শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৬ বছরের মাফিয়াতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পর বর্ষাবিপ্লব-পরবর্তী সময়ে সমগ্র দেশবাসী আশা করেছিল নতুন বন্দোবস্তের ভিত্তিতে নতুন এক রাষ্ট্রকাঠামো নির্মিত হবে। নতুন ধারার সরকারব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হবে। সংগঠন ও কাঠামোয় গুণগত পরিবর্তন আসবে। রাষ্ট্রসংস্কারের মৌলিক ভাবনা বাস্তবায়িত হবে।
এর সঙ্গে ফ্যাসিবাদী নেতৃত্ব, তাদের দল আওয়ামী লীগ, ফ্যাসিবাদের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল, গাঁটছড়া-বাঁধা আমলাতন্ত্র এবং গণহত্যায় জড়িত সব পক্ষ বিচারের সম্মুখীন হবে; আর দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেই বিচার সম্পন্ন করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত হবে। এরপর একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, যার মাধ্যমে নতুন প্রতিনিধি ও সরকার বাছাই করবে জনগণ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের ভাষায় এটা হবে এ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম নির্বাচন। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখন পর্যন্ত যে পারফরম্যান্স তাতে ইতিহাসশ্রেষ্ঠ নির্বাচন সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে। তাই জনগণের এখন ন্যূনতম চাওয়া অন্তত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
ইতোমধ্যে আমজনতাকে বাইরে রেখে যে ঐকমত্য ও ভিন্নমতের চুক্তিপত্র তৈরি করা হয়েছে, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান রাতারাতি তীব্র আকার ধারণ করছে। অথচ এতটুকু আন্তরিকতা এবং জাতি, জনগণ ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকলে, ১৯৭১ ও ২০২৪-এর প্রতি এতটুকু দরদ থাকলে একটা ন্যূনতম ঐকমত্যও পাওয়া যেত; কিন্তু তা হয়নি। ঐকমত্য কমিশন ঐকমত্যের জায়গাগুলোকে অনেকটা নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছে বলে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করছে। ভিন্নমত বাদ দেওয়াটাও অভিযোগের মধ্যে এসেছে। আবার ক্ষমতালাভেচ্ছু অন্য শরিকেরা ভিন্নমত বাদ দেওয়াকে ন্যায্য মনে করছেন। ঐকমত্যের বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে যে পথ দেখানো হয়েছে কমিশন কর্তৃক, তা বড় এক শরিক দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অন্য আরেক শরিক এ ব্যাপারে উল্টো অবস্থানে আছেন। আর যারা ছোট শরিক অংশীজন, তারা বড় দুই শরিকের সঙ্গে সুবিধাজনক ব্যবস্থায় যেতে এদিক-ওদিক করছেন। তাহলে যা দাঁড়াল তার মানে হলো, ১০ পা এগিয়ে ১৪ পা পিছিয়ে যাওয়া। আর জনমানুষের দিক থেকে বলা যায়, ‘ধন্য আশা কুহকিনী।’
বিদায়ের আগে ঐকমত্য কমিশন বল ছুড়ে দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, অংশীজন ও নির্বাচন কমিশনের দিকে। আর সেইসঙ্গে আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসা দলের নেতৃত্বাধীন সংসদকে দুই ধরনের ভূমিকায় নামার খেলোয়াড় করে দিয়েছে। আর কিছু কাজ অধ্যাদেশের মাধ্যমে সমাধা করার এবং কিছু কাজ নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সমাধা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই পুরো প্রক্রিয়ার বিষয়টিকে এরই মধ্যে অংশীজনেরা পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ করে ফেলেছেন। অথচ সবচেয়ে বড় যে অংশীজন—সেই কোটি কোটি আমজনতা ও নাগরিকসত্তা সামান্যতম মর্যাদা পায়নি। তাদের জন্য অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
তাদের মতামত মোটেও জানা হয়নি। খেলা হয়েছে পিরামিডের শীর্ষে। নিচে একেবারেই জমিনে যে মৃত্তিকানির্ভর সাধারণ মানুষ, যারা সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে, জীবন দিয়েছে, আহত হয়েছে, ক্ষতির শিকার হয়েছে—তাদের জানানো হয়নি, তাদের কথা শোনা হয়নি এবং তাদের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি; তাদের অভিপ্রায়, সম্মতি ও বাছাইয়ের বিষয়কে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক করে রাখা হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রভাবনা, গাঠনিক সত্তা তৈরি, শাসনব্যবস্থাপনার নববন্দোবস্ত, অর্থাৎ কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের আমজনতার ইচ্ছার প্রতিফলন নেই। তাদের সঙ্গে সর্ববিধ বিচ্ছিন্নতা রেখে ক্ষমতালাভেচ্ছু গজদন্তমিনারে আসীন একেবারেই অতি সামান্যসংখ্যকের সংকীর্ণতম ঐকমত্যকেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য কেজো দলিল করে ফেলা হচ্ছে। জুলাই ঘোষণা, জুলাই সনদ ও ঐকমত্য কমিশনের এত উচ্চ আওয়াজ তোলা সুপারিশমালায় কোটি জনতা ও সমষ্টিগত নাগরিকসত্তাকে যৌথভাবে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা সুস্পষ্টকরণে নিদারুণ ব্যর্থতা স্পষ্ট।
শীর্ষদেশের পক্ষ-বিপক্ষ এলিটবৃত্ত মেরামতের ঘোষণায় জনগণকে রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার লিখিত ঘোষণা দিলেও কার্যত তা থেকে উল্টো পথেই হাঁটছে। অন্যরাও কল্যাণধর্মীতার নয়া-উদারতার মধ্যেই রয়ে যাচ্ছেন। আর ছোট শরিকেরা উদগ্র বাসনা নিয়ে এপক্ষ-ওপক্ষের সঙ্গে ডিল করার মতলবে আছেন। অনেকেই আছেন নতুনভাবে জাতীয় পার্টির ও ১৪ দলের নবসংস্করণের ভূমিকায় নামতে। সেজন্য মূল এজেন্ডার দিকে মোটেও যাওয়া হয়নি। কেবল কিছু প্রকৌশলগত জারিজুরি সামনে আনা হয়েছে। আর তা নিয়েও নিজেদের মধ্যে ঠোকাঠুকি। এতবড় ১৯৭১ চলে যাওয়ার পর ৫৫ বছরের মাথায় ২০২৪-কেও অপাঙ্ক্তেয় করে তোলা হচ্ছে। এভাবে যেমন ঝুলে গেছে রাষ্ট্রের জনমালিকানার বিষয়, নতুন বন্দোবস্তের সম্ভাবনা, তেমনি অপসৃয়মাণ হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জনগ্রহণযোগ্য সুযোগ।
মৌলিক পরিবর্তনের বিষয় ওপর মহলের চিন্তায় নেই। আরপিও’র ২০ ধারার সংশোধন নিয়েও বড় দল আপত্তি করেছিল। জোট গঠনের ক্ষেত্রে বড় শরিকের প্রতীক গ্রহণের সুযোগ রাখতে চেয়েছিল, আবার নিজ নিজ প্রতীক রাখতে চেয়েছিল কয়েকটি দল। বড় শরিকেরা নিজেদের কর্তৃত্ব, পরিচিতি ও দাপট বিস্তারে ব্যস্ত। আর ছোটরা বড়দের পরিচিতি ব্যবহার করে বৈতরণী পার হওয়ার বাসনায় ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই সুযোগ আর থাকছে না। প্রতীক ব্যবহার করে নির্বাচিত হওয়ার পর বেইমানির ইতিহাস নিকট অতীতে বাংলাদেশেই বারংবার ঘটেছে।
এখনো দেখা যাচ্ছে, অনেকে নানাভাবে পতিতদের দিয়ে দল ভারী করার কোনো সুযোগই ছাড়ছেন না। সবাই কানে কানে বার্তা দিয়ে দিচ্ছেন। নিচতলায় জনগণ যা-ই ভাবুক না কেন, বাস্তবে যা হচ্ছে তা হলো—‘তুমি আমাকে দেখো, আমি তোমাকে দেখব। মিল-মহব্বত ছাড়া যাবে না।’ পতিত ফ্যাসিস্টরা তাদের লুটের অর্থ থেকে কিছু বিনিয়োগ করছে। তাহলে নতুন বন্দোবস্ত আর নতুন রাষ্ট্র গঠন ও ব্যবস্থাপনা কীভাবে সম্ভব?
এটা একেবারেই বোধগম্য নয় যে, গণভোটের মাধ্যমে যেহেতু জনগণকে জিজ্ঞেস করা, তাদের মতামত যাচাই করা, তাদের ইচ্ছা ও সম্মতিকেই চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে, তাহলে কীভাবে একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হয়? কৃচ্ছ্রসাধন ও জটিলতার যুক্তি এক্ষেত্রে ন্যায্য নয়। আর তারা ভোট তো দেবে ক্ষমতা লাভের জন্য বিভিন্ন দল-সংগঠনের কিংবা জোটের অবস্থান দেখে, যা নির্ধারিত হবে তাদেরই দেওয়া গণভোটের ফলাফলের সঙ্গে সংগতি রাখা ও না-রাখার ঘোষিত প্রতিফলন বিবেচনাক্রমে।
আরো সমস্যা রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন, আমলাতন্ত্র, শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচনে নিয়োজিত পোলিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, রিটার্নিং অফিসার সব-ক্ষেত্রেই নিজ নিজ পর্যায়ে নিরপেক্ষতা, যোগ্যতা ও সামর্থ্য, জনআস্থা, ফ্যাসিবাদকালীন সংশ্লেষ ও ভূমিকা নিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন উঠেছে। এগুলোর মীমাংসা না করে ফ্যাসিবাদের ঘনিষ্ঠ ও দোসর আমলাতান্ত্রিক কাঠামো রেখে কীভাবে কায়দাকানুনের বাছাই কমিটি দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করে, আরপিও’কে বগলদাবা রেখে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম নির্বাচন দেওয়া সম্ভব? ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন অনেক ক্যারিকেচার করে ফেলেছে। তারা তাদের আগের উচ্চকিত ঘোষণা থেকে সরে এসেছে। সাফ জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচনে কেন্দ্রগুলোয় সিসি ক্যামেরা থাকবে না, ড্রোনের ব্যবহার হবে না, সাংবাদিকরা বিশেষ পূর্বানুমতি ছাড়া ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঢুকতে পারবেন না, ক্যামেরায় টেলিকাস্ট করা যাবে না এবং সামরিক বাহিনী সরাসরি স্ট্রাইক করবে না ভোটকেন্দ্রের ভেতরে। এছাড়া ১৬ বছরের দোসররাই এখন ডিসি হিসেবে রিটার্নিং অফিসার হয়ে নিয়ন্ত্রণ, ফলগ্রহণ ও ফলপ্রেরণের মহাজনি দায়িত্বে থাকবেন।
নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব স্বাধীন সিদ্ধান্তে তাদের নিজস্ব কিংবা বাছাইকৃত নিরপেক্ষ, দক্ষ, যোগ্য, সৎ ও সাহসী লোকবল দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা করার যোগ্যতা যে নেই, তা স্পষ্ট বোঝা গেছে। তারা এক মুহূর্তে গরম, পরমুহূর্তে নরম। তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডও তৈরি করতে পারেনি। ওপরে তাদের যেসব সিদ্ধান্তের বদলের কথা বলা হয়েছে, তা থেকেই স্পষ্ট যে, বাস্তবে ভোটকেন্দ্রের ভেতরের অবস্থা, ভোট গ্রহণ পরিস্থিতি, ভোট গণনা হালত এবং সব পর্যায়ে নিয়ম ও শৃঙ্খলা তারা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। রাজনৈতিক বড় শরিকেরা ওই ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। বোঝা যাচ্ছে, ফ্যাসিবাদের প্রকাশ্য অনুপস্থিতিতে তারা তাদের কাজেকর্মে গোলেমালে সহযোগী রেখে স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে যার মতো।
তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি তো সন্দেহে পড়ে গেল। আর বর্বরতা থেকে সভ্যতায় পৌঁছানোও কি মাঠে মারা যাবে? তবে এজন্য আমজনতাকেই সচেতন ও সক্রিয় হয়ে এগিয়ে আসতে হবে—কেউ করে দেবে না। আমরা বিবর থেকে বেরিয়ে এসে আবার বিবরেই ফিরে যেতে চাই না কোনোক্রমেই।
লেখক : প্রফেসর (অব.), রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়