হোম > মতামত

যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে পূর্বমুখী হচ্ছে উপসাগরীয় দেশগুলো

নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

মুহাম্মদ হুসেইন

ইসরাইল গত সেপ্টেম্বরে যখন কাতারের রাজধানী দোহায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনারত হামাস নেতাদের ওপর হামলা চালায়, তখন তা বিশ্বজুড়ে অনেককে অবাক করেছিল। কিন্তু একইসঙ্গে ওই হামলা এই বাস্তবতাকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, এই দেশগুলো ইসরাইল থেকে অনেক দূরে হওয়া সত্ত্বেও দেশটির আগ্রাসন থেকে মুক্ত নয়। অথচ গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য কাতার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে এসেছে।

এই হামলা কেবল নিরাপত্তার ভ্রান্ত ধারণার ভঙ্গুরতাই প্রকাশ করেনি, বরং উপসাগরীয় দেশগুলো এবং অন্য মার্কিন মিত্রদের সুরক্ষিত অবস্থানকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। দোহা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে নিরাপত্তা চুক্তি এবং আল-উদেইদে থাকা মার্কিন বিমানঘাঁটিও কাতারে হামলা চালানো থেকে ইসরাইলকে বিরত রাখতে পারেনি। সংগত কারণেই কাতারের প্রতিবেশী দেশগুলোর আশঙ্কা—তারাও যেকোনো সময় ইসরাইলের হামলার শিকার হতে পারে।

কাতারে হামলার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, এই হামলার সিদ্ধান্ত ও দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবেই ইসরাইলের। এমনকি তিনি কাতারে আবারও হামলার আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেছেন, হামাস নেতারা যেদেশেই থাকবে, সেখানেই তাদের ওপর হামলা করা হবে।

কাতারে হামলার পর গুঞ্জন ওঠে, এই হামলা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র জানত এবং ট্রাম্প প্রশাসনের অনুমোদনও ছিল এতে। ফলে হামলার পর কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যুতে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। এসব দেশের মধ্যে এখন এই প্রশ্ন উঠেছে—যুক্তরাষ্ট্র ও তার নিরাপত্তা গ্যারান্টিকে তারা কীভাবে বিশ্বাস করবে? কারণ কাতার এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং দেশটিতে মার্কিন ঘাঁটি থাকা সত্ত্বেও ইসরাইল সেখানে হামলা করেছে। এরপর তারা কীভাবে তাদের নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল থাকবে?

মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলি হামলার পর কাতারের প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্প প্রশাসনকে স্পষ্ট করেই বলেছেন, তারা এই হামলাকে কাতারের সঙ্গে ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবেই বিবেচনা করছেন। কাতার সরকারের পক্ষ থেকে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফকেও এ কথা বলা হয়েছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাতারের নিরাপত্তা অংশীদারত্বকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখবে এবং ‘বিকল্প অংশীদারের’ সন্ধান করবে।

উপসাগরীয় দেশগুলোর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। কাতারের আগে গত জুন মাসে ইরানে হামলা করে ইসরাইল। ইহুদি বর্ণবাদী দেশটির পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও ইরানের তিনটি প্রধান পরমাণু স্থাপনায় বাংকারবিধ্বংসী বোমা বর্ষণ করে। এটা প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের আগ্রাসী ও সম্প্রসারণবাদী তৎপরতা থামাতে আগ্রহী তো নয়ই, বরং তারাও ইসরাইলের আগ্রাসনে যুক্ত হয়ে পড়ে।

মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে পাকিস্তান বহু দশক ধরে আরব দেশগুলোর প্রতিরক্ষা অংশীদার হিসেবে কাজ করে আসছে। পাকিস্তান তাদের বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং বড় বড় প্রতিরক্ষা উদ্যোগেও অংশগ্রহণ করছে। পাকিস্তানের সেনা ও বিমান বাহিনীর উল্লেখযোগ্যভাবে প্রমাণিত যুদ্ধ অভিজ্ঞতাও রয়েছে, যার মধ্যে ভারতের বিমান হামলা ও অনুপ্রবেশ প্রতিরোধের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যা অনেক আরব দেশ এবং বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোকে কখনো মোকাবিলা করতে হয়নি। তাই উপসাগরীয় দেশগুলোর নতুন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা গ্যারান্টর হিসেবে পাকিস্তানকে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প বলে মনে করা হচ্ছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে একজন সৌদি কর্মকর্তা বলেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে এই চুক্তিটি বছরের পর বছর ধরে আলোচনার ফল এবং ‘এটি নির্দিষ্ট কোনো দেশ বা নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়া নয়, বরং আমাদের দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর সহযোগিতার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ’। তবে ইসরাইলি আগ্রাসনের মধ্যে এই চুক্তি এই অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত একটি সময়েই স্বাক্ষরিত হয়েছে বলা যায়।

প্রাচ্যের দিকে মনোযোগ?

নিরাপত্তা নিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর দীর্ঘদিন ধরেই নির্ভরশীল। কিন্তু ওয়াশিংটনের ইসরাইলপন্থি অবস্থানের কারণে তাদের ওপর এই দেশগুলো আর নির্ভর করতে পারছে না। এসব দেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্বস্ততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে। এই পরিস্থিতির আলোকে উপসাগরীয় দেশগুলোর পাকিস্তান ছাড়াও আরো একটি সম্ভাব্য গ্যারান্টর বিবেচনা করা উচিত এবং সেই দেশটি হচ্ছে চীন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে উঠেছে চীন। দেশটি পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।

কাতারে ইসরাইলি হামলার নিন্দা জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসন বারবার কেবল এ কথাই বলতে চেয়েছে যে, এই হামলার সঙ্গে ওয়াশিংটনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। অন্যদিকে কাতারে ইসরাইলি হামলার নিন্দা করেছিল যেসব দেশ, তাদের মধ্যে চীন ছিল অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সংঘাত জিইয়ে রাখার ‘প্রিয়’ খেলার জন্য কঠোর ভাষায় ওয়াশিংটনের সমালোচনা করেছিল বেইজিং।

বেইজিং দীর্ঘদিন ধরে উপসাগরীয় দেশগুলোর অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার এবং তারা চীনের শীর্ষ তেল ও জ্বালানি রপ্তানিকারক হওয়ায় তাদের মধ্যে সম্পর্ক এখন স্থিতিশীল ও সুপ্রতিষ্ঠিত। দুই পক্ষের এই সম্পর্ক ক্রমেই বাড়ছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চলমান উত্তেজনা এবং বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো জোরদার করা চীনের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করার এক বিরাট সুযোগ চীনের সামনে এসেছে।

সৌদি আরবের কাছে ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও অস্ত্রের যন্ত্রাংশ বিক্রি করা ছাড়া উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্য কোনো দেশের সঙ্গে চীনের প্রতিরক্ষা বা সামরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হলো, উপসাগরীয় দেশগুলো কি চীন ও তার সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে পারে, অথবা তাদের ভূখণ্ডে চীনা সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দিতে পারে?

বর্তমানে বিদেশে চীনের কেবল একটি সামরিক ঘাঁটি আছে, যেটি পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতিতে অবস্থিত। সেখানে চীনের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন রয়েছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে কাতার ও উপসাগরীয় অন্য দেশগুলোয় চীনের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কাতারের আল-উদেইদে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির মতোই সেখানে চীনের সামরিক ঘাঁটিও হতে পারে। এ ধরনের কিছু ঘটলে তা হবে বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থার এক চরম বহিঃপ্রকাশ।

তবে এই প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্তও হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণটি হতে পারে, নিজের এলাকার বাইরে গিয়ে পশ্চিম এশিয়ার এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য চীন প্রধান নিরাপত্তা গ্যারান্টর হতে চায় কিনা? এ ব্যাপারে চীনের আগ্রহী হওয়া না হওয়ার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। কারণ সামরিক ক্ষেত্রের চেয়ে কেবল আর্থিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারে বেশি মনোযোগ দিয়েছে চীন।

গ্লোবাল সাউথ বা বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চীনের দরকষাকষির অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হলো উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করা। একইসঙ্গে পশ্চিমা শক্তিগুলোর অনুসরণ করা সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতির কৌশল থেকেও নিজেকে আলাদা রাখার দাবি করে বেইজিং।

মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি কেনায় চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে পারমাণবিক সহযোগিতা গড়ে তোলা এবং শিল্প ও বাজারের ওপর নিজের সীমাহীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রয়েছে চীনের। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না যে, এই অঞ্চলে সামরিক আধিপত্য বিস্তারের কোনো আকাঙ্ক্ষা রয়েছে চীনের।

সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং দেশটির নিরাপত্তার গ্যারান্টর হিসেবে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে এই একই মডেলে পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করতে উপসাগরীয় অন্য দেশগুলোও আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এ ধরনের বৃহত্তর সহযোগিতার সম্ভাবনার কারণে চীন নিকট ভবিষ্যতে এই সামরিক জোটের জন্য কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সীমিত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিরক্ষা নীতি

পাহাড়ে শান্তির ভরসা

চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার তথ্যগত দুর্বলতা

রাজনৈতিক সংস্কৃতি রূপান্তরে জেন-জি

বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি কৌশল

নদীর বুকে বিষের স্রোত

ইসলামে সময়ের গুরুত্ব

যুক্তরাষ্ট্র কি গাজায় সংঘাতে জড়াবে?

আস্থাহীন উদ্যোক্তা স্থবির কর্মসংস্থান

ভারতের প্রেসক্রিপশনে গোয়েন্দা সংস্থার অবক্ষয়