একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অপর নাম ‘রাতের ভোট’। ব্যাপক অনিয়ম-কারচুপির কারণে নির্বাচনটি এ পরিচিতি পায়। এই কর্মযজ্ঞ আনজাম দেওয়ার জন্য প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়েছিল। এজন্য ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) আট হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করে। এই অর্থ জোগাড় করা হয় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক থেকে চাঁদাবাজি, ভুয়া ঋণ গ্রহণ ও টেন্ডারবাণিজ্যের মাধ্যমে। ভোট ডাকাতি করতে টাকাগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার দলবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। যদিও তহবিলের পাঁচ হাজার কোটি টাকাই আত্মসাৎ করেন চার ব্যক্তি। আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া প্রায় অসম্ভব হওয়ায় ভোট ডাকাতির আশ্রয় নেয় আওয়ামী লীগ। কাজটি খুব সহজ ছিল না। এ জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। তাই বিপুল পরিমাণ টাকা সংগ্রহ করতে দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (বর্তমানে ভারতে পলাতক) ছোট বোন শেখ রেহানা (পলাতক), প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান ওরফে সালমান এফ রহমান (কারাগারে), রাজনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচটি ইমাম) এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের পলাতক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদকে (এস আলম)।
এসব তথ্য যাচাই করা হয়েছে দেশের একটি শীর্ষ তদন্ত সংস্থার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার মাধ্যমে। তবে গণমাধ্যমে কথা বলার অনুমতি না থাকায় তিনি নাম-পরিচয় প্রকাশ করেননি। একই কারণে নাম ও পদবি প্রকাশ না করে পুলিশের এক তদন্ত কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, আট হাজার কোটি টাকার মধ্যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। এর মধ্যে পুলিশসহ চারটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দুটি গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন ক্যাডারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা (ডিসি, ইউএনও এবং বিভাগীয় কমিশনারসহ) ভোট ডাকাতির আগাম পুরস্কার হিসেবে এই টাকার ভাগ পান। অবশিষ্ট পাঁচ হাজার কোটি টাকা শেখ রেহানা, সালমান এফ রহমান, এইচটি ইমাম ও এস আলম নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেন।
প্রণোদনা, না ভোট ডাকাতির আগাম ‘পেমেন্ট’
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় নিরাপত্তা সংস্থার জন্য ‘প্রণোদনা’ নামে যে আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচনের আগে নির্দিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও ইউনিটের জন্য বরাদ্দ করা অর্থের একটি অংশ ব্যবহৃত হয়েছে ভোট ডাকাতি, বিরোধী মত দমন এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে। এটি ছিল এক রাজনৈতিক বিনিয়োগ, যার বিনিময়ে প্রত্যাশিত ছিল ভোট ডাকাতি। এই অর্থের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্রবিরোধী অভিযানের অগ্রিম পেমেন্ট।
ভোট ডাকাতি নিশ্চিত করতে শুধু পুলিশ বাহিনীকেই দেওয়া হয় এক হাজার কোটি টাকা। এই অবৈধ অর্থ সরাসরি কয়েকটি ধাপে পুলিশ সদর দপ্তরে পৌঁছে দেওয়া হয়। টাকাগুলো সদর দপ্তরে পৌঁছানোর কাজটি করেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ তিন ব্যক্তি সালমান এফ রহমান, এইচটি ইমাম ও পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তাদের সহযোগিতা করেন তৎকালীন যুগ্ম সচিব হারুন উর রশিদ, উপসচিব ধনঞ্জয় দাস এবং তৎকালীন ডিসি (সিটিটিসি) প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ডিআইজি হাবিবুর রহমান, ঢাকা জেলার এসপি শাহ মিজান শাফিউর রহমান ও এসপি মিলন মাহমুদ। এছাড়া তাদের বিশ্বস্ত আরো কয়েকজন জড়িত ছিলেন।
সূত্র জানায়, পুলিশ সদর দপ্তরে ভোট ডাকাতির টাকা পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি টিম যুক্ত ছিল। সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী এক হাজার কোটি টাকা পাওয়ার পর ১০০ কোটি টাকা পুলিশ সদর দপ্তরে রেখে বাকি টাকা দ্রুত পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেন। জাবেদ পাটোয়ারী ওই ১০০ কোটি টাকা পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতরণের কথা বলে মূলত নিজেই নিয়ে নেন এবং তার বিশ্বস্ত টিমের সদস্য ও সদর দপ্তরের এনালাইসিস টিমের সদস্যদের ভাগ করে দেন।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পুলিশ সদর দপ্তরের লজিস্টিকস অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্কেল (এলআইসি) শাখার প্রধান এআইজি আনজুমান কালাম ও তার টিম ভোটের ১৫ দিন আগে জেলা পর্যায়ের পুলিশ ইউনিট, রেঞ্জ, মেট্রোপলিটন ইউনিট, র্যাব ও অন্যান্য ইউনিটপ্রধানের কাছে পাঠিয়ে দেন।
অর্থ বিতরণ করেন যারা
অবৈধ অর্থগুলো বিভিন্ন ইউনিটে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিখুঁত একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছিল। নির্বাচন ঘিরে গড়ে ওঠা ‘অর্থ ডিস্ট্রিবিউশন টিম’ যা ছিল পুলিশের এক গোপন গ্রুপ। কেন্দ্র থেকে সংগৃহীত অবৈধ অর্থ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, রেঞ্জ অফিস, মেট্রোপলিটন ইউনিট ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে পৌঁছাতে প্রতিটি ধাপে যুক্ত ছিল ওই গ্রুপ।
এই গ্রুপে ছিলেন পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখার এআইজি আনজুমান কালাম, পুলিশ সুপার (এলআইসি) মীর আবু তৌহিদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এলআইসি) ইশতিয়াক উর রশিদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এলআইসি) দেবাশীষ দাস এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এলআইসি) নূরে আলম।
২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বরের পর থেকেই ৬৪ জেলার এসপি, আট রেঞ্জ ডিআইজি, র্যাবের প্রধান, আট মেট্রোপলিটন কমিশনার ও অন্যান্য ইউনিটপ্রধানকে ভোট ডাকাতি করার জন্য এই অর্থ দেওয়া হয়। সরকারিভাবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য পুলিশ সুপার ও পুলিশ কমিশনারদের যে অর্থ দেওয়া হয়, তারচেয়ে এটা ছিল ছয়-সাতগুণেরও বেশি। র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ র্যাবের কথা বলে ১০০ কোটি টাকা নিয়েছিলেন।
বিশেষ ইউনিটে বণ্টন
ভোট ডাকাতির জন্য ডিএমপিকে ৫০ কোটি, সিএমপিকে ১৫ কোটি ও অন্যান্য মেট্রোপলিটন পুলিশ ইউনিটকে সাত কোটি টাকা দেওয়া হয়। অন্যান্য কর্মকর্তার মধ্যে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) অতিরিক্ত আইজি মীর শহীদুল ইসলাম ৫০ কোটি, ঢাকা এপিবিএনের অতিরিক্ত আইজি সিদ্দিকুর রহমান ১৫ কোটি, সিআইডির অতিরিক্ত আইজি শেখ হেমায়েত হোসেন ১০ কোটি, হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি আতিকুল ইসলাম ১০ কোটি, রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মাদ আবুল কাশেম সাত কোটি, অতিরিক্ত আইজি (টিঅ্যান্ডআইএম) ইকবাল বাহার ১০ কোটি, রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মহসিন হোসেন সাত কোটি এবং পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার ১০ কোটি টাকা নেন।
পুলিশে অর্থ পৌঁছানোর নেটওয়ার্ক
পুলিশে অর্থ পৌঁছানোর যে টিম গোপনে কাজ করেছিল, তাতে ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব হারুন-অর-রশিদ বিশ্বাস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, পুলিশ সদর দপ্তরের সাবেক ডিআইজি হাবিবুর রহমান, সাবেক ডিসি (সিটিটিসি) প্রলয় কুমার জোয়ারদার, ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান এবং সাবেক পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ।
ভোট ডাকাতিতে ডিএমপি টিমে যারা নেতৃত্ব দেন
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিআইজি) মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিআইজি) কৃষ্ণপদ রায়, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিআইজি) মীর রেজাউল আলম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মাহবুব আলম, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার ডিবি (ডিআইজি) শেখ নাজমুল আলম, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ডিআইজি) মনির হোসেন, সিটিটিসির উপ-পুলিশ কমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ারদার।
তেজগাঁওয়ের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, গুলশানের উপ-পুলিশ কমিশনার এসএম মোস্তাক আহমেদ খান, ডিবির উপ-পুলিশ কমিশনার জামিল হাসান, রমনার উপ-পুলিশ কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার, মতিঝিলের উপ-পুলিশ কমিশনার আনোয়ার হোসেন, উপ-পুলিশ কমিশনার শ্যামল কুমার মুখার্জী, উপ-পুলিশ কমিশনার এএইচএম কামরুজ্জামান, উপ-পুলিশ কমিশনার প্রবীর কুমার রায়, ডিবি (পূর্ব) উপ-পুলিশ কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী, উত্তরার উপ-পুলিশ কমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল, লালবাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মাদ ইব্রাহীম খান।
মিরপুরের উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদ আহম্মদ, ওয়ারীর উপ-পুলিশ কমিশনার ফরিদ উদ্দিন, উপ-পুলিশ কমিশনার (আইএডি) মোহাম্মাদ আশিকুর রহমান, উপ-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) এএইচএম আবদুর রকিব, উপ-পুলিশ কমিশনার (আইএডি) মোহাম্মাদ আশিকুর রহমান, উপ-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মোহাম্মাদ মহিবুল ইসলাম খান, উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর দপ্তর) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, উপ-পুলিশ কমিশনার ডিবি (পশ্চিম) মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান।
অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আবদুল মান্নান, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি উত্তর) (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) কাজী শফিকুল আলম, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. শাহজাহান, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এসএজি সিটিটিসি) (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ-সিটিটিসি) (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) জাহাংগীর আলম।
অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) মাহফুজা লিজা, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) জাহিদুল হক তালুকদার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (সোয়াট সিটিটিসি) আহমেদুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ধানমন্ডি জোন) আবদুল্লাহিল কাফী, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি উত্তর) গুলশান জোনাল টিম গোলাম সাকলায়েন, সহকারী পুলিশ কমিশনার (সোয়াট সিটিটিসি) এসএম জাহাংগীর হাসান, সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডিবি) পল্লবী জোনাল টিম সাহাদত হোসেন সুমা।
সহকারী পুলিশ কমিশনার (কোতোয়ালি জোন) বদরুল হাসান, সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডিবি দক্ষিণ) আহসানুজ্জামান, সহকারী পুলিশ কমিশনার (এয়ারপোর্ট জোন) মিজানুর রহমান, সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডিবি দক্ষিণ) ধানমন্ডি জোনাল টিম ফজলুর রহমান, সহকারী পুলিশ কমিশনার (মিরপুর বিভাগ) সৈয়দ মামুন মোস্তফা, সহকারী পুলিশ কমিশনার (সাইবার সিকিউরিটি, সিটিটিসি) ইশতিয়াক আহমেদ, সহকারী পুলিশ কমিশনার (ওয়েবসাইট অ্যান্ড ইমেইল ক্রাইম, সিটিটিসি) সাইদ নাসিরুল্লাহ, সহকারী পুলিশ কমিশনার (মতিঝিল বিভাগ) মিশু বিশ্বাস।