স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানোর জন্য ভালো ডাক্তার, ভালো মেডিকেল কলেজ, উন্নত যন্ত্রপাতি ও সঠিক ওষুধ যেমন জরুরি, তেমনি দেশের স্বাস্থ্য সমস্যার সঠিক চিত্রটা জনগণের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি খাতের দুর্বলতার পাশাপাশি জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবার প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার ক্ষেত্রেও তথ্যের অভাব বা দুর্বলতা রয়েছে।
গত ১১ অক্টোবর আমার দেশ-এ দেশের ক্যানসার চিকিৎসার দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে সাংবাদিক-প্রতিবেদক যা লিখেছেন, তা এই শোচনীয় অবস্থারই প্রতিফলন। সরকারি সব পর্যায়ে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে চিকিৎসার অপ্রতুলতা শুধু যে ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রেই হয়, তা নয়; বরং সব রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রেই এসব কথা প্রযোজ্য। তদুপরি বেসরকারি খাতে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের প্ররোচনায় দুর্বল নৈতিকতার স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীদের অসহায়ত্ব ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভুলভাল চিকিৎসা প্রদান করে চিকিৎসার ব্যয় অত্যধিক বাড়িয়ে দেন।
সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের নানামুখী সমস্যার কারণে রোগীদের অনেকেই নানা হয়রানি শেষে বিদেশমুখী হওয়াকেই শ্রেয় মনে করেন।
কয়েক দশক ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে সাধারণ রোগে মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়ে মানুষের আয়ু বেড়েছে। সহজ রোগে মৃত্যুর হার কমে গিয়ে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও এখন ক্যানসার মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। সুতরাং ক্যানসার চিকিৎসাসেবার সমস্যাগুলো নিয়ে মানুষের আগ্রহ ব্যাপকতর হয়েছে। এই আগ্রহের পরিণতিতেই এখন আমাদের জানা দরকার, আসলে দেশের ক্যানসার চিকিৎসাসেবার অবস্থা কোন জায়গায় রয়েছে এবং কীভাবে আমরা ক্যানসার চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধি করতে পারি। এ বিবেচনায় উল্লেখিত সংবাদ প্রতিবেদনটি খুবই সময়োপযোগী।
কিন্তু আমার দেশ-এ প্রকাশিত লেখাটি পড়ে মনে হতে পারে যে, PET Scan হলো ক্যানসারের আধুনিকতম চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং এর ব্যবহারকে সহজলভ্য করতে পারলেই বাংলাদেশ ক্যানসার চিকিৎসার উন্নত যুগে প্রবেশ করবে। একজন রক্তরোগ তথা ব্লাড ক্যানসার বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিদেশে ও দেশে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, এ ধারণাটি যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর।
প্রথমেই আমাদের জানা দরকার, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির মতো PET Scan ক্যানসারের চিকিৎসা পদ্ধতি (Treatment/Therapy) নয়। এটি হলো একটি ব্যয়বহুল রোগনির্ণায়ক বা Diagnostic পদ্ধতি মাত্র। বহু রোগের চিকিৎসায় সিটি স্ক্যান ও এমআরআই যেরকমভাবে এক্স-রে’র মতো রোগনির্ণায়ক বা ডায়াগনস্টিক পদ্ধতির তুলনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, ক্যানসার নির্ণয়ে PET Scan-এর আবির্ভাব কিছুটা উন্নতি ঘটালেও তেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারেনি। অথচ এটির খরচ কিন্তু অন্যান্য diagnostic পদ্ধতির তুলনায় যথেষ্ট বেশি। এখন একজন রোগীর আর্থিক সক্ষমতা এ ডায়াগনস্টিক পদ্ধতি ব্যবহার করলে কতটুকু লাভ হবে—এসব বিবেচনায় না এনেই যদি সব রোগীকে পিইটি স্ক্যান (PET Scan) করা অত্যাবশ্যক বলে পরামর্শ দেওয়া হয়, তাহলে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হয়তো প্রচুর মুনাফা হবে, ডাক্তারের কমিশন বাড়বে; কিন্তু রোগী হয়তো তার শেষ সম্বল ভিটেমাটি বিক্রি করেও তেমন উপকৃত নাও হতে পারেন।
আমার স্বল্প জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বলে, ক্যানসার চিকিৎসার জন্য দামি দামি মেশিন আর একক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের চেয়ে বেশি প্রয়োজন একটি টিম ওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা। অন্যান্য অনেক চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শই রোগীর জন্য যথেষ্ট হলেও ক্যানসার চিকিৎসায় প্রয়োজন একটি সুপ্রশিক্ষিত দল, যারা রোগীর বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ এবং মানসিক ও সামাজিক অবস্থার বিচারে বহুমাত্রিক পরিচর্যার ব্যবস্থাপনা করবেন। বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসায় দামি যন্ত্রপাতি আমদানির কাজে ব্যবসায়ী ও কর্তাব্যক্তিদের যতটা উৎসাহ দেখা যায়, তার একটা ভগ্নাংশও যদি ক্যানসার ব্যবস্থাপনার জন্য উপযুক্ত টিম গঠনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় লোকবল নির্বাচন ও প্রশিক্ষণের ওপর থাকত, তাহলে হয়তো বহু রোগী অপ্রয়োজনীয় হয়রানি, ব্যয় ও অকাল মৃত্যু থেকে রক্ষা পেত।
লেখাটির প্রথমে শাহাদত হোসেনের যে হয়রানি এবং ২৪ লাখ টাকা চিকিৎসাব্যয়ের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে, সে রোগটি ছিল একটি সহজে নিরাময়যোগ্য ক্যানসার (মনে রাখতে হবে, ক্যানসার আসলে অনেকগুলো রোগের নাম, সব ক্যানসার সহজে নিরাময়যোগ্য নয়)। বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য, তা দিয়ে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা ব্যয়ে বেসরকারি ক্লিনিকেই এই অ্যাকিউট প্রোমায়েলোসাইটিক লিউকেমিয়া রোগের চিকিৎসা সম্ভব হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু তা হয়নি। তাকে বিদেশে যেতে হলো।
লেখক এ সমস্যার গভীরে গেলেই বুঝতে পারতেন, ক্যানসার চিকিৎসায় আমাদের প্রধান প্রতিবন্ধক আধুনিক ও উন্নত মানের চিকিৎসার সরঞ্জামের অভাব নয়, অভাব হচ্ছে শৃঙ্খলার। সেইসঙ্গে যেসব সরঞ্জাম আছে, সেগুলোর সঠিক ব্যবহারকল্পে টিম ওয়ার্কেরও অভাব রয়েছে।
লেখক তার লেখার শুরুতে যে দুজন রোগীর উদাহরণ টেনেছেন, তারা কেউই কিন্তু প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হননি। তারা চিকিৎসা-শৃঙ্খলার অনুপস্থিতির কারণেই সুচিকিৎসার সুযোগ পাননি। অথচ লেখক বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার অবস্থান নিয়ে যেসব বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছেন, তারা কেবল প্রযুক্তিগত দুর্বলতা বা অনুপস্থিতির কথাই তুলে ধরেছেন। তাই লেখক উপসংহারও টেনেছেন এভাবে যে, বাংলাদেশে প্রযুক্তি বিস্তারের মাঝেই বুঝি ক্যানসার চিকিৎসার সঠিক সমাধান নিহিত আছে।
বস্তুত সুপরামর্শ ও সঠিক জ্ঞানের অভাবে অনেক সহজে নিরাময়যোগ্য ক্যানসার রোগী কখনো কখনো অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করার পরও নানা অপমান ও হয়রানি শেষে কবরে অকাল যাত্রার প্রস্তুতি নেন।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়; রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, কিং ফয়সাল স্পেশালিস্ট হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, রিয়াদ, সৌদি আরব