ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বদলে গেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর বাংলাদেশ নতুন এক রাজনৈতিক অধ্যায়ে প্রবেশ করে। দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী একদলীয় শাসনের পর মানুষ যে মুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ পেয়েছে, তাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে। যেখানে আর কখনো ফ্যাসিবাদী শাসন ফিরবে না। শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের মধ্য দিয়ে কার্যত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মৃত্যু যেন নিশ্চিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরিবর্তনের চাপ বাড়ছে। এই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে উঠে আসছে নতুন নেতৃত্ব। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে বলে আশা করা যায়।
ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির শক্ত রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠতে না পারা কিংবা দলের মধ্যে নানামুখী দ্বন্দ্ব অনেককে হতাশ করলেও দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যায়নি। বরং আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এই দলের নেতারা আবার জনগণের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ তৈরি করতে পারেন। নাহিদ, আখতার, হাসনাতরা ছিলেন অভ্যুত্থানের সবচেয়ে পরিচিত মুখ। মানুষ চায় ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা যেন ভূমিকা রাখতে পারেন। অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে নতুন অনেক মুখ সামনে চলে এসেছেন, যা আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে গুণগত পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। তবে তরুণ এই রাজনৈতিক নেতাদের সাফল্য নির্ভর করবে সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ও দেশের শত্রু-মিত্র চেনার ওপর। অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া জেন-জিদের রাজনৈতিক ভাবনা এই তরুণ নেতারা ধারণ করতে পারেন কি নাÑতার পরীক্ষা হবে আগামী নির্বাচনে।
শেখ হাসিনার দেড় দশকের নিষ্ঠুর শাসনে আমরা প্রবীণ ও প্রজ্ঞাবান অনেক রাজনীতিবিদকে হারিয়েছি। এই রাজনীতিবিদদের বছরের পর বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। আবার অনেকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ পাননি। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার কিংবা তরিকুল ইসলামের মতো নেতারা ২০০৮ সালের পর থেকে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। জীবনসায়াহ্নে তাদের কখনো কারাগারে, কখনো আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে পরাধীন এক দেশে তাদের জীবনের ইতি ঘটেছে। এমনকি বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে অন্তরীণ রাখার পাশাপাশি বিনাচিকিৎসায় হত্যার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। সুস্থ-সবল বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হয়েছিল ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসিনা সরকার অনেকটা বাধ্য হয়ে তার সাজা স্থগিত করে বাসায় থাকার সুযোগ দেয়। প্রকৃতপক্ষে খালেদা জিয়া মুক্ত হন হাসিনার পতনের পর। বিএনপির রাজনীতির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো একটি বানোয়াট মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেওয়া হলেও তার বিরুদ্ধে জোরালো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। কারাগারে অসুস্থ খালেদা জিয়া আর রাজনীতিতে ফিরতে পারেননি। কিন্তু তিনি দেখছেন ইতিহাসের নিকৃষ্ট এক স্বৈরশাসকের পতন। খালেদা জিয়ার সংগ্রামমুখর এই জীবন তরুণ রাজনীতিকদের জন্য বড় শিক্ষা।
হাসিনা একই সময়ে জামায়াতে ইসলামীর পুরো নেতৃত্বকে ফাঁসি দিয়ে এদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। জামায়াত নেতাদের ফাঁসি এবং খালেদা জিয়াকে বিনাচিকিৎসায় কারাবন্দি রাখার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করে দিল্লির অধীনতা নিশ্চিত করা। হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে এক নতুন বাংলাদেশের জন্ম দেখছি। যে দেশের তরুণরা ভারতীয় আধিপত্যবাদমুক্ত আত্মমর্যাদাশীল দেশের স্বপ্ন দেখে। যারা হাসিনা খেদাও আন্দোলনে নির্ভীকভাবে স্লোগান দিয়েছিলÑদিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা।
দেশের প্রধান দুটি দলের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণ করতে যাচ্ছে এখন তরুণ নেতারা। বিএনপিতে এখন প্রবীণ নেতৃত্বের কিছুটা প্রভাব থাকলেও জামায়াতে ইসলামীর পুরো নেতৃত্ব বলা যেতে পারে নতুন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের তরুণ নেতারা এখন জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে চলে এসেছেন। বিএনপিও আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক স্থানে তরুণ নেতাদের প্রাধান্য দিয়েছে। এমনকি দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তরুণ নেতাদের ভূমিকা যে বেড়েছে, তা স্পষ্ট।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কেন্দ্র করে দ্বিদলীয় বলয়ের রাজনীতি গড়ে উঠেছিল। এখন সেই বলয়ের বাইরে এসে নতুন এক রাজনৈতিক আবহ তৈরি হয়েছে। ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ছাতার নিচে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন জোটবদ্ধ থেকেছে। এর সঙ্গে ইসলামপন্থি দলের অন্য অংশগুলো বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নতুন মেরূকরণ তৈরি হয়েছে।
দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দুই মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এখন প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই প্রথম জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামপন্থি আটটি দল জোটবদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সঙ্গে জামায়াতের জোটবদ্ধ হওয়া ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে বিভেদ ও বিভাজন কমে আসার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি হিসেবে দেখা যায়। অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ আরো কয়েকটি ইসলামপন্থি দল জোটবদ্ধ হয়েছে। অর্থাৎ ভোটের মাঠে প্রধান দুটি দল ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের উপযোগিতা অস্বীকার করতে পারছে না। এছাড়া বামধারার কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপির জোট গড়ে উঠেছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে এনসিপির নেতৃত্বে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক জোটের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক জোট দৃশ্যত বিএনপিকে এক ধরনের চাপের মুখে ফেলেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এ দুই জোটের তৎপরতার দিকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি থাকবে। এমনকি দুই জোটের মধ্যে বড় আকারে আসনভিত্তিক রাজনৈতিক সমঝোতা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এনসিপির যারা নেতৃত্বে আছেন, তারা সবাই অভ্যুত্থানের চেনামুখ। তাদের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে, রাজনীতির মারপ্যাঁচের কৌশল নয়, বরং খোলা চোখে জনগণের সমস্যাগুলো কীভাবে তুলে ধরছে, সেদিকে মানুষ নজর দেবে। এনসিপি যদি বাম প্রভাবিত তত্ব কথার রাজনীতির ফাঁদে পড়ে, তাহলে দেশের রাজনীতিতে আরেকটি দলের সংখ্যা শুধু বাড়াবে।
নির্বাচন সামনে রেখে একাধিক রাজনৈতিক দল ও জোটের এই তৎপরতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে ইতিবাচক তৎপরতা হিসেবে দেখা যেতে পারে। ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে এ ধরনের জোটবদ্ধ রাজনীতি গণতান্ত্রিক উত্তরণে প্রভাব ফেলবে। যা প্রতিযোগিতামূলক গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথ তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।
শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর ধারণা করা হয়েছিল প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি হতে যাচ্ছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে দেখা যাচ্ছে, বিএনপিকে একাধিক বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সম্ভবত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রথম থেকেই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি পটপরিবর্তনের পর শুরু থেকেই বলে আসছিলেন আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া দলের জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ। সত্যিকার অর্থে, বিএনপি কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিএনপিকে রাজনীতির এই নতুন বাস্তবতা মেনে নিয়ে প্রার্থী বাছাই করতে হচ্ছে। যেমন : ঢাকা-১৪ আসনে জামায়াতে ইসলামী যখন গুম হওয়া ব্যারিস্টার আরমানকে প্রার্থী ঘোষণা করে, তখন বিএনপিকে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তা করতে হয়েছে। এই আসনে আরমানের বিপরীতে গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের সংগঠন মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা তুলিকে প্রার্থী করতে হয়েছে। যিনি গুমের শিকার বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন। দুই প্রার্থী নতুন মুখ এবং রাজনীতিতে নবাগত। আবার আমরা দেখছি, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলাওয়ার হোসেন। আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন দেলাওয়ার। পুলিশ রিমান্ডে তার হাত ও পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। একজন প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তরুণ নেতার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেন ভবিষ্যৎ এক বাংলাদেশের ইঙ্গিত দেয়। একইভাবে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ একজন প্রবীণ জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে নির্বাচনি লড়াইয়ে নেমেছেন। হাসিনার পতনের আগে এমন তরুণ নেতৃত্ব দেশের রাজনীতিতে সামনে আসবেÑএমনটা কল্পনাও করা যায়নি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছেÑআওয়ামী লীগের প্রক্সি হিসেবে পরিচিত ভারতপন্থি বাম দলগুলো ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট হিসেবে পরিচিত সিপিবির ছাতার নিচে থাকা বাম দলগুলোকে এদেশের মানুষ এখন আওয়ামী লীগের মতো ঘৃণা করে। যদিও বামপন্থি বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা বিএনপির কাঁধে ভর করে রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরির মাধ্যমে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা করছেন, তবু গণমাধ্যমে তারা যখন বিএনপির মাউথপিচ হিসেবে আবির্ভূত হতে চানÑতখন বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
বিএনপির হয়ে বামপন্থিদের বক্তব্য অনেক সময় ভারতপন্থি তৎপরতা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা দলটির নির্দিষ্ট ভোটব্যাংকের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছে যে, আওয়ামী লীগের মতোই বামপন্থি প্রচারবিদরাও দেশে ভারতীয় আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে আসছে।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, যদি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে একঝাঁক তরুণ নেতৃত্বের আবির্ভাব দেখতে পাওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে একটি কার্যকর বিরোধী জোট গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে সমঝোতাভিত্তিক দুটি বড় নির্বাচনি জোট তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে, যা ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক রাজনীতির গতিপথ বদলে দিতে পারে।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য একটি কার্যকর ও শক্তিশালী বিরোধী দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনে বাংলাদেশে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সংসদ ও শক্তিশালী বিরোধী দলের উদ্ভবের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো একটি বিষয়ে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে—রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেন কোনোভাবেই সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি না করে।