যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে, তখন রওশন আরা মুক্তা লিখেছেন ‘গোল্ডফিশের কান্না’ নামে একটি অনন্য ও অসাধারণ কবিতা। রচনাকাল ২৪ জুলাই ২০২৪। ১৫ জুলাই আবু সাঈদসহ ছয়জনের মৃত্যুর এবং আরো অনেকের আহত হওয়ার ঘটনা বন্ধ হয়নি; বরং দিনে দিনে তার মাত্রা বেড়েছে, হতাহতের সংখ্যাও বেড়েছে। ১৯ জুলাই বিক্ষুব্ধ জনতা রামপুরা টেলিভিশন কেন্দ্র, মিরপুরের বিআরটিএ অফিস, মহাখালির ডেটা সেন্টার ও সড়কসেতু ভবন, উত্তরার ও মিরপুরের দুটি মেট্রোরেল স্টেশন প্রভৃতি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংঘর্ষে কতক পুলিশও হতাহত হন। প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে গিয়ে আহতদের খোঁজখবর নেন এবং মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শন করেন। নবনির্মিত মেট্রোরেল স্টেশনে ভাঙচুরের অবস্থা দেখে তিনি অশ্রুরোধ করতে পারেননি; সঙ্গীরাও কেঁদেছিলেন। মানুষের হতাহতের বিবরণ না দিয়ে যখন সরকার-নিয়ন্ত্রিত প্রচারযন্ত্রে মেট্রোরেল ও ডেটা সেন্টারের ক্ষয়ক্ষতির কথা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছিল, তখন রওশন আরা মুক্তা ‘২৪ জুলাই’ কবিতাটি লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেছিলেন।
‘মাছের মার শোক’ বলে একটি বাগ্ধারা প্রচলিত আছে, যার অর্থ ‘নিরর্থক দুঃখ প্রকাশ’। ‘ক্রোকোডাইল টিয়ার্স’ বা কুমিরের কান্না বলে ইংরেজি বাগ্ধারা আছে। এরই নগর সংস্করণ ‘গোল্ডফিশের কান্না’ হতে পারে। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় কবিতার শিরোনামটি অতি চমকপ্রদ হয়েছে। কবির বিষয় নির্বাচন ও বাচনভঙ্গি খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ; উপযুক্ত ও অনির্বচনীয়। সাহিত্যের একটা নতুন ভাষা, নতুন বাগ্ভঙ্গি তৈরি হয়েছে। প্রতীক-উপমায় কবিগণ তাদের প্রতিবাদের কথা নিঃসংকোচে বলছেন। তারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষোভ-শঙ্কা-সাহস-দ্রোহের কথা অবলীলায় বলছেন, ভেঙে ফেলছেন সব অচলায়তন বাধাবিপত্তি, তুলে ধরছেন নতুন সম্ভাবনার উন্মেষের কথা—
একটা বিল্ডিংয়ের মূল্য
তোমার ছেলের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি।
একটা ওভারব্রিজের দাম
তোমার হাজার ছেলের লাশ দিয়েও কি চুকাতে পারবে?
একটা মেট্রোস্টেশন গর্ভে ধরতে পারবে তুমি?…
একটা বিল্ডিংয়ের মূল্য
তোমার রক্ত-মাংসের সন্তানের চেয়ে
আসলেই অনেক বেশি।…
চুমু খেয়ে ওই ইট-সিমেন্টের শরীরে
গাড়িগুলোকে শুইয়ে দিও হাত বুলিয়ে
পদ্মা সেতুটাকে পাঠিও ভার্সিটিতে,
পাবলিকে না হয় প্রাইভেটে
আর রাতে ঘরে ফেরার অপেক্ষা করো
প্রিয় ওভারব্রিজটার, আর স্টেশনটার। …
ভুলে যেও, তুচ্ছ নগণ্য ওই মনুষ্য সন্তান
কখনো তোমাকে মা ডেকেছিল
তোমার ঘরে এখন বিটিভি,
তোমার বিছানায় এক্সপ্রেসওয়ে
তোমার আঁচল ধরে আছে মেট্রোরেল
আর কী চাই তোমার?
যাও চুমু খেয়ে নাও ভবনটাকে, চেয়ারটাকে, হেলিকপ্টারটাকে!
তারপর ঘুমিয়ে যাও
সকালে আবার তোমার বিল্ডিংগুলোর ক্লাস আছে।
উদ্ধৃতি দীর্ঘ হলো কবির ক্ষোভ-বিদ্রুপ-পরিহাসের মাত্রাটা বোঝার ও বোঝানোর জন্য। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা তখনো ক্ষমতাসীন; তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এরূপ সাহসোক্তি দ্বিতীয় মেলা ভার। প্রতিটি বাক্যই যেন একেকটি কশাঘাত! আমাদের বিশ্বাস, জুলাই গণআন্দোলন মানুষকে এমনই দুঃসাহসী ও সত্যভাষী করে তুলেছিল।
কবিতার অভিনব নামকরণের উৎস কী? ‘ফাইন্ডিং নেমো’ নামে একটি শিশুতোষ মুভি কার্টুন দেখেছি, যেখানে গোল্ডফিশের প্রকারভেদ ‘ক্লাউনফিশে’র বাবা ও ছেলের রূপকথার চিত্রায়ণ রয়েছে। বাবার নাম ‘মার্লিন’, ছেলের নাম ‘নেমো’। উভয়ের গায়ের রঙ সোনালি। সমুদ্রের বুকে আপন বাসভূমিতে তারা নিরাপদে ছিল। একদিন ছেলে পানির উপরস্তরে উঠে গেলে ডুবুরির জালে ধরা পড়ে এবং এক ডেন্টিস্টের ট্যাংকে বন্দি হয়। বাবা ছেলেকে না দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং ‘ডরি’ নামে একটি দরদি গাঢ় নীল রঙের রিফমাছ ও সমুদ্রপাখি সিগালের সাহায্যে নানা বাধা অতিক্রম করে ছেলেকে উদ্ধার করে।
আমার ধারণা হয়, এটি কবিতার নামকরণের উৎস হতে পারে। কিন্তু তা ঠিক নয়। কবির সঙ্গে আলাপ করে জানলাম কবিতার নামকরণে ‘গোল্ডফিশ মেমোরি’র কথা। তিনি বলেন, ‘মধ্যবিত্তের মন তো আসলে গোল্ডফিশ। এই কাঁদছি, কালই হয়তো ভুলে যাব। আমার মেমোরিকে দখল করেই তো শাসন করা যাচ্ছে আমাকে! কবিতার নাম লিখলাম গোল্ডফিশের কান্না। ...এখনো অবিশ্বাস্য লাগে, এমন দিন কেটেছে আমাদের! ইন্টারনেট বন্ধ করে কী নির্বিচারে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, আর কী নির্লজ্জভাবে কিছু পোড়া বিল্ডিং দেখিয়ে সত্য লুকানোর চেষ্টা করেছিল কিছু মানুষ! আমাদের গোল্ডফিশের মেমোরিতে জানি না কতদিন থাকবে এই শহীদদের আত্মত্যাগের কথা, যাদের পবিত্র শরীরের ভগ্নাংশে ফুলে-ফলে পরিপূর্ণ হয় এই পৃথিবী।’
একশ্রেণির গবেষকের ধারণা—গোল্ডফিশের মেমোরি খুবই ‘শর্ট’; অন্যরা দীর্ঘ মেমোরির পক্ষে রায় দেন। মুভির গল্পে ‘শর্ট মেমোরি’র কথা আছে। সে সূত্রে গোল্ডফিশের কান্না মূলত কবির কান্না।
একই ই-মেইলসূত্রে কবি কবিতার জন্মেতিহাস সম্বন্ধে আমাকে যে তথ্য প্রদান করেন, প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে তা উল্লেখ করা হলো—‘ইন্টারনেট বন্ধ ছিল, আর টিভিতে নেই কেব্ল-কানেকশন। দিনলিপি লিখে রাখছিলাম, যেন পরে মনে থাকে সব। ...আমরা ধীরগতির ইন্টারনেট পেলাম ২৪ তারিখে, তবে ফেসবুক বন্ধ। এর মধ্যেই রটে গেছে দেশের ধ্বংসযজ্ঞের খবর। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো শুধু পোড়া বিল্ডিং দেখাচ্ছে। আর বিদেশি চ্যানেলে এসেছে শতাধিক মৃত্যুর খবর। অদ্ভুত একটা ডিলেমা তখন—মানুষ মৃতের পক্ষে যাবে, নাকি বিল্ডিংয়ের? ...রাতে বিছানায় শুই, ছটফট করি, আবার উঠে এ-ঘর ও-ঘর হাঁটি। দুটা লাইন লিখি—ভাবি কী দরকার লেখার? আমি ছাপোষা মহিলা মানুষ, এসব লেখা আমাকে মানায় না। লেখা বন্ধ রাখি। আবার কীভাবে যেন চার লাইন লিখে ফেলি। তারপর ভাবি, আরে লিখলে কী হবে, আমি তো আর যা-ই হোক, এই লেখা পাবলিশ করতে যাচ্ছি না। তাহলে লিখেই ফেলি। মোবাইলের নোটসে কবিতাটা লেখা শেষ করি। ততক্ষণে সকাল। ...কবিতার নাম লিখলাম ‘গোল্ডফিশের কান্না’। কী আর হবে, খুব বেশি হলে ধরে নিয়ে যাবে? কিছু না বলে রাস্তায় গুলি খেয়ে মরার চেয়ে কিছু বলে মরে যাওয়া ভালো। ফেসবুকে পোস্ট করে দিলাম কবিতাটা।’
কবিতাটি নিয়ে কথা বললাম, কারণ এর কম্পোজিশন শব্দসম্ভার বাগ্ভঙ্গি রূপকল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর প্রেক্ষাপট জানা না থাকলে মনে হবে—উদ্ভট চিন্তা! উদ্ভট বাক্যবিলাস! কিন্তু তা নয়। কবিতাটির কথাচিত্র অনন্য ও অচিন্তনীয়, অর্থদ্যোতনা অসীম ও অসামান্য।
রফিক আজাদ একটি কবিতা লিখেছিলেন—‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো।’ ১৯৭৪ সাল, দেশে আকাল চলছে, চারদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। কবি সেকালের জনমানুষের প্রচণ্ড ক্ষুধা অন্তরে ধারণ করে লেখেন—
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাব : গাছপালা নদীনালা
গ্রামগঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।
সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন—
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
(হে মহাজীবন, ছাড়পত্র)
ছাড়পত্রের কবিতাগুলো ১৯৪৩-৪৭ সালের মধ্যে রচিত হয়; ১৯৪৪-৪৫ সালে অখণ্ড বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ কবি প্রত্যক্ষ করেন। তাই এখানেও ক্ষুধা, জঠরজ্বালা ও অন্নের জন্য হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে। কবির প্রচণ্ড আবেগ, ক্ষোভ ও দ্রোহচেতনা থেকে এরূপ কবিতার উদ্ভব হয়। কালেভদ্রে এমন সৃষ্টির দেখা মেলে। আর এই অর্থে আমি ‘গোল্ডফিশের কান্না’কে একটি অনন্য ও অচিন্তনীয় কবিতা বলে মনে করি।