কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক ড. মাহবুব হাসান আমার প্রাণের বন্ধু। তিনি বেশ ক’বছর নিউ ইয়র্কে ছিলেন, এখানে আমাদের বাসা কাছাকাছিই ছিল। রোজ বিকালে একসঙ্গে হেঁটে আমাদের চিনিরোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতাম। জ্যামাইকার একটি রেস্টুরেন্টে বসে এক কাপ চা আর একটি নানরুটি দুজনে ভাগ করে খেতাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতাম। এরকম কম খরুচে কাস্টমারদের রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ বেশিক্ষণ বসতে দিত না যদিও, কিন্তু আমাদের কখনো ওরা উঠে যেতে বলেনি। বরং আমাদের আলোচনা শুনে মেয়েগুলো বুঝে ফেলেছিল, এরা ভিন্ন জাতের প্রাণী, এদের নাম কবি। এখন সেসব রেস্টুরেন্টে গেলে প্রায়ই মেয়েগুলো জানতে চায়, এখনো আমি কবিতা লিখি কি না।
ঢাকায় গেলে আমি যে বাসায় থাকি, সেটি আমার ছোট ভাই বিটনের বাসা, বনশ্রীর ই ব্লকে। একই ব্লকে মাহবুব হাসানও থাকেন। কাজেই আমাদের নিউ ইয়র্কের যুগল হাঁটাটা এখানেও অব্যাহত রাখতে পারছি। আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন দিই। মাহবুব হাসান ধরেই বলেন, ‘আপনি কি ঢাকায়?’
শুরু হয়ে যায় আমাদের ভোরের হাঁটা। ই এবং এফ ব্লকের মাঝখানে যে অ্যাভেন্যুটি আছে, এর কোনো নাম নেই। এই অ্যাভেন্যুর দুপাশে বসবাস করেন কবি জাহিদুল হক, কবি মাহবুব হাসান, কবি রহিম শাহ, কবি জাকির আবু জাফর, কবি জুবায়ের মাহমুদ এবং একটু দূরেই কবি জাহিদ হায়দার। অস্থায়ী বাসিন্দা আমি তো আছিই। আমরা ফোনে যখন একে অন্যকে ডাকি, অবস্থান বলি, তখন এই অ্যাভেন্যুটি কোথায় তা ব্যাখ্যা করে বলতে হয়, ‘ওই যে ই এবং এফ ব্লকের মাঝখানে যে একটা রাস্তা আছে না, সেই রাস্তার মাথায়।’ ধ্যাৎ, এত কথার কী দরকার, এই রাস্তার আশেপাশে বাংলা ভাষার এত কবি বসবাস করেন, এর একটা নাম থাকবে না? মাহবুব ভাইকে বলি, ‘আমি পোয়েটস অ্যাভেন্যুতে আছি, চলে আসেন।’ মাহবুব ভাই অবাক হন, ‘এটা আবার কোথায়?’ জাহিদুল হক ভাই বলেন, ‘যথার্থ নাম হয়েছে। ব্যস, হয়ে গেল।’
আমরা এখন রোজ সকালে হাঁটাহাঁটি শেষ করে পোয়েটস অ্যাভেন্যুর সান্দ্রা রেস্টুরেন্টে বসি। একটি তেলে ভাজা ক্রিস্পি পরোটা দুধ-চায়ে ডুবিয়ে খাই। মাহবুব হাসান আর আমি অবধারিত, থাকিই, অন্যদের মধ্যে জাহিদুল হক, রহিম শাহ, জাকির আবু জাফর, জুবায়ের মাহমুদসহ বনশ্রীর আরো ক’জন কবি, লেখক ও সাংবাদিক যুক্ত হন। পোয়েটস অ্যাভেন্যুর সকালের আড্ডার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরে খিলগাঁও থেকে আসতে শুরু করেন গাজী রফিক, নিকেতন থেকে আসেন আবৃত্তি শিল্পী ও ব্যাংকার কাজী ওয়াহেদ, শাহীনবাগ থেকে আসেন ফেরদৌস সালাম। পোয়েটস অ্যাভেন্যুর আড্ডাটা বেশ জমে ওঠে।
মোহাম্মদপুর থেকে কবি আতাহার খান ফোন করে বলেন, পোয়েটস অ্যাভেন্যুতে আসতে চাই। ঢাকার কবিমহলে পোয়েটস অ্যাভেন্যুর সান্দ্রা রেস্টুরেন্ট ক্রমেই হয়ে উঠছে একালের বিউটি বোর্ডিং।
দ্বিতীয় দিন পোয়েটস অ্যাভেন্যুতে আমি আর জাহিদুল হক দাঁড়িয়ে আছি, সিগারেট টানছি। তখন এক যুবক কাছে এসে বলেন, ‘স্যার, আপনি কবে এসেছেন?’ আমি ওকে চিনতে পারি না। যুবক নাম বলে, আমি চিনি। কিন্তু অস্বস্তিকর ব্যাপার হচ্ছে, এই মুহূর্তে ওর নামটি আমি ভুলে গেছি। জাহিদ ভাই ষাটের দশকের কবি। জ্যেষ্ঠ কবি। যুবক যখন বলছে, সে আমার ভক্ত, তখন আমি খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ি; বলি, ‘উনাকে চেন?’ ও বলে, ‘না স্যার।’ আমি বলি, “কবি জাহিদুল হক। অনেক বড় কবি। সুবীর নন্দীর গাওয়া ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়/ তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ এই গানটি শুনেছ?”
অবশ্যই শুনেছি।
এটি জাহিদ ভাইয়ের লেখা।
যুবক তখন লজ্জা পায়। সরি স্যার, চিনতে পারিনি, ক্ষমা করবেন।
জাহিদ ভাই বলেন, না, না, কোনো অসুবিধা নেই।
জাহিদ ভাই ডয়েচে ভ্যালিতে কাজ করেছেন একসময়। বেশ খানিকটা সময় জার্মানিতে কাটিয়েছেন। জার্মান ভাষাও কিছুটা শিখেছেন। ইউরোপীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তার শুধু আগ্রহই নয়, অনেকটা পক্ষপাতিত্বও আছে। শিল্প-সাহিত্যের আলোচনায় জাহিদ ভাই শুধুই ইউরোপীয় রেফারেন্স টানেন। তার কবিতাতেও মিকেলাঞ্জেলো, গগ্যা, লরেল, বোদলেয়ার, মোৎসার্ট, রাইনার মারিয়া রিলকে, পেত্রার্ক, শেক্সপিয়ার, মিল্টন, অডেন, এডমুন্ড স্পেন্সার, র্যঁদা প্রমুখের ছড়াছড়ি। আড়ালে আমরা প্রায়ই বলি, জাহিদ ভাই এখনো ইউরোপ থেকে ফিরতে পারলেন না। অবশ্য জাহিদুল হক এ নিয়ে কোনো অস্বস্তি বা অপূর্ণতা অনুভব করেন না। তিনি বরং ইউরোপেই থাকতে চান।
অনেকেই ইউরোপে যায়, আমেরিকায় যায়; কিন্তু জাহিদুল হকের মতো এমন উল্টেপাল্টে ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যকে দেখার চোখ সকলের থাকে না। সোফিয়া লরেনের ইন্টারভ্যু নিতে গিয়ে রোমের একটি অ্যাপার্টমেন্টে সোফিয়ার সঙ্গে সারা দিন কাটানো এবং দুজনে একসঙ্গে রান্না করার গল্পটা আমাকে দারুণ আনন্দ দিয়েছে। মিকেলাঞ্জোলার গড়া বিব্লিক্যাল চরিত্র ডেভিডের ভাস্কর্য জাহিদুল হকের মতো অমন খুঁটিয়ে আর কোনো বাঙালি দেখেছে? জাহিদ ভাইও আমার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন যে, মিকেলাঞ্জেলো ছিলেন দানবীয় ক্ষমতাসম্পন্ন একজন শিল্পী। ‘শ্বেতভেনাসের প্রেমে তোমারই মতন বহুদিন/ আমিও পড়েছি, শুধু এই জন্যে, যে প্রণয়নিষ্ঠা দীপ্র করে প্রতিভাকে।’ নিজের প্রতিভাকে উজ্জ্বলতর করার জন্য জাহিদুল হক ‘শ্বেতভেনাসের’ প্রেমে শুধু পড়েনইনি, আজও আকণ্ঠ নিমজ্জিত।
জুবায়ের আল মাহমুদ কবিতা লেখেন, গান লেখেন; পোয়েটস অ্যাভেন্যুর আড্ডাটি গড়ে না উঠলে তার সঙ্গে আমার হয়তো দেখাই হতো না। একদিন রহিম শাহ আসেন। অনেক কথা হয়, গল্প হয়। তিনি একটি প্রকাশনা সংস্থার বড় কর্তা, সংস্থাটি আমার বেশ কিছু বই তার যোগদানের আগেই ছেপেছে। তিনি আমার কাছে নতুন গদ্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি চাইলেন। জাকির আবু জাফর নব্বুইয়ের দশকের কবি, একটি দৈনিক কাগজের ফিচার সম্পাদক। তার সঙ্গেও আড্ডা দেবার সুযোগ ঘটে গেল। মজার ব্যাপার হলো পোয়েটস অ্যাভেন্যুর আড্ডা এতটাই জমে ওঠে যে, প্রায়ই দূর-দূরান্ত থেকে কবিরা এসে আমাকে ফোন করে বলেন, কাউকে দেখছি না কেন, আপনারা কোথায়?
কবি গাজী রফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণ করেছেন ইতিহাসে, কিন্তু এখন তিনি একজন বিজ্ঞানী। গমের গ্লুটিন কমানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। ভাতের ফেন না ফেলে ভাত রান্না করলে কত শতাংশ চালের অপচয় কমে তা নির্ণয় করেছেন। এসব নিয়ে তিনি লম্বা লেকচার দেন একদিন। আমরা বিরক্ত হলেও মন দিয়ে শুনেছি।
শাহীনবাগ থেকে ছুটে আসেন কবি ফেরদৌস সালাম। সদ্য আমেরিকা ফেরত সালাম তার মার্কিন অভিজ্ঞতার স্মৃতি রোমন্থন করেন। মাহবুব হাসান সেসব শুনে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। কাছেই কোনো এক কলেজে অধ্যাপনা করেন বাংলার অধ্যাপক নুরুন্নাহার ডলি, তিনিও হাঁটতে হাঁটতে একদিন চলে আসেন। একদিন এসে হাজির হন আমার সহপাঠী মহুয়া। আমার এক বন্ধু ও পুরোনো সহকর্মী রুহুল আমীন, যিনি এখন এভারকেয়ার হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক, তিনিও যোগ দেন বেশ কয়েক দিন। আরো অনেকেই এসেছেন, তাদের সকলের নাম মনে নেই এই মুহূর্তে। তিন সপ্তাহের ঢাকাবাসকালে পোয়েটস অ্যাভেন্যুর আড্ডাটা ছিল আমার জন্য একটি বড় স্বস্তির ও আনন্দের জায়গা। প্রতি রাতে আমি একটি আনন্দময় ভোরের প্রতীক্ষা নিয়ে ঘুমুতে যেতাম। আশা করছি, আমার অবর্তমানেও পোয়েটস অ্যাভেন্যুতে গড়ে ওঠা এই ভোরের আড্ডাটি বহমান থাকবে।