স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠনের প্রস্তাব
সারা দেশে ২১,২৩২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩,৩০,২৮৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী, ১০,৬৩,৪২২ জন শিক্ষার্থী দেখভাল করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর- মাউশি'তে মাত্র একজন উপপরিচালক ও দুইজন সহকারী পরিচালক রয়েছে।
কলেজ ও মাধ্যমিক স্কুলের সমন্বয়ে বিশাল সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মন্থর গতি, দীর্ঘসূত্রিতা আর জনবল সংকটের কারণে ভোগান্তি নিত্যকার বিষয়। উপরন্তু স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের বয়স ও মানসিকতা একেবারেই ভিন্ন। তাদের কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক ও পাঠদান সম্পূর্ণভাবে আলাদা। আবার উভয় পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মধ্যে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। তাই এই সমন্বিত অধিদপ্তর পৃথক করে আলাদা মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর করা সময়ের দাবি।
২০০৩ সালে ড. মনিরুজ্জামান মিঞার জাতীয় শিক্ষা কমিশন তাদের সুপারিশে প্রস্তাব করেন - ‘মাধ্যমিক শিক্ষার সার্বিক ব্যবস্থাপনা, তত্ত্বাবধান, প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করা কাম্য। উচ্চ শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়াদি অন্য অধিদপ্তর গঠন করে সেখানে ন্যস্ত করা যেতে পারে।’
মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকতায় কর্মরত সবাই উচ্চতর ডিগ্রিধারী। তাদের পেশাগত ডিগ্রি ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বি.এড) অর্জন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় উৎসাহিত করতে এন্ট্রি পদটি ৯ম গ্রেডে আপগ্রেড করা অত্যাবশ্যক। একই অধিদপ্তরের অধীন হলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দীর্ঘ ১৫-১৭ বছর যাবৎ বকেয়া টাইমস্কেল, সিলেকশন গ্রেড থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে কলেজের কোনো দাবিদাওয়া চাওয়ার আগে পূর্ণতা পায়। মাধ্যমিক শিক্ষকরা অভিভাবকহীন হওয়ায় প্রতিনিয়ত এমন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কিছু দিন আগে ৯টি অঞ্চলের উপপরিচালকের ডিডিও ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আঞ্চলিক পরিচালক পদে শিক্ষা ক্যাডার থেকে পদায়ন করা হয়েছে। এভাবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদায়ন ও পদোন্নতির অধিকারগুলো দিন দিন খর্ব হওয়ায় কর্মরতদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও বৈষম্য দেখা দিয়েছে।
মাধ্যমিক পর্যায়ে কোনো পদোন্নতিযোগ্য পদসোপান না থাকায় ৩০ থেকে ৩২ বছর শিক্ষকতা শেষে একই পদে অবসরে যেতে হচ্ছে। প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে যৎসামান্য পদোন্নতি কপালে জুটতো তাও আমলাতান্ত্রিক দূরদর্শিতার ঘাটতি ও ১৯৮১ সালের রিক্রুটমেন্ট রুলসের সংশোধন না হওয়ায় দীর্ঘসূত্রিতা সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে ২০১০ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের একাংশ ২০২১ সালে সিনিয়র শিক্ষক পদোন্নতি পায়। অধিদপ্তরের করণিক অসতর্কতায় ঐ তারিখে শুন্য পদ থাকা সত্ত্বেও নিজ ব্যাচেই পাঁচ বছরের বৈষম্যের শিকার হয় একই ব্যাচের পদোন্নতি বঞ্চিত অবশিষ্ট শিক্ষকরা। ২০১১ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জনের পরেও পদোন্নতি হচ্ছে না। অপরদিকে ১৮৭০ জন প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছে মাত্র দুই দিন পূর্বে।
অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত মাউশি'র কলেজ কর্মকর্তারা সাক্ষী গোপাল সেজে বসে আছেন। এভাবে গত ৫৪ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। যার প্রভাব নানাভাবে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপরেও পড়ছে। এমতাবস্থায় মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকদের উপর চাপিয়ে দেয়া বৈষম্য কমাতে ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টির জন্য হলেও জরুরি ভিত্তিতে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন ২০২৪ সালের শেষার্ধে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর - মাউশিকে দুই ভাগ করে যথাক্রমে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নামে দুটি আলাদা অধিদপ্তর গঠনের প্রস্তাব করে। দুই মাস অতিক্রান্ত হলো মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নামে দুটি আলাদা অধিদপ্তর গঠনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা কার্যকর ও দূরদর্শী সম্মতি প্রদান করেছেন। কিন্তু অদ্যাবধি প্রজ্ঞাপন জারি করে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত এই অত্যাবশ্যকীয় মাউশি বিভক্তি করে আলাদা মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে।
কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও এন্ট্রি পদে ৯ম গ্রেড বাস্তবায়ন পরিষদ চলমান আন্দোলন কিছুদিনের জন্য মুলতবি রেখেছে। কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যে এন্ট্রি পদ ৯ম গ্রেড ধরে ৪ স্তরীয় অ্যাকাডেমিক পদসোপানসহ স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রজ্ঞাপন জারি করা না হলে মাধ্যমিকের শিক্ষকরা পুনরায় কর্মসূচি দিয়ে বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলবে। পাশাপাশি মাধ্যমিকে প্রকল্পের নামে শর্ত সাপেক্ষে জনবল নিয়োগ দেয়া হলেও পরবর্তীতে তারা রাজস্ব খাতে আসার জন্য নানা অপকৌশল অবলম্বন করে, সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্তদের সীমিত পদোন্নতিযোগ্য পদগুলো দখলে নিতে মামলা করে প্রশাসনিক কাজকর্ম স্থবির করে, যা এই সেক্টরে শৃঙ্খলা বিনষ্ট করে। তাই মাধ্যমিক স্তরের প্রকল্পে এই সেক্টরে কর্মরত শিক্ষকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে পদায়ন করার জোর দাবি জানাই।
মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ এই স্তরকে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। তাই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে একটি অত্যাধুনিক অর্গানোগ্রামসহ স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করে দ্রুত প্রজ্ঞাপন জারি করতে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক, মো. আবু সাঈদ মোল্লা, সিনিয়র শিক্ষক, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল ও আহ্বায়ক, বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা সমিতি (বাসমাশিস), ঢাকা।