ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যেতে পারত; কিন্তু মিটল না। কপালে দুর্গতি থাকলে যা হয়। আমার বিভীষণপন্থি মা ঠিক সেই সময় চা-বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। উমায়েরের হাতে ধোঁয়া ওঠা কাপটা দেওয়ার আগ মুহূর্তেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল—‘আফরোজা... মানে, আমার...’
মা হাঁইমাই করে উঠলেন, ‘কী সব উল্টোপাল্টা বলছিস তুই? তোর নাম তো পুসন, আফরোজা বলছিস কেন? আফরোজা কে?’
উমায়ের কিছু বোঝে না, মা কিছু মানে না, আর আমি বুঝেও বোঝাই না। ঘরের ভেতর তখন নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা অস্বস্তির টান। চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে, আর আমি বসে আছি এক গাদা জবাব ছাড়াই।
উমায়েরের সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছে সাত মাস। প্রেম করে না, পরিবার দেখে দিয়েছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন, এখন একটা ইংরেজি কোচিং সেন্টারে পড়াই। উমায়ের একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে, শর্টস পরে ঘুমায়, খবরের কাগজের পাতা উল্টে শুধু হেডলাইন দেখে আর ইউটিউবে গ্যাজেট রিভিউ দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ভালো মানুষ, সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ভালো মানুষটার সঙ্গে আমার কোথাও যেন সংযোগ খুঁজে পাই না। আর এই ডিসকানেক্ট-এর মাঝে হঠাৎ করে যে নামটা আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল—‘আফরোজা’, সেটা ছিল আমার পুরোনো একটা পরিচয়।
আফরোজা ছিলাম আমি—সাত বছর আগে। না, আমি কোনো এজেন্ট বা স্পাই নই। আমার নামটা বদলায়নি সরকারি কাগজে, বদলেছে শুধু বাস্তবে। আফরোজা নামটা আমি নিজেই ফেলে এসেছি রংপুরে। বাড়িটা, বাবার মুখটা, স্কুলের সেই সাইকেল, কলেজ আর একটা ছেলেকে। সবকিছু রেখে এসেছি। সে ছেলের নাম ছিল রাশেদ।
রাশেদ আমার ক্লাস এইটের সহপাঠী ছিল। প্রথম যে ছেলে আমার খাতা দেখে বলেছিল, ‘তুই কবিতা লেখিস?’
আমি হেসে বলেছিলাম, ‘না রে, আমি তো মুখস্থ করেই লিখি।’
সে বলেছিল, ‘মুখস্থ করেও যদি এমন করে লিখতে পারিস, তাহলে তুই কবি।’
তখন বুঝিনি, ছেলেটা আমার সবচেয়ে বড় পাঠক হতে চলেছে। সবচেয়ে নিবিড়। আর আমি... আমি হয়তো তার সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক।
বাবা হঠাৎ স্ট্রোক করে চলে গেলে, মা আমায় নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। নতুন শহর, নতুন স্কুল, নতুন জীবন।
‘আফরোজা’ হয়ে ওঠে এক ধরনের বোঝা। ঢাকায় এসে নিজের নতুন নামে পরিচিত হই—‘পুসন’। ‘আফরোজা’কে রেখে আসি কড়াইপুকুর স্কুলের মাঠে। রাশেদ একবার এসেছিল খুঁজতে। সেবার ক্লাস টেনের বোর্ড পরীক্ষা দিচ্ছি। সে বলেছিল, ‘চিঠি লিখেছিলাম, পেয়েছিলি?’
আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, ‘না, কিছু পাইনি।’
সে বলেছিল, ‘তুই ভুল করিস না, ফিরে আয়।’
আমি বলেছিলাম, ‘আমি এখন পুসন।’
সে কেঁপে গিয়েছিল। তারপর চলে গিয়েছিল। আর আজ এত এতগুলো বছর পর, হঠাৎই সেই নাম ফেরত এলো আমার মুখে—উমায়েরের সামনে, মায়ের সামনে। কেন এলো? আমি নিজেই জানি না। অথবা, হয়তো জানি।
দুপুরবেলা মা ঘরের দরজা ভেজিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুই ঠিক আছিস তো, পুসন?’
আমি মাথা নাড়ি। মা একটু থেমে বলেন, ‘ও ছেলে তোকে ভালোবাসে। উমায়ের খারাপ নয়।’
আমি বলি, ‘জানি, মা।’
মা একটু ভেবে বলেন, ‘তোর মুখে হঠাৎ আফরোজা নামটা এলো কেন?’
আমি কোনো উত্তর দিই না।
রাতে ঘুম আসেনি। পুরোনো ফেসবুক আইডিতে ঢুকলাম। অনেক খুঁজে খুঁজে বের করলাম এক পুরোনো ছবি—আমার আর রাশেদের। একটা স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে তোলা। ছবিটা এত ঝাপসা, তার মধ্যেও আমার চোখ আটকে রইল তার মুখে। তারপর সাহস করে সার্চ দিলাম—‘Md Rashedul Hasan, Rangpur’। তিনটা প্রোফাইল পেলাম। তিন নম্বরটায় ঢুকে বুকের ভেতরটা থেমে গেল। প্রোফাইল পিকচারে একটা ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। ছবির ক্যাপশন ‘My life.’
পরদিন সকালবেলা, উমায়ের টেবিলে চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, ‘কাল রাতে তুমি বলছিলে ‘আফরোজা’—কিছু বলবে আমাকে?’
আমি একটু থেমে বলি, ‘বলব, কিন্তু আজ নয়।’
উমায়ের কিছু জিজ্ঞেস করে না। আমিও কিছু চাপাই না। এক সপ্তাহ পর আমি একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে রাখি উমায়েরের বইয়ের ভেতরে— ‘আমার জীবনের একটা পাতা ভুল করে উল্টো পড়েছিলাম। এখন ঠিক পাতায় ফিরেছি। তুমি যদি চাও, আমি এই নামেই থেকে যেতে চাই—পুসন হয়ে, আফরোজা নয়। তুমি কী চাও?’
উমায়ের চিরকুটটা পেয়ে ফোন করে না। তারপর রাতে ফিরে এসে আমার পাশে বসে শুধু বলে, ‘তোমার আজকের কবিতাটা ভালো লেগেছে। তুমি আগে লিখতে?’
আমি চমকে বলি, ‘তুমি পড়েছ?’
সে হেসে বলে, ‘তোমার সবকিছু পড়তে চাই। পুসন হোক, আফরোজা হোক—তুমি তো তুমিই।’
আমি জানি, এবার আমি ঠিক জায়গায় আছি।
২
আজ শুক্রবার। উমায়ের ঘুম থেকে উঠেছে দেরিতে। আমি কিচেনে। চুলার ওপাশে মা। মা আচমকা বলেন, ‘তুই আবার কবিতা লিখিস নাকি? তোর ঘরে একটা খাতা দেখলাম... হাতের লেখা তো তোরই।’
আমি চমকে যাই। না, মিথ্যে বললাম—চমকে যাইনি, ধরা পড়ার ভয় হয়।
মা চলে গেলে ধীরে ধীরে ঘরে যাই। সেই খাতা, যেখানে মাঝরাতে লিখি—রাশেদের কথা নয়, লিখি নিজেকে ফিরে পাওয়ার কথা। সেই খাতাটা খুঁজি। মেলাই। শেষ পাতায় লেখা— ‘কেউ যদি একবার চোখে চোখ রাখে, নামটা না জেনেও অনেক কিছু জেনে ফেলে।’
বিকেলবেলা উমায়ের বলে, ‘আজ বেড়াতে যাবে?’
আমি বলি, ‘আজ না, মাথা ধরে আছে।’
সে একটু ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এইটা গত তিন সপ্তাহ ধরে শুনছি। সব ঠিক আছে তো?’
আমি ঠোঁটে হালকা হাসি এনে বলি, ‘সবই ঠিক। শুধু নিজের ভেতরের গোলমালটা বুঝতে পারছি না।’
উমায়ের কিছু বলে না। চুপ করে চোখ সরিয়ে নেয়। আমরা পাশাপাশি বসে আছি, অথচ ঠিক পাশে নেই।
রাত ১১টা। ঘর অন্ধকার। হঠাৎ মোবাইল হাতে নিই। সাহস করে ফেসবুক প্রোফাইলের মেসেঞ্জারে ক্লিক করি—Md Rashedul Hasan। কিছুক্ষণ দেখি তার প্রোফাইল পিকচার। তার কোলের ছোট মেয়েটার চোখ অনেকটা রাশেদের মতোই। নতুন করে টাইপ করি— ‘রাশেদ, আমি ঠিক করে বলতে পারিনি তখন। আমি পালিয়ে আসিনি, শুধু নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আজ মনে হচ্ছে, আমি নিজেকেই ফেলে এসেছিলাম তোমার সঙ্গে।’
খুব ধীরে করে ‘সেন্ড’ বাটনে হাত যায়; কিন্তু ঠিক তখনই নিচে লেখা ভেসে ওঠে— ‘You can’t message this person anymore.’ তার মানে ব্লক নয়, হয়তো ডিলিট করে দিয়েছে একসময়। আমি চুপ করে মোবাইল রেখে দিই।
ভোরে উঠে বারান্দায় বসে থাকি। উমায়ের উঠে এসে পাশেই দাঁড়ায়। সে বলে, ‘তুমি জানো, আমি একটা সময় ভেবেছিলাম, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না?’
আমি তাকাই না; বলি, ‘ভেবেছিলে? এখন আর ভাব না?’
সে ধীরে উত্তর দেয়, ‘না, এখন জানি তুমি কেবল নিজেকে ভালোবাসতে শিখছ। আমি তোমাকে সেই সময়টা দিতে চাই।’
আমি নিঃশব্দে তাকাই তার দিকে। এতদিন পরে, প্রথমবার, উমায়েরের চোখে একটু নিজেকে দেখি।
আমার পুরোনো কবিতার খাতা থেকে কয়েকটি কবিতা তুলে পাঠিয়ে দিই এক ছোট ম্যাগাজিনে। পরের সপ্তাহে ইমেইলে একটা মেল পাই— ‘আপনার কবিতা আমরা পরের সংখ্যায় ছাপাতে চাই। লেখক নামে কী দেব?’
আমি কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিই— ‘আফরোজা পুসন।’ দুই নাম, একসঙ্গে। পুরোনো আমি আর বর্তমান আমি—একসঙ্গে হাঁটে এবার।
রাশেদ নেই। আর আসবেও না। উমায়ের আছেন—শুধু স্বামী নয়, একজন ধৈর্যবান শ্রোতা হয়ে। আর আমি, আমি এখন আয়না খুঁজি না, আয়নায় দাঁড়িয়ে থাকি।