হোম > সাহিত্য সাময়িকী > প্রবন্ধ

জনমানুষের বাংলা ও আমাদের লেখনরীতি (২য় পর্ব)

ফয়েজ আলম

দুই. মূলধারার বাংলা ভাষা বা ‘জনমানুষের বাংলা’

আঠারো শতকের শেষাশেষি বাংলাদেশের ভাষা সম্পর্কে যে কথা লেইখা গেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সেইটা একটা জরুরি দলিলের মতো। তিনি সেই কালে চালু তিন প্রকার ভাষার মধ্যে জনমানুষের ভাষারে বলছেন ‘বিষয়ী লোকের বাংলা’। সেইটাতে আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, এমনকি কতকটা ইংরেজি পরিমাণমতো মিইশা ভাষাটারে শক্তিশালী বানাইছিল, সহজে বুঝার মতো করছিল। তার মতে, সেইটা শুনতে মধুর। এই ভাষাই বাংলাদেশের মানুষের আসল ভাষা, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সাধারণের ভাষা। সাধারণ মানুষ কথা বলত এই ভাষায়, লেখত এ ভাষায়, চিঠি চালাচালি করত এ ভাষাতেই। সতর, আঠারো শতকে লেখা চিঠিপত্রে তার নমুনা আছে। তাছাড়া বাংলার যে-জনসাহিত্যকে পুঁথিসাহিত্য, পাঁচালি ইত্যাদি নাম দিয়া দূরে সরায়া রাখা হইছে, সেইগুলাও এই ভাষায় লেখা। প্রবন্ধের এই জায়গা থাইকা আমরা এই ভাষা বুঝাইতে ‘জনমানুষের বা জনসমাজের বাংলা বা ভাষা’ কথাটা ব্যবহার করব। মধ্যযুগের জনসাহিত্যের ভাষাও এইটা।

অবশ্য ধর্মীয় সাহিত্য যেমন মঙ্গলকাব্যগুলার ভাষা একটু সংস্কৃতঘেঁষা। কারণ তার বেশিরভাগই সংস্কৃত থাইকা অনুবাদ করা। তাছাড়া মঙ্গলকাব্যগুলা দেবদেবির স্তুতির জন্য লেখা বইলা সংস্কৃত ভাষার মন্ত্রস্ত্রোতের ছাপ সেইগুলাতে রয়া গেছে।

প্রমথনাথ বিশী সেই সময়ের জনমানুষের ভাষার একটা উদাহরণ দিছেন ড. সুরেন্দ্রনাথ সেনের প্রাচীন বাঙ্গালা পত্র সঙ্কলন থাইকা নিয়া। কলিকাতার মানুষেরা এই চিঠিটা লেখছিল গভর্নর জেনারেল বরাবর। তারার দাবি আছিল, ধনীদের কাছ থাইকা মাথট আদায় কইরা সেই টাকায় বাড়ি বানায়া অসহায় মানুষদের থাকার জায়গা দেয়ার জন্য। সেই চিঠির কয়েক লাইন এইখানে দেই: ‘...আমাদ্দিগের দেসের দস্তরমত যদি সাহেবরা মাথট্টের এক নিয়ম করিয়া দেন, তবে অতিত্বরায় এ জায়গা বানাইবার টাকা মজুত হইতে পারে (।) তাহার নিয়ম এই কোমবেষ লাক টাকা খরচ হইলে বাটী ইহার লওজিমা স্থান তৈয়ার হইবেক (।) ইহার আনেয়োন কোম্পানির ইঙ্গরেজ ও বাঙ্গালি চাকরহায়ের উপর উহাদ্দিগের পায়া কিংবা খেদমত মাফিক এবং সহরের কোম্পানির চাকর সেও পাকা হাবেলিওয়ালা বাসিন্দার উপর এক নিরিখ মকরর করিয়া দেন (।) সরকারের খাচাঞ্চি ও পুলিষ আফিসের দ্বারা এ টাকা আদায় হয় এমত হইলে অতি শীঘ্র টাকা আদায় হইয়া বাটী তৈয়ার হইতে পারে (।) । সহরের গলি ও রাস্তা হইতে এ সকল অক্ষেম গরিব অন্যত্র স্থাপিত হইলে সহরের লোকের অনেক প্রকার আরাম হইবেক।’৮

কেরির কথোপকথন-এর ভাষা, আলারী রীতি, হুতোমী রীতি এবং প্রমথ চৌধুরীর চলিত রীতি বা প্রমিত রীতির সাথে এই লেখার ভাষার পার্থক্য পরিষ্কার। এই ভাষা বংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষার সবচেয়ে কাছাকাছি রূপ।

এইখানে মোট ৯৯টা শব্দ আছে। এর মধ্যে নিচে দাগ দেয়া সতরটি শব্দসহ আরো আটটা শব্দ নিয়া মোট পঁচিশটা শব্দ তথাকথিত প্রমিত বাংলায় বদলায়া গেছে। বাকিগুলা নামশব্দ বা অব্যয় বা সর্বনাম। সেজন্য ঢালাও বদলের পাল্লায় পড়ে নাই। উইলিয়াম কেরির কথোপকথন, আলালী ও হুতোমী রীতিতেও এই পঁচিশটা শব্দের বেশিরভাগ আগে থাইকা অন্যরকম আছিল। তাইলে বুঝা যায়, কলিকাতায় মুখের ভাষার কাছাকাছি লিখিত রূপ প্রবর্তনের যে-চেষ্টা চলতেছিল কথোপকথন থাইকা প্রমিত রীতি পর্যন্ত সেইগুলার সবই নদীয়া-কলিকাতা ও তার আশপাশের অঞ্চলের কথ্যরীতি। এই কথ্যরীতির সাথে সংস্কৃত শব্দ মিশায়া তৈয়ার হইছে প্রমিত বাংলা। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে-ভাষারে ‘বিষয়ীয়লোকের ভাষা বা জনমানুষের ভাষা’ বলছেন, সেইটা কোনোদিন কলিকাতাবাসীর লেখার চেষ্টায় আসে নাই। বরং কেউ জনমানুষের ভাষায় লেখলে সেইগুলারে ‘পুঁথির ভাষা’ ‘মুসলমানি বাঙ্গালা’ বইলা উড়ায়া দেয়া হইছে।

আমরা সতর শতকের শেষ অথবা আঠার শতকের শুরুর নোয়াখালীর কবি আবদুল হাকিম, উনিশ শতকের একেবারে শুরুর দিকের চট্টগ্রামের কবি মুহম্মদ চুহর এবং উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের হাওড়ার কবি মুহাম্মদ দানিশের রচনা থাইকা জনমানুষের মুখের ও লেখার ভাষার একটু কইরা নমুনা দেই। জনমানুষের মুখের ভাষা আর তাদের লেখার ভাষায় বিশেষ পার্থক্য ছিল না—

কবি আবদুল হাকিম শিহাবুদ্দীন-নামা কাব্যে লেখছেন:

আরবী পড়িয়া বুঝ শাস্ত্রের বাখান।

যথেক এলেম মধ্যে আরবী প্রধান॥

আরবী পড়িতে যদি ন পার কদাচিত।

ফারছি পড়িয়া বুঝ পরিণাম হিত॥

ফারছি পড়িতে যদি না পার কিঞ্চিৎ।

নিজ দেশী ভাষে শাস্ত্র পড়িতে উচিত॥৯

চট্টগ্রামের কবি মুহম্মদ চুহর আজরশাহ ছমনরোখ-এ পৃষ্ঠপোষক জাফর আলী সম্পর্কে লেখেন—

চাটিগ্রাম ঢাকা আদি ভ্রমি নানা স্থান।

কলিকাত্তা টাকসালে লেখাইল নাম।

ভাগ্যবলে কোম্পানির উকিল হইয়া।

পুনরুপি চাটিগ্রামে আইল পালটায়া॥১০

সবশেষে হাওড়ার কবি মুহাম্মদ দানিশের চাহার দরবেশ কাব্য থাইকা—

চলিত বাঙ্গালায় কেচ্ছা করিনু তৈয়ার।

সকলে বুঝিবে ভাই কারণে ইহার॥

আসল বাঙ্গালা সবে বুঝিতে না পারে।

এ খাতেরে না লিখিলাম শোন বেরাদরে॥১১

সময়ের হিসাবে দেড়শ বছরের তফাত এবং বাংলাদেশের দূরের দূরের তিনটা অঞ্চলের তিনজন কবির লেখা তুলনা করলে দেখা যায় তিনজনের ভাষাই এক। এর থাইকা প্রমাণ হয়, বাংলাদেশে একটা সর্বাঞ্চলীয় সাধারণ কথ্য ভাষা আছিল। আবার এই ভাষার সাথে প্রমথনাথ বিশীর চিঠির ‘বিষয়ীলোকের ভাষা’ বা ‘জনমানুষের ভাষা’র মিল অনেক। দেখা যাইতেছে সংস্কৃত ব্যবসায়ীদের ভাষাকে লেখার ভাষারূপে চালু করলেও জনমানুষের বাংলা ভাষা এই দেশের মানুষের মুখের ভাষা হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই চলতেছিল।

কুড়ি শতকের শুরুর দুই দশকে প্রমথ চৌধুরী নদীয়ার উপভাষার রীতিকে লেখায় নিয়ে আসেন। একসময় তা লেখ্য ভাষা হিসাবে চালু হয়ে যায়। অন্যদিকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কথিত বিষয়ীলোকের ভাষা অর্থাৎ জনমানুষের ভাষার ধারাটা আগের মতোই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাধারণ মুখে মুখে চলতে থাকে। যুগের সাথে এই ভাষা টুকটাক বদলাইছে, দরকারে বিদেশি শব্দ, ঢঙ নিছে। এই ভাষাই কালের ও পরিবেশের দরকারে বিকশিত হয়া আজকের বাংলাদেশের ‘জনমানুষের বাংলা’ হিসাবে মুখের বুলি রূপে চালু আছে।

এইবার হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সাধারণ বিষয়ীলোকের ভাষার প্রসঙ্গে আসি। উদ্ধৃতির ৯৯টা শব্দের মধ্যে ২৫-৩০টি শব্দ এখন পর্যন্ত বদলাইছে। এর মধ্যে নিচে টান দেয়া ১৭টা শব্দ এবং এই জাতের অন্য শব্দের বদলটা দেখি আমরা—

* ‘করিয়া’, ‘রাখিয়া’, ‘ধরিয়া’, ‘মারিয়া’ ধরনের ক্রিয়াপদের বদল অপিনিহিতির নিয়মে নদীয়া-কলিকাতার ভাষায় একরকম আর বাংলাদেশের মুখের ভাষায়, অর্থাৎ জনমানুষের ভাষায় আরেকরকমভাবে হইছে। ব্যঞ্জনের পরের ই-কার অপিনিহিতির স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের কথ্যবাংলায় লাগোয়া ব্যঞ্জনের আগে বইসা এইরকম হইছে—কইরা, রাইখ্যা/রাইখা, ধইরা, মাইরা। কিন্তু নদীয়া-কলিকাতার ভাষায় এই বদলটা হইছে একটু আজগুবি ধরনের এবং অনেক বেশি—যেমন, করে, রেখে, ধরে, মেরে এই রকম। নদীয়া-কলিকাতার ভাষায় তথা প্রমিত বাংলায় এই জাতীয় প্রত্যেকটা ক্রিয়াপদ একইভাবে বদলাইছে।

* রাতি শব্দের বদলটা (বাংলাদেশের জনমানুষের ভাষায় রাইত, রাইতের বেলা, কলিকাতায়- রেতের বেলা) চোখে পড়ার মতো। আবার পিঠালি, নগরিয়া, শহরিয়া জাতীয় শব্দ বাংলাদেশে হইছে পিঠালি, নগইরা, শহইরা; কলিকাতার ভাষায় হইছে পিঠুলি, নগুরে, শহুরে ইত্যাদি। এইসব নাম শব্দের বিশেষণ নির্মাণের সময় দেখা যায়, নদীয়া-কলিকাতার ভাষায় ‘ো’ কার বা ‘ু’ কার লাগানোর ঝোঁক। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী বাংলাদেশের জনমানুষের বাংলা ভাষার বদলটাই সঠিক।

* বাংলাদেশের জনমানুষের ভাষায় দুই ব্যঞ্জনের মাঝখানের ‘র’ বহাল আছে। এইখানে খুব বেশি চাপ দিতে হয় না বইলা বদলায় নাই। কিন্ত নদীয়া-কলিকাতার আঞ্চলিক রীতিতে ক্রিয়াপদে দুই ব্যঞ্জনের মাঝখানের ‘র’ পরের ব্যঞ্জনের রূপ ধরছে। যেমন করলাম হইছে কল্লাম-কল্লেম; করছি হইছে কচ্ছি, করিতে কত্তে, ইত্যাদি।

নদীয়া-কলিকাতার উপভাষা, অর্থাৎ প্রমিত বাংলা আর বাংলাদেশের জনমানুষের মুখের ভাষার সব দিক নিয়া আলোচনা করার সুযোগ এইখানে নাই। আমি অল্প কয়টা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বললাম যাতে বুঝা যায় যে, সতর-আঠার-উনিশ শতকের বিষয়ীলোকের ভাষাই ছিল মূলধারার বাংলা ভাষা বা জনমানুষের ভাষা। সেই ভাষা স্বাভাবিক নিয়মে আইসা আজকের বাংলাদেশের জনমানুষের ভাষা হিসাবে সাধারণের মুখে মুখে চলতেছে । আর একই সময়ে নদীয়া-কলিকাতা অঞ্চলে এই ভাষা বেশ খানিকটা বদলায়া এমনকি বিকৃত উচ্চারণ নিয়া পরিণত হইছে একটি উপভাষায়, যেটা থাইকা চালু করা হইছে প্রমিত বাংলা।

আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইল নদীয়া-কলিকাতার ভাষা প্রভাবশালী হয়ে ওঠায় তার চাপে ভারতের অন্যান্য বাংলাভাষী অঞ্চলগুলার মুখের ভাষাও কতকটা বদলায়া গেছে।

যে স্বপ্ন ছফাকে ঘুমোতে দেয়নি

বই কীভাবে বিপ্লবকে প্রভাবিত করে?

কবিরা যা বলেন

৭০ বছর পূর্তি: বাংলা একাডেমির ভবিষ্যৎ

উপন্যাস : অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ

৩৬ জুলাই: ঐতিহ্যবাদী বিপ্লব ও বাঙালি মুসলিম ফিউচারিটি (১ম পর্ব)

লেইস ফিতা ও জাদুর বাক্স

হুমায়ূন আহমেদ ও বাংলা কথাসাহিত্যের ঘরে ফেরা (শেষ পর্ব)

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, সীমান্ত ও আজকের লড়াই

দুর্লভ লেখা: ইকবালের ইতিহাস-দর্শন