এথেনাকে প্রথম দেখেছিলাম বড় অদ্ভুত সময়ে। সারা দিনের রোদ শেষে মিঠেল হাওয়ার অপরাহ্ণে। আমাদের ছোট্ট পুরোনো বাড়ির উত্তর পাশে বিহারি পট্টি। সেখানে সিরাজগঞ্জের একজন ডেভেলপার দশতলা ফ্ল্যাট অ্যান্ড কমার্শিয়াল সেন্টার নির্মাণ করছে। তখন ফোর্থ ফ্লোর পর্যন্ত ফিনিশিং হয়ে বিল্ডিং উঠেছে আরো দুতলা।
সকাল-বিকাল ডজন ডজন মোটরসাইকেল গলিতে আসা-যাওয়া করে। তেমনই একটি বাইকের ব্যাকসিটে বসেছিল সে। আমি চমকে উঠেছিলাম। ফারিয়া আবার কোথা থেকে এলো? আমার দৃষ্টিতে কী ছিল জানা নেই, একেবারে চোখের ওপর চোখ। সেই সংযোগ থেকে গেল কয়েক মুহূর্ত। মোটরবাইক থেমে গেলে নেমে দাঁড়াল সে। আবার চোখের ওপর চোখ। কী কথা তাহার সাথে? কে জানে সহস্র বছরের পরিচয়। বাইকের মধ্যখানে চার-সাড়ে চার বছরের ছেলে। তারপর পুরুষ মানুষটি। তার গায়ের রঙ কালো। বেশ গাট্টাগোট্টা। সম্ভবত অন্য জেলার এবং জিমে যাওয়া-আসা করা মানুষ।
তিন-চার দিনের মাথায় গলিতে মুখোমুখি হলাম। তখন সকাল। সেন্ট যোসেফস্ কিন্ডারগার্টেনে ছাত্রছাত্রী আসে। সকাল ৮টায় ক্লাস। আমরা থমকে দাঁড়ালাম।
‘হ্যালো, ভালো আছেন?’
‘জি। আপনি?’
‘আপনার বাসা কোথায়? কোথাও দেখেছি মনে হয়।’
‘ছোট শহর। দেখা হতেই পারে। আমার বাড়ি বালুবাড়ি।’
‘ফ্ল্যাট নিয়েছেন? কোন ফ্লোর?’
‘থার্ড ফ্লোর। আপনার প্রতিবেশী।’
‘ওয়েলকাম।’
এথেনা এরপর চলে গেল। আমি অপস্রিয়মাণ তাকিয়ে থাকলাম। সে সিঁড়িতে পা রেখে ঘুরে তাকাল। এমনভাবে নিশ্চুপ হেসে উঠল, আমার হারিয়ে যাওয়া দিনকাল আকস্মিক নেমে এলো বুঝি। তখনো তার নাম জানি না। আমি একটি নাম দিলাম। এথেনা। গ্রিক মিথলজির দুর্দান্ত এক চরিত্র। তার জন্ম হয়েছিল মেটিসের গর্ভে। ছিলেন জিউসের অগ্রজা। মেটিস অনেক বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ। জিউস তার বোনের প্রেমে পড়ে যান। মেটিস সেটি বুঝতে পেরে নানা কৌশলে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। তারই কন্যা এথেনা। তার আশ্চর্যজনক জন্মঘটনা গ্রিক দেব-দেবীরা আগে কখনো দেখেননি। তারা এথেনাকে সম্ভ্রমের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান। এথেনা ছিলেন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিত্ব সচেতন সৃজনশীল অপ্সরী।
এই এথেনাও কি তেমন ম্যাসকুলিন আচরণের ফিমেল কিনা কে জানে, তবে তখন কেন জানি এই নামটি মনে এসেছিল। উজ্জ্বল ফরসা স্লিম দীর্ঘাঙ্গি আর চোখের মধ্যে অদ্ভুত জাদুমায়া কোন অংশে অপ্সরীর চেয়ে কম? কোনো জড়তা নেই, কপটতা নেই, ব্যক্তিত্বময় আত্মবিশ্বাস; মন কেমন কেমন করে। আমার তখন অন্য একজনকে খুব মনে পড়ছিল। এই কথাটি পরেরবার সাক্ষাতে বলেছিলাম। সেদিন রোববার, ক্যাথলিক শিক্ষিকাদের চার্চে প্রার্থনা আছে; স্কুল দেরিতে শুরু হয়। আমি সম্ভবত কোনো কাজে বেরিয়েছি। মোবাইল রিচার্জ। গলির মধ্যখানে দেখা হয়ে গেল। এথেনা জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছেন? কোথায় যাচ্ছেন?’
‘এই একটু রিচার্জের দোকানে। আপনি বাবুকে স্কুলে দিয়ে এলেন?’
‘হ্যাঁ।’
আমরা দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ফ্ল্যাটের কাজের জন্য মিস্ত্রি-শ্রমিক দল বেঁধে আসছে। গলিতে ভিড় বাড়ে। আমার সে-সবে মনোযোগ নেই। তখন আরো একবার তার কথা মনে পড়ে যেতে লাগল।
‘আপনার সাথে আমার পরিচিত একজনের খুব মিল দেখি।’
‘তাই? যেমন?’
‘আমার ইউনিভার্সিটি পড়ার সময়কার একজন বন্ধুর। আপনার সাথে অদ্ভুত মিল। চেহারায় এমন মিল সত্যি বিরল। একেবারে টুইন মনে হয়।’
‘সত্যি নাকি? তার বাড়ি কোথায়?’
‘সে রাজশাহীর মেয়ে। ফারিয়া আকতার।’
‘তাই। এখনো যোগাযোগ রাখেন?’
‘যোগাযোগ নেই।’
‘আচ্ছা আসি।’
এথেনা চলে গেল। তার নাম জানা হলো না। মোবাইল রিচার্জ করতে গিয়ে নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগল আমার। একেবারে গায়েপড়া আচরণ করছি কেন? একজন বিবাহিতা মহিলা, চার-সাড়ে চার বছরের ছেলে আছে, তার স্বামী পালোয়ান টাইপের ওয়ালি খান; আমি এভাবে কথা বলি কেন? এর ব্যাখ্যা কী? ওয়ালি খান নামটি এলো কেন? মাসুদ রানা সিরিজের তিন নম্বর বই ‘স্বর্ণমৃগ’। সেই গল্পের ভিলেন ওয়ালি খান। এথেনার হাজব্যান্ড কি ভিলেন? তার সঙ্গে তো একটি কথাও হয়নি। একজন ভদ্রলোক সম্পর্কে এমন কল্পনা কেন করছি? বিষয়টি জটিল উপপাদ্যের মতো বিভিন্ন রেখা টেনে আজগুবি জ্যামিতি করে গেল। কোনো রেখাই সংযোগ খুঁজে পায় না। সম্ভবত এথেনার চেহারা, তার চোখ আর দৃষ্টিতে অচেনা কিছু রয়েছে, যার আকর্ষণ পতঙ্গ মন এড়াতে পারে না। এথেনার রয়েছে আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্যের দুর্মর আকর্ষণ।
একদিন ছাদে উঠলাম। কখনো ওঠা হয়। সেদিন আবছায়া আলোর সঙ্গে হালকা বাতাস। আকাশে দুটো ঘুড়ি উড়ছে। হলুদ আর লাল রঙের খেলা। আমি তাকিয়ে আছি। রেলিংয়ের সারি বেঁধে কয়েকটি ফুলের গাছ। ওয়াটার ট্যাংক থেকে জল নিয়ে টবে ছড়িয়ে দিই। উত্তরে তাকিয়ে দেখি, এথেনা ঘুড়ির কাটাকাটি দেখছে। একসময় ঘুড়ি ওড়াতাম। তখন স্কুলে পড়ি। স্কুল থেকে ফিরে ঘুড়ি আর নাটাই নিয়ে ছাদে উঠি। একদিন দুপুরের শেষে ছাদ থেকে আচমকা পড়ে গেলাম। অজ্ঞান। কতক্ষণ জানা নেই। তারপর চোখ মেলে দেখি, কয়েকজন আশপাশ ঘিরে রেখেছে। মা-মামা-নানি আর একজন। সেই একজনের চোখে বিষাদ কৌতুকের সম্মিলিত জাদুমায়া। আমি অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলাম।
কয়েক সপ্তাহ পর নাটাই-ঘুড়ি নিয়ে আবার ছাদে উঠি। মন পবনের নায়ে ভেসে ঘুড়ি উড়ে যায় দূর থেকে দূরে। আকাশের শেষ সীমানায়। তারপর কোন সময় ছেড়ে দিলাম মনে নেই।
সেদিন বিকালে আবার আসে সে। চোখে অন্যরকম ভাষা। আমার মন ঘুড়ি হয়ে আকাশে ভেসে যায়। নীল-লাল-রঙধনু বর্ণিল হাজারো স্বপ্ন। সেখানে সে আছে। সেদিন বলে, ‘ওইদিন আর একটু হলে তো বড় ঘটনা হয়ে যেত। ভাগ্যিস ছাদ তেমন উঁচু নয়!’
‘বাঁ-হাত মচকে গেছে।’
‘আর ঘুড়ি ওড়াবে? কী আনন্দ পাও? আর ওড়াবে না। ঠিক আছে?’
‘আচ্ছা।’
আজ আকাশে ঘুড়ি উড়ছে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। পিঙ্গল আকাশের দেয়ালে কার ছবি জেগে ওঠে? রিমুকে মনে পড়ে যায়। সে কথা রাখেনি। আমার ঘুড়ি ওড়াতে ইচ্ছে করে। কেন ইচ্ছে হয়?
এথেনা খুব সুন্দর করে হেসে উঠল। মানুষের হাসি সুন্দর। কারো কারো হাসি চেহারায় উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ভেসে মন স্পর্শ করে যায়। আমার বুকে তেমন ছোঁয়া এসে লাগল। এখনো তার নাম জানা হলো না। এই নাম না জানা মেয়েটির জন্য মন ব্যাকুল হয়ে গেল কেন? আমি গার্ডেন চেয়ারে বসে পড়লাম। এথেনা আরো কিছুক্ষণ গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। একবার কি চোখের ওপর চোখ পড়বে? একসময় দেখি চলে গেছে। ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দরজা খোলা। কেউ কারো মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে না। কেউ বাতাস আসবে বলে খোলা রেখে দেয়। আমি মন খুলে রাখলাম। একটু বাতাস আসুক। একটু সুখের স্পর্শ। অনেক কথা বুকে জমে আছে। সেই আলাপের কিছু সময় ও অবসর আসুক। তার নাম জানা হলো না।
অন্য এক বিকেলে দেখি ওয়ালি খান মোটরবাইক নিয়ে বিল্ডিংয়ের নিচে নেমে আসছে। সে ভারি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। এথেনা কি কিছু বলেছে? আমি কি খারাপ আচরণ করেছি? একটু পর ছেলের হাত ধরে নেমে এলো সে। মোটরবাইকের মধ্যখানে ছেলেকে তুলে নিজে পেছনে বসল। তারপর কী ভেবে পেছন ফিরে তাকাল। আবার আরো একবার চোখের সংযোগ হয়ে গেল। তার ঠোঁটে হাসি, দৃষ্টি মোলায়েম রহস্যময় এবং এও হতে পারে যে, কেউ একজন তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়, সে বুঝতে পেরেছে; আমার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেল। ওয়ালি খান বড়ই ভাগ্যবান। সে কি জানে জীবনে কোন অপ্সরী পেয়েছে? বোধহয় সেই ভাবনার সময় পায় না। সেই কথা লেখা আছে এথেনার চোখে। এমন বিষাদ চেহারাই বোধকরি টানে আমায়।
সেদিন অনেক সময় ধরে তার কথা মনে এলো। এক-দুই-তিন করে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ইউনিভার্সিটির মমতাজ উদ্দিন ফ্যাকাল্টির দ্বিতীয় তলায় যে দৃশ্যের সূচনা মনে পড়ে গেল। আমাদের কথা হচ্ছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোন শক্তি বেশি প্রবল—অর্থনীতি নাকি রাজনীতি; কে কার ওপর প্রভুত্ব করে? বিষয়টি জটিল। এ রকম যে, মানুষ নিরক্ষর তাই গরিব, আবার মানুষ গরিব বলেই নিরক্ষর। সে যা হোক এক ফাঁকে কথা বলে উঠে ফারিয়া, ‘আমি যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘চলো আমিও যাব। লাঞ্চের টাইম হয়ে এলো।’
‘আমার বাসায় যাবে?’
‘কী রান্না হয়েছে?’
‘আমি জানি না। মা বোধকরি ছোট মাছের চড়চড়ি আর মুগের ডাল রেঁধেছে।’
‘আমি তো মাছ খাই না। হা হা হা!’
‘সেই তো! ফ্রিজে চিকেন তরকারি আছে। গরম করে দেব। চলো।’
‘আজ নয়, ফারিয়া। হলে যাই। গোসল করিনি। অন্য একদিন।’
‘শিওর?’
‘শিওর।’
ফারিয়ার বাসায় একদিন গিয়েছিলাম। তখন মায়ের কথা মনে পড়েছিল। পৃথিবীর সব মায়েরা মনে হয় আপনজন। নিজের ছেলের মতো এটা-ওটা পাতে তুলে দিলেন। ফারিয়া এক ফাঁকে বাইরে গেল। ফিরে এলো দই নিয়ে।
‘তোমার জন্য নিয়ে এলাম। যা গরম পড়েছে। ভালো লাগবে।’
‘বাবা নিজের বাড়ি মনে করে খাও। লজ্জা করো না।’
‘ওকে ছেড়ে দাও, মা। ও নিজে থেকে খায়।’
‘তাই নাকি?’
‘জি আম্মা! আমি খেতে বসে এটা নয় সেটা নয় করি না।’
‘ভালো অভ্যেস।’
‘আর জানো মা, যেটা দরকার, বলবে খুব ভালো রান্না হয়েছে। তাই না?’
‘তুমি সব বলে দিয়েছ নাকি?’
ফারিয়া হাসিখুশি মেয়ে। একদিন আকস্মিকভাবে পরিচয় হয়। সে বাংলা ডিপার্টমেন্টে সেকেন্ড ইয়ার। আমার তিন বছরের জুনিয়র। আমি বছরখানেক থাকব। ফারিয়ার বিয়ে হয়েছে। কমপ্লিকেটেড ম্যারিজ। তথ্য গোপন করে বিয়ে। ছেলেটির নাকি মাথা খারাপ। তখন ফারিয়া ইন্টার শেষ করেছে। ফুড ইন্সপেক্টরের প্রথম পুত্র। বিএ পাস। চেহারা-সুরত নায়কের মতো। ছবি দেখেছি। ফারিয়া বলে, ‘মুখ দেখে ভুল করো না, মুখ তো নয় মনের আয়না।’
‘ওর সমস্যা কী?’
‘আধপাগল। পূর্ণিমা-অমাবস্যায় নাকি একেবারে উন্মাদ হয়ে যায়। আমি যখন ওখানে গেলাম, দেখি রাতে এতগুলো করে ট্যাবলেট-ক্যাপসুল খাচ্ছে। স্মরণশক্তি নেই। একটুতে রেগে ওঠে।’
‘চিকিৎসা করে না?’
‘সেটা না করলে ওষুধ খায় কেন?’
‘এত বড় ধোঁকা! তোমার ফ্যামিলি কী বলে?’
‘তারা আর কী বলবে? আমি চলে এসেছি। ছয়-সাত দিন ছিলাম।’
‘তারপর?’
‘হি ইজ ইমপোটেন্ট।’
আমি কথা বলতে পারলাম না। মানুষ মানুষের জীবন নিয়ে এমন চতুর খেলা খেলে? জুয়ার মতো। এরা কি মানুষ নাকি নরাধম! একদিন পিঙ্গল আকাশ। বাস থেকে নেমে এলো এক ঝাঁক পরি। তাদের একজন আশপাশে ধীরস্থির কাউকে খুঁজতে থাকে। এগিয়ে গেলাম। ফারিয়া। সে কাছে এসে বলে, ‘তোমার সাথে কথা আছে। একটু ক্যাফে যাবে?’
‘বেশ চলো। আমার ক্লাস নেই। কফি খাব।’
এখানকার কফি চমৎকার! কফি নিলাম। সকালে মফিজ আঙ্কেলের ক্যান্টিনে পরোটা আর মিষ্টি খেয়েছি। চা চেয়ে চেয়ে পাওয়া গেল না। বেশ ভিড়। ফারিয়া এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিশ্চুপ বসে আছে। চোখের দৃষ্টি গভীর রহস্যময়। কোলের ওপর হাত একটু কাঁপছে।
‘কই কিছু বলতে চাইলে? বিয়ে করতে চাও?’
‘তুমি বুঝতে পেরেছ?’
‘আমি এনগেজড, ফারিয়া। তুমি খুব ভালো মেয়ে। আমি তবু নিজের পাশে রিমুকে ছাড়া কাউকে ভাবতে পারি না।’
‘সরি। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। একদিন আমাকে সে মনে করে ডেকে উঠেছিলে।’
‘তারপর পরিচয়। তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।’
ফারিয়ার মন ভেঙে যাওয়ার সেই সময়ক্ষণ বড় কষ্ট দিয়েছিল। যেমনভাবে দিনাজপুর ফিরে এসে দেখি সে নেই। আমাকে একটি কথা না বলে ইউএস চলে গেছে রিমু। আমার ফেরার পথ নেই। ফারিয়ার কাছে মুখ দেখাবার। আজ মনে হয়, ফিরে গেলে বোধকরি ভালো হতো। বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করলাম। একেবারে শান্ত সরোবর। জীবন পানসে। সে আমার সাহিত্যচর্চার ধারেকাছে নেই। সে গল্পের বই পড়ে না। কবিতা শোনে না। সে আছে নিত্যনতুন রান্না আর সূচিকর্মে। সারা রাত ঘুম শেষে আরো নিদ্রা। একসময় কথা বলতাম।
‘এই নাজ, একটি কবিতা লিখেছি, পড়ে দেখো তো; আচ্ছা থাক, আমি আবৃত্তি করে শোনাই।’
‘কী শোনাবে? কবিতা? দূর ওসব বুঝি না।’
‘বোঝার চেষ্টা করো। নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে।’
‘আচ্ছা এসব লিখে লাভ কী? কেন সময় অপচয় কর বলো তো?’
‘তুমি গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড় না?’
‘ওসব পড়ে কী হবে? আমার ঘুম ভালো। যাও আমি এখন ঘুমাব।’
নাজ ঘুমোয়। আমি কবিতা লিখি। আকাশের দেয়ালে সহস্র তারার মেলা বসেছে। একটি একটি করে সেজে উঠছে পুরো আকাশ। তারই মধ্যে একটি চাঁদ আলোকিত করে রেখেছে পৃথিবী। কোনো মানে হয়? কেউ অর্থ বোঝে, কেউ বোঝে না। যে কবিতা শুনতে জানে না... না থাক, সবাই একরকম হবে; সে তো নয়। আকাশ দেখি। এই পৃথিবী ছেড়ে আরো কি পৃথিবী আছে? সেখানকার মানুষ আর সভ্যতা? তাদের প্রেম, ভালোবাসা আর আত্মার নিবিড় বন্ধন? আমাদের মতো বেঁচে থাকা মায়াজাল? নাজ এসব ভাবে না। তার জীবন হলো রুটিন। মেশিনের মতো ঘুম থেকে ওঠো। নাশতা তৈরি করো। দুপুরের লাঞ্চ। বাথরুমে সাবান ঘষে ঘষে স্নান আর পারফিউমে ভরে দেওয়া ড্রইংরুম। তার কাছে জীবন মানে অলংকার। ভালো খাবার। কীভাবে আরো সমৃদ্ধি আসবে? এইসব ভাবনার মায়াচক্র। সে তার মতো থাক। আমি এথেনার কথা ভাবি। ফারিয়া নেমে আসে। ফারিয়ার ছবি দেখতে চাই। এথেনা হেসে ওঠে। তাদের সবাইকে ভাসিয়ে আর একজন নেমে আসে। রিমু কেন চলে গেল? একটি কথাও বলে গেল না? কেন? আমার কী দোষ?
একদিন বাহাদুর বাজার সুইটমিটের কাছে দেখা হয়ে গেল। আবছায়া বিকেল। এথেনাকে সাদা পোশাকে চমৎকার দেখায়। ফলের দোকানে কেনাকাটা করছে। ডালিম আর কমলা কিনেছে। ব্রাউন পেপারের প্যাকেট। এথেনা তেমনভাবে হাসে। চোখের ভাষা কথা বলে।
‘কেমন আছেন? কদিন দেখলাম না।’
‘আমিই তো দেখি না আপনাকে।’
‘ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। জ্বর হয়েছিল। ওর বাবাও নেই।’
‘এখন কী অবস্থা? ভালো আছে?’
‘হ্যাঁ। একদিন আসুন না ফ্ল্যাটে? গল্প করব। আপনি নাকি গল্প-কবিতা লেখেন?’
‘অল্পস্বল্প লেখার অভ্যেস। আপনি জানলেন কীভাবে?’
‘আপনার বউয়ের কাছে। ভারি সুন্দর মানুষ! আলাপী।’
‘আপনাদের পরিচয় হয়েছে, অথচ আমি আপনার নামই জানি না।’
‘তাই? আমার নাম ফারিয়া। সরি ফারনাজ। আমি গল্পের বই পড়ি। আপনার বই দেবেন?’
আমার মন আনন্দে নেচে উঠল। ফারনাজের চেহারায় রহস্যময় হাসি। আমার চোখের সামনে রিমু নাকি ফারিয়া এসে দাঁড়ায়। ফারনাজ। ফারনাজ আর ফারিয়া কতটুকু পার্থক্য? আমার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো বুঝি লাফিয়ে নেমে আসে। আমার কৈশোরবেলা। আমি রাস্তায় চোখ বিছিয়ে আছি। রিমু স্কুল থেকে বাড়ি ফেরে। তার দুই কাঁধ ছড়িয়ে বুকের ওপর বেণি। বেণির শিখরদেশে লাল-নীল ফিতের ফুল। কপালের ডানপাশে চকমকে হেয়ার ক্লিপ। অগোছালো চুলের অবাধ্য উজ্জ্বলতা ঝলসে ওঠে। সে তাকায়। চোখের মধ্যে চোখ পড়ে দুষ্টুমি হাসিতে মিলিয়ে যায়। আমি রাত জেগে জেগে কবিতা লিখি। সে কবিতা শোনে। এখন কবিতা শোনার কেউ নেই। গল্প পড়ারও।
‘কোথায় হারালেন?’
‘ফলের দাম কেমন?’
‘একটি বেদানা দুইশ টাকা। আমাদের সুখের দিন শেষ।’
‘সত্যি টাকার মূল্য দিন দিন পড়ে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে।’
‘আপনি আসবেন তো? আগামীকাল বিকালে আসেন। একসঙ্গে চা খাব।’
‘ওকে ফারনাজ। গল্পের বই নিয়ে যাব। আপনি সাহিত্য পড়েন জেনে ভালো লাগল।’
‘আচ্ছা চলি। দেখা হবে।’
ফারনাজ চলে গেল। শেষবার এমন তির্যকভাবে তাকাতে তাকাতে নিশ্চুপ হেসে উঠল যে, কেন জানি মনে হলো, সে আসলে ফারিয়া। তেমন কী হতে পারে? কেন নয়? মানুষের জীবনে সময় কতরকম পরিবর্তন এনে দেয়। তারও কি তেমন বদলে যাওয়া অস্বাভাবিক? অদ্ভুত দোলাচলে মন কেমন কেমন লাগে। সে তবে কেন সেই পরিচয় গোপন করে গেল? আমিই-বা স্পষ্ট বুঝে নিতে পারলাম না কেন? তার অপস্রিয়মাণ ছায়ার পেছনে পেছনে যেতে যেতে দৃষ্টিতে আচমকা বিষাদ এসে যায়। ফারিয়ার হেঁটে চলার ভঙ্গিও ঠিক এমন। কোথাও হয়তো ভুল হচ্ছে। কেউ গোপন করে চলেছে হারিয়ে যাওয়া দিন। কেন জানি মন অকারণ বিমূর্ত দোলাচলে অস্থিরতা খুঁজে নিল।
একদিন সত্যি সত্যি ফোর্থ ফ্লোরে যেতে হবে।