকে স্পর্শ করেছিলেন তিনি। তবে উপন্যাসটি শেষ করে যেতে পারেননি। ‘আবদুল্লাহ্’র ৩০ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত রচনার পর ইমদাদুল হক ইন্তেকাল করেন। বাকি অংশের জন্য তিনি একটা খসড়া রেখে গিয়েছিলেন। ৩১ থেকে ৪১ পরিচ্ছেদের অংশটুকু রচনা করেন ‘আমাদের দুঃখ’-প্রণেতা সাহিত্যিক আনোয়ারুল কাদির। এই অংশে আনোয়ারুল কাদিরের নিজস্ব ভাষা বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।

বিষাদ-সিন্ধু (১৮৯১) আর আনোয়ারার (১৯১৪) পরে আবদুল্লাহ্ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় উপন্যাস বলা যেতে পারে। এই জনপ্রিয়তার পেছনে ছিল তৎকালীন সমাজচেতনা, যা আবহমান বাংলার সমাজ-সংসারের চিত্র।

নাদিয়া কিলানির প্রথম কবিতার মৌসুম

এক ‘তথৈবচ’ সন্ধ্যা

‘আওয়ামী শাসনে আলেম নিপীড়ন’ বই প্রকাশ

ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রথম আন্দোলন বা শেষ প্রহরের গল্প