হোম > মতামত

আওয়ামী বয়ান জনপ্রিয় বানাবেন কী দিয়ে

খাজা মাঈন উদ্দিন

আওয়ামী লীগ ফিরছে, শেখ হাসিনা ‘চট করে’ দেশে ঢুকে পড়ছেন এবং নির্বাচন আয়োজন ভন্ডুল হয়ে যাচ্ছে—ইত্যাকার গুজব ইদানীং ডালপালা গজাচ্ছে। এই গুজব ছড়াচ্ছে একপেশে নেটওয়ার্কিং গ্রুপগুলোয়। এই গুজব ছড়াচ্ছে কিছুকাল মুখ বন্ধ রাখা কিছু মানুষের মুখে মুখে।

শোনা যাচ্ছে, অতি আশাবাদী আওয়ামী সমর্থক গোষ্ঠীর বিশ্বাস, তাদের নিষিদ্ধ দলের ভার্চুয়াল (স্বতন্ত্র) প্রার্থীরা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের ৩৩ শতাংশ বা শ-খানেক আসন পাবেন।

বোঝা যাচ্ছে, পরাস্ত হওয়া দলীয় বয়ান পুনরুজ্জীবিত করতে গোপনে গোপনে মরিয়া আওয়ামী নেতৃত্ব মাঠে নামিয়েছেন তাদের ‘বি’, ‘সি’ ও ‘ডি’ টিমগুলোকে।

১৫ আগস্ট এবং আশপাশে পতিত আওয়ামী লীগের সমর্থক কিছু নট-নটী ও মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব ৫০ বছর আগে একদলীয় বাকশালী শাসক শেখ মুজিবুর রহমানের সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার দিনটিকে উপলক্ষ বানানোর উদ্যোগ নেন।

তাদের সাধারণ ‘বাণী’ বলে দেয়, তাদের মূল মোক্ষ হলো ২০২৪ এবং পূর্ববর্তী আওয়ামী হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের সত্য আড়াল করা। তাদের লক্ষ্য ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও গণতন্ত্রপন্থি যাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

এখানে-সেখানে ‘চেতনা’র উসকানিতে একটু অরাজকতা তৈরি করতে পারলে ‘একদিনও শান্তিতে থাকতে দেব না’ নীতিতেও অবদান রাখা যায় আরকি।

শুধু তাদের প্রচার এবং গণমানুষের মনোভঙ্গির মধ্যে ফারাকটা ‘আমি কী কই আর আমার সারিন্দা কী কয়’ প্রবাদের সমতুল্য। ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর কথা যাদের, তারাই দেখান আস্ফালন। এই আস্ফালন তারা দেখান কারো প্রশ্রয়ে, কারো দুর্বলতায়!

জুলাই-আগস্ট-২০২৪-এর হত্যাকাণ্ড, দেড় দশকের আওয়ামী নিপীড়নের প্রতিবাদ এবং এমনকি ঘটে যাওয়া ঘটনা স্বীকার না করা এই গোষ্ঠী নিজেদের গণবিরোধী, স্বদেশবিরোধী ভাবমূর্তি সম্পর্কে বড়ই বেখবর!

জীবন ও প্রকৃতি থেকেও তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাটা নেননি।

১৯৮০, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বড় বন্যা দেখার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারা জানেন, প্লাবিত অঞ্চলে বন্যপ্রাণীর মধ্যে প্রচুর শিয়াল নির্মূল হয় এবং এরপর অনেক দিন শিয়ালের উপদ্রব থাকে না বললেই চলে।

ঠিক বন্যার সময় উঁচু বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া শিয়াল উঠানে চলাচল করা মুরগি পর্যন্ত ধরে না, পাছে বানে ভাসতে হয়, এই ভয়ে। পানি কমতে থাকলে দু-একটি শিয়াল ক্ষুধার জ্বালায় ভুল করে বসে, গৃহস্থের মুরগি ধরে পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত আশ্রয়স্থল জঙ্গল বা কবরস্থানে ফিরে দু-চারটি শিয়াল যখন হুক্কাহুয়া গান ধরে, তখন তারা সহজেই গ্রামবাসীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

৫ আগস্ট গণমিছিলের বন্যায় ভেসে যায় হাসিনার অন্যায় রাজত্ব এবং এর হালুয়া-রুটি-মাংসের ভাগীদাররা। তারা সবাই হাওয়া হয়েছিলেন প্রাণভয়ে। কিন্তু সাড়ে ১৫ বছরে তাদের যে কৃতকর্ম, তাদের গণশত্রু বানিয়েছে, সে বিষয়ে তারা পাত্তাই দেননি।

২০২৪ সালের রক্তঝরা বিপ্লবের ডাকে জেগে ওঠা নতুন বাংলাদেশে দু-চারটি পরাজিত শক্তি মাথা জাগালে তাদের কারা কোন নৈতিক বলে সমর্থন জোগাবে, তা এক বড় প্রশ্ন।

অবশ্য কিছু রাজনৈতিক সহযোগী ও আর্থিক সুবিধাভোগীকে দেখা যাচ্ছে, যারা সময় ভুলে চতুর ছুতোয়, ভিন্ন কায়দায় আওয়ামী ভাষ্য ও ‘ঐতিহ্যের’ অনুরণন তুলছেন।

তারা বেশি বেশি উচ্চারণ করছেন স্বাধীনতাযুদ্ধের বছর ‘১৯৭১’ এবং ছাত্রলীগ প্রদত্ত মুজিব উপাধি ‘বঙ্গবন্ধু’, যেন এর ফলে তাদের ‘সাত (আদতে সহস্র) খুন মাফ’ হয়ে থাকে চিরদিনই।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে অন্যদের মধ্যে ছাত্রলীগের সমর্থক বন্ধুদের মুখেও আবৃত্তি শুনেছি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘বিদ্রোহের গান’ কবিতার চরণ : ‘মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি,/ চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি/ রুখবে কে আর এ অগ্রগতি,/ সাধ্য কার?’

আহা, সেই দিন আজ শুধুই অতীত! ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের এক বছর যেতে না যেতেই এখানে এমন কোনো নতুন চর জাগেনি যে, তাদের একদল লাঠিয়াল এসে দখল করে নেবে।

বরং আওয়ামী লীগের শক্তি ও লোকবল সংকুচিত হয়েছে এবং যারা পালিয়ে গেছেন বা আছেন, তাদের অধিকাংশের মনোবল এখন অডিওতে শোনা হাসিনার ‘হম্বিতম্বির’ ঠিক উল্টো।

সুতরাং চলমান রাজনীতির ধারা উল্টিয়ে ফেলে আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটানোর সম্ভাবনা আপাতত শূন্যের কোঠায়।

যুক্তি দেবেন, ১৯৭৫ সালে আওয়ামী বাকশালের পতনের পর ১৯৯৬ সালে দলটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল। ভুলে যাচ্ছেন, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বয়স তখন কত ছিল এবং আজ কত। এখনকার তুলনামূলক তরুণ আওয়ামী নেতারা পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী অথবা অলিগার্কের তকমায় কলঙ্কিত।

তাদের মধ্য চল্লিশোর্ধ্ব রাজনৈতিক সমর্থক প্রজন্ম নিঃশেষিত হওয়ার পথে। অন্যদিকে সমকালীন প্রজন্মের প্রায় পুরোটাই আওয়ামী রাজনীতির বাইরের।

অনুমান করি, দেশে সর্বসাম্প্রতিক কট্টর আওয়ামী ভোটারের হার বড়জোর ৫ শতাংশ। এরা তারাই, যারা ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনেও ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিল।

২৫ থেকে ৩০ শতাংশ আওয়ামী ভোটব্যাংকের কারো কারো দাবি ঠিক হলে শেখ হাসিনা তিন তিনটি সাজানো ও কারচুপির নির্বাচন করার ঐতিহাসিক ঝুঁকি নিতেন না নিশ্চয়ই।

তাই ভোটাধিকারসহ স্বীকৃত অধিকাংশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করা শক্তি কোন বুলির জাদুবলে এ দেশবাসীকে বশীভূত করবে, আবারও?

নতুন রাজনৈতিক পাঠকদের জন্য স্মরণ করা যেতে পারে, আওয়ামী বয়ানের অন্যতম ছিল ‘ভোট ও ভাতের রাজনীতি’, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, ‘স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা (আসলে ‘সেক্যুলারিজম’)’, ‘মৌলবাদ বিরোধিতা’ এবং ‘বৈষম্যহীন সমাজ গঠন’।

হাসিনার আওয়ামী লীগের বাস্তব অবস্থান ছিল ভোটাধিকার এবং দেশের জনগণ ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে। তার অবস্থান হলো একটি অলিগার্কির স্বৈরাচারী শাসন চিরস্থায়ী করার পক্ষে।

দলটির সব বাগাড়ম্বরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেই শুধু গণজাগরণ ও জনস্রোত তৈরি হয় এবং তা ছাত্র-জনতার প্রধান ঘাতক হাসিনাকে ধাওয়া করে। ‘ক্রিমিনাল মাইন্ড’ বলেই তিনি সহস্র নেতাকর্মী-সমর্থকের অজান্তে ভারতে পাড়ি জমান।

মতাদর্শিকভাবে আওয়ামী লীগ বারবার নির্বাচন ধ্বংস করে একদলীয় শাসন কায়েম এবং ভিন্নমত নির্মূলের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে দলটি চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ফ্যাসিবাদী চরিত্রের।

যে গণতান্ত্রিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া এখন চলমান, সেখানে আওয়ামী লীগের কোনো জায়গা নেই। তার ছদ্মবেশী নির্বাচনি প্রার্থীরা পর্যন্ত কোন মুখে ভোট চাইবেন তাদের দ্বারা ভোটবঞ্চিত মানুষের কাছে?

আওয়ামী বয়ানের সংকটটিও তাই আওয়ামী রাজনীতির সংকট। প্রায় পাঁচ দশক জমজমাট ব্যবসা করা দলীয় আখ্যানের ‘পুরান চান’ ঘুণে ‘খাইছে’ ইতোমধ্যেই। হাসিনার রাজনীতির একসময়ের কার্যকর অস্ত্র ‘ভিকটিম কার্ড’ও অচল।

জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ৪০-এর কমবয়সি তরুণদের প্রায় পুরো প্রজন্মের কাছে বিরক্তি উৎপাদনকারী এবং ভীতিকর এই বয়ান। গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা এই প্রজন্মই আগামী অর্ধশতকের বাংলাদেশ।

লেখক : সাংবাদিক

বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি কৌশল

নদীর বুকে বিষের স্রোত

ইসলামে সময়ের গুরুত্ব

যুক্তরাষ্ট্র কি গাজায় সংঘাতে জড়াবে?

আস্থাহীন উদ্যোক্তা স্থবির কর্মসংস্থান

ভারতের প্রেসক্রিপশনে গোয়েন্দা সংস্থার অবক্ষয়

রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ন্যায়বিচারে যুগান্তকারী ঘটনা

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং বাড়াতে যা প্রয়োজন

ইউক্যালিপটাস আকাশমণি ও সেগুনের কথা

আগামী সংসদ নির্বাচনে ভারত ফ্যাক্টর