উন্নয়নের ধারণা প্রতিটি দেশের শাসনব্যবস্থার বাস্তবতায় ভিন্ন হয়ে থাকে। ফলে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও রাজতন্ত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় উন্নয়নের ধারণাও একরকম নয়। আজকের পপুলিস্ট বা লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির যুগে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রেই জাতীয় উন্নয়ন নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পাল্টাপাল্টি দাবি ঘিরে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা, তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলে। বস্তুত, এই বিতর্কই রাজনীতিকে সচল রাখে। লোকদেখানো, উগ্র জাতীয়তাবাদী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বাকসর্বস্ব উন্নয়নের ফিরিস্তি এ ধরনের রাজনীতিতে নিয়ামক হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার অনেক দেশেই ইতোমধ্যে পপুলিস্ট রাজনীতির উত্থান ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ইতালি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা এবং ভারতের মতো রাষ্ট্রে এই রাজনীতির বিকাশ মূলত ‘তথাকথিত’ দীর্ঘ চর্চিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অসারতাকেই তুলে ধরছে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, পপুলিস্ট রাজনীতির এই ধারা কেন দেশে দেশে গণতন্ত্রের মতো জনপ্রিয় একটি রেইনবো সিস্টেম বা রংধনু ব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে? এর একটি কারণ হতে পারে বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো রাষ্ট্রেরই শুধু ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ কম। বাজার অর্থনীতির ফলে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আগের তুলনায় বেড়ে যাওয়ায় আঞ্চলিক চশমায় আর গণতন্ত্রকে দেখা সম্ভব হচ্ছে না। বরং দেখতে হচ্ছে বৈশ্বিক চশমায়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এটি আর সেখানে তেমন একটা কাজ করছে না। এ অবস্থায় কোথাও কোথাও গণতন্ত্রের বাহ্যিক বা আনুষ্ঠানিক শর্ত যেমন নির্বাচন, রাজনৈতিক দল এবং সংবিধানের মতো বিষয়গুলোর যুগোপযোগী সংশোধন বা মৌলিক পরিবর্তনের আবশ্যকতাও অনুভূত হচ্ছে।
উপরোল্লিখিত রাষ্ট্রগুলোয় পপুলিস্ট রাজনীতির আত্মপ্রকাশের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট এবং নানা ধরনের বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন অব্যাহত থাকায় তা জনগণের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে এবং এগুলো সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। সেই সঙ্গে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ভূমিকাও অনস্বীকার্য। বর্তমানে প্রচলিত গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিকদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সহজ সংযোগ ঘটছে ফেসবুক, টুইটার ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তারা প্রযুক্তির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আবেগনির্ভর তারুণ্যকে কাছে টানছেন নিজেদের অভীষ্ট হাসিলে। তারা নির্বাচনের আগে তরুণদের জন্য সস্তা খ্যাতি আর নগদ নারায়ণের ব্যবস্থাও করছেন নিজেদের ঢোল পেটানোর মতো প্রচার ও সম্প্রচার যন্ত্র বাজারে এনে।
এই ব্যবস্থায় নির্বাচন-পূর্ব আত্মপ্রচারে বিরোধী দলগুলোর বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব সরকারি দলের বিরুদ্ধে জনসমর্থন আদায়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এখানেও লোকরঞ্জনবাদী চাপাবাজি জমে উঠছে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকায় আসন্ন নির্বাচনে সরকারি দলের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। ফলে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং ইসলামপন্থি শক্তিশালী দল জামায়াতে ইসলামীর মধ্যেই সীমিত থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
পপুলিস্ট রাজনীতির সুবিধা হলো কোনো সরকার যখন অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়, তখন সে পররাষ্ট্রবিষয়ক ইস্যুকে ব্যবহার করে জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। এর প্রকৃষ্ট নজির আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত এবং পাকিস্তান। দেশ দুটোর সরকার যখনই অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতায় নাকাল হয়েছে, তখনই তারা কাশ্মীর ইস্যুকে সামনে এনে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছে। পপুলিস্ট ব্যবস্থায় জাতীয় উন্নয়নের সংজ্ঞা কিছু গগনচুম্বী আধুনিক দালানকোঠা, প্রতিরক্ষা খাতে বড় বাজেট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের মতো বাহ্যিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও, পরিপূর্ণ গণতন্ত্রে জাতীয় উন্নয়নের সংজ্ঞা অধিকতর বিস্তৃত। একটি পরিপূর্ণ গণতন্ত্রে জাতীয় উন্নয়ন মানে হলো জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে সর্বাঙ্গীণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ অগ্রগতি। আর এই ভারসাম্যপূর্ণ জাতীয় অগ্রগতি তখনই অর্জিত হয় যখন শিল্প, কৃষি, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণগত এবং সুস্থ বিকাশ ঘটে প্রত্যাশিত মানের আইনের শাসন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলনে। অর্থাৎ একটি নিরাপদ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় বসবাসের উপযোগিতার মধ্যে সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার উপভোগ করার সুযোগ এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তাই এই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। ভয়-ভীতি, দমন-পীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে এই উন্নয়ন অর্জিত হয় না।
আধুনিক রাষ্ট্রে জাতীয় উন্নয়ন বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান বিশ্লেষণ করলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। এ দেশে প্রবাহিত গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদী ও বনাঞ্চলের করুণ অবস্থা দেখে কি দাবি করা যাবে যে এখানে ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন হয়েছে? একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের আয়না হলো তার রাজধানী। ঢাকার বাহ্যিক চেহারা দেখে মনে হয়, এখানে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এই অপরিকল্পিত ও অপরিণামদর্শী উন্নয়ন করতে গিয়ে আমাদের নদী, খেলার মাঠ এবং বনের যে অপরিমেয় ক্ষতি হয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যে উন্নয়নের মাধ্যমে একটি নগর বা শহর সরু গলিতে পরিণত হয়, রঙ বেরঙের কাচ আর কংক্রিটের স্তূপের নিচে খোলা আকাশ ঢেকে যায়, যানজট মানুষের মূল্যবান কর্মঘণ্টা কেড়ে নেয়Ñসেটি কখনোই উন্নয়ন নয়। যদিও এটি কিছু ভূমিদস্যুর জন্য শাপেবর হয়েছে। পৃথিবীতে ঢাকাই সম্ভবত একমাত্র নগরী যেখানে দ্রুতগামী ও ধীরগতির যানবাহন একসঙ্গে চলে!
বিশ্বব্যাপী পপুলিস্ট রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন সরকারের নেতারা প্রায়ই নজিরবিহীন অর্থনৈতিক উন্নয়নের দাবি করে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। এই প্রবণতা আমাদের দেশের রাজনীতিতেও লক্ষণীয়। পতিত আওয়ামী সরকারের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল লক্ষণীয়। তাদের প্রায় সবাইকেই উন্নয়নের নামে বাগাড়ম্বরসর্বস্ব গলাবাজি করতে দেখা গেছে। পপুলিস্ট রাজনীতির একটা বিরাট অভিশাপ হলো বৈষম্য। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অতিধনী ও অতিদরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এই বৈষম্য হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। অসম উন্নয়নের ফলে কর্মসংস্থানের অভাবে শিক্ষিত বেকার যেমন বেড়েছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থার সংকটও তৈরি হয়েছে। দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং বেইলআউটের মতো ঘটনাগুলো জাতীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এদিক থেকে বলা যায়, নির্বাচনমুখী দলগুলো তাদের ইশতেহার আর কাজের মধ্যে যদি মিল না রাখতে পারে, তবে বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। সুতরাং ইশতেহারের নামে দলগুলোর এমন আকাশকুসুম চিন্তা করা উচিত নয়, যা বাস্তবায়ন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কবি