চট্টগ্রাম নগর ও জেলার একের পর এক হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মুহাম্মদ রায়হান এখন র্যাবের ‘টার্গেট ওয়ান’।
শনিবার গভীর রাতে ফটিকছড়ির পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালায় র্যাব। তবে আগেভাগেই খবর পেয়ে পালিয়ে যান রায়হান।
বিএনপির প্রার্থী গণসংযোগে ঢুকে সরওয়ার হোসেন বাবলা হত্যার পর থেকেই তার খোঁজে মরিয়া র্যাব-৭।
র্যাব ও পুলিশের ভাষ্য, পাহাড়ি এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে রায়হান চট্টগ্রামে একের পর এক খুন ও গোলাগুলির ঘটনায় জড়িত। বাবলা হত্যার পাশাপাশি রাউজানে যুবদল কর্মী আলমগীর ওরফে আলম হত্যারও মূল হোতা তিনি। সর্বশেষ ৫ নভেম্বর বায়েজিদের চালিতাতলী এলাকায় চট্টগ্রাম-৯ আসনের বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগে ঢুকে সরওয়ার হোসেন বাবলাকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ পরিবারের।
পুলিশ জানায়, সরওয়ারকে গুলি করার আগে থেকেই তাকে হুমকি দিচ্ছিল রায়হান।
একটি অডিওতে রায়হানকে বলতে শোনা যায়, সরওয়ার বাবলা চট্টগ্রামে বাঁচতে পারবে না। তাকে মেরে আমি রাউজানে ঢুকবো’। হুমকির ঠিক কয়েক সপ্তাহ পর গুলিতে মারা যান বাবলা।
চট্টগ্রাম উত্তর পুলিশের উপ-কমিশনার আমিরুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, বাবলা খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রধান অভিযুক্ত রায়হানকে ধরতেও পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।
রায়হানের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানের সদর ইউনিয়নে। রাউজানের জুরুরকুল খলিফা বাড়ির মৃত বদিউল আলমের ছেলে রায়হান। একসময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের মিছিলে দেখা যেত। পরে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হন। তার পরিচয় এখন শুধু একটাই-চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের ডানহাত। সাজ্জাদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার অস্ত্রভাণ্ডার দেখভাল করছে রায়হানই। নগরের কুখ্যাত ‘কিলিং স্কোয়াড’-এর অন্যতম সদস্য রায়হান।
৪ হত্যায় রায়হানের নাম পুলিশ ও র্যাবের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রায়হান বড় সাজ্জাদের নির্দেশে ‘টার্গেট অপারেশন’ পরিচালনা করে। ছোটো সাজ্জাদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর বড় সাজ্জাদের অপারেশন পরিচালনা করছে রায়হান। ছোটো সাজ্জাদ জেলে থাকলেও তার নির্দেশ জেলখানা থেকেই পৌঁছে যায় রায়হানের হাতে। এরপর থেকে খুন, চাঁদাবাজি ও এলাকায় প্রভাব বিস্তারের দায়িত্বে মূল নেতৃত্ব দেন তিনি।
র্যাব বলছে, রায়হানের দল এখন ৮ থেকে ১০ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপে পরিণত হয়েছে। তাদের হাতে বিদেশি পিস্তল, একে-২২ ও এলজি থাকে। টার্গেট ঠিক হলেই মোটরসাইকেলে করে এসে গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায় তারা। বাবলা হত্যার দিনও একই কৌশল ব্যবহার হয়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি।
নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রায়হান সাজ্জাদ বাহিনীর কোর টিমে আছে। ওরা শুধু ভয় দেখায় না, টার্গেট পেলে হত্যা করে। সাজ্জাদের গ্রেপ্তারের পর রায়হান পুরো গ্রুপটা চালাচ্ছে।
রায়হানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ছয়টি মামলা রয়েছে-এর মধ্যে চারটি হত্যা ও দু’টি অস্ত্র মামলা। তবুও তাকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। র্যাবের কর্মকর্তারা জানান, পাহাড়ি এলাকা ও সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলোতে তিনি লুকিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
র্যাবের একটি সূত্র জানায়, রায়হান এখন আমাদের টার্গেট ওয়ান। বাবলা হত্যাসহ কয়েকটি খুনের নেপথ্যে তার সম্পৃক্ততা মিলেছে। আমরা খুব শিগগিরই তাকে আইনের আওতায় আনব।
বাবলা ছাড়াও গত অক্টোবরে রাউজানে যুবদলকর্মী মুহাম্মদ আলমগীর আলমকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ‘সন্ত্রাসী’ রায়হানের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। এক ব্যক্তির সঙ্গে মুঠোফোনে আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেও ‘সন্ত্রাসী’ রায়হানকে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করতে দেখা গেছে আলমকে।
তারপর কয়েকদিন পর মোটরসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার সময় রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চারাবটতল বাজারসংলগ্ন কায়কোবাদ জামে মসজিদের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় আলমকে। এ সময় তার স্ত্রী ও সন্তান পেছনে একটি অটোরিকশায় ছিলেন। পাশের গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে দাওয়াত খেয়ে বাড়িতে ফিরছিলেন তারা। আলমের বাড়ি পার্শ্ববর্তী ঢালারমুখ এলাকায়।
নিহত আলমের ছেলে আশফায়েত হাসেন বলেন, আমার চোখের সামনেই বাবাকে গুলি করে হত্যা করেছে রায়হান। বাবার সঙ্গে থাকা দু’জনও গুলিবিদ্ধ হন। আমার ধারণা, কেউ আগে থেকে পরিকল্পনা করে ভাড়াটে রায়হানকে দিয়ে বাবাকে খুন করিয়েছে।
নিহত বাবলার ছোট ভাই মো. ইমরান খান আজিজ বলেন, আমার ভাই বাবলাকেও রায়হান হত্যা করেছে। গুলির করে দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে দেখেন।
গত ৩০ মার্চ নগরীর বাকলিয়া এক্সেস রোডে প্রাইভেটকারে থাকা বখতিয়ার হোসেন মানিক ও আব্দুল্লাহ আল রিফাতকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মামলায় ছোট সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী তামান্নার সঙ্গে রায়হানকেও আসামি করা হয়। পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করলেও রায়হান এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, রায়হান কথায় কথায় গুলি ছোড়ে। রাউজান ও ফটিকছড়ির পাহাড়ি এলাকায় তার আস্তানা।
সেখান থেকে এসে অপরাধ করে, আবার দ্রুত পাহাড়ে পালিয়ে যায়। সাজ্জাদের কাছ থেকেই তিনি অস্ত্র চালানো ও ভয় সৃষ্টি শেখেন।