দেড় দশকে বাংলাদেশ এক নজিরবিহীন রাজনৈতিক রূপান্তর দেখেছে। এ সময় বিরোধী দলকে নির্মূল করার প্রক্রিয়ায় সংবাদমাধ্যম যেমন সরাসরি সরকার ও সরকার সমর্থকদের আক্রমণের শিকার হয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের আইনগত সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন ও নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিয়েছে, তেমনি আদালতও সাংবাদিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিচারকদের কেউ কেউ রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করেছেন।
দেশের তিনজন সুপরিচিত সম্পাদককে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বারবার রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে এবং দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকতে হয়েছে। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়, তার ছাপাখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়, অন্য ছাপাখানায় পত্রিকা ছাপানোর অজুহাতে ডিক্লারেশন বাতিল করা হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যাচেষ্টা ও অপহরণ, গাড়ি পোড়ানোসহ মানহানির ১২৪টি মামলা দিয়ে কারাগারে দু-দফায় পাঁচ বছরের বেশি আটক রাখা হয়। শেখ হাসিনার মানহানির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় অনেক মামলা হয় এবং একটি মামলায় হাজিরা দিতে যাওয়ার সময় কুষ্টিয়া আদালত প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগ কর্মীরা তার ওপর হামলা চালায়। আহত অবস্থায় তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেও পুলিশ ব্যর্থ হয়। বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করার জন্য আদালত অবমাননার অভিযোগে তাকে দণ্ড দেওয়া হয়। এরপর কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে কথিত অপহরণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে একটি মামলায় আসামি করা হয়। জয়কে অপহরণের ষড়যন্ত্রের কথিত মামলায় যায়যায়দিন সম্পাদক অশীতিপর শফিক রেহমানকেও গ্রেপ্তার করা হয় এবং নেওয়া হয় রিমান্ডে। ২০১৯ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশের জেরে দৈনিক সংগ্রাম-এর সম্পাদক আবুল আসাদকে তার দপ্তরে ঢুকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা এবং তাকে পুলিশের কাছে তুলে দেয়। এরপর পুলিশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করে এবং প্রায় পাঁচ বছর তিনি বিচারাধীন বন্দি হিসেবে জেলে ছিলেন।
অন্য সম্পাদকদের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৫৫টি মামলা হয়। ২০০৬-০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, ডিজিএফআইয়ের সরবরাহ করা তথ্য অন্য কোনো সূত্র থেকে যাচাই না করে ছাপানো ভুল হয়েছিল বলে এক টিভি সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্যের জেরে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৮৪টি মামলা করা হয়, যার মধ্যে ১৬টি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহের। দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের হয়রানিমূলক মামলার কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন অধিকারগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এ সংখ্যা কয়েক ডজনের বেশি।
সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ ও রুহুল আমীন গাজীকে মামলা দিয়ে এক বছরের বেশি জেলে আটক রাখা হয়। এছাড়া মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। জেলে নেওয়া হয় সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকে। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য সম্প্রচারের জন্য একুশে টিভির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম ও সাংবাদিক কনক সরওয়ারকে কারাগারে পাঠানো হয়।
গণমাধ্যমের কাছ থেকে আনুগত্য আদায়ের জন্য বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা এবং শান্তিমূলক ব্যবস্থার চরম অপব্যবহার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রকাশনা ও সম্প্রচার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা; নিউজপ্রিন্ট ও সম্প্রচার সরঞ্জামসহ মুদ্রণসামগ্রীর ওপর সীমাবদ্ধ আমদানি শুল্ক আরোপ; সরকারি বিজ্ঞাপন বরাদ্দ : এ ধরনের বিজ্ঞাপনের অর্থ পরিশোধে বিলম্ব করা; সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অফিশিয়াল কার্যক্রমে প্রবেশাধিকার সীমিত করা; সরকারি ও অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ প্রদান; হুমকি ও হয়রানির জন্য আইন প্রয়োগ করা এবং মাঝেমধ্যে সহিংসতার আশ্রয় নেওয়া।