হোম > মতামত

ঐকমত্যের দলিল নিয়েই ঐকমত্যের ঘাটতি!

খাজা মাঈন উদ্দিন

কী করে যেন একই সময়ে দেখা গেল পশ্চিমি গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ভারতে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশের পতিত শাসক শেখ হাসিনার বর্বর হত্যাকাণ্ড অস্বীকার করে নির্বিকার সাফাই চেষ্টা এবং জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ নিয়ে দেশে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। এটা কি শুধুই কাকতালীয় ব্যাপার?

কারণ হাসিনার বক্তব্যে বর্তমানে নিষিদ্ধ তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন হলে কোটি ভোটারের অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার দাবি আর জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তি, ভোটমুখী দলগুলো পরস্পরের মধ্যে বিরোধে জড়ানো, দুটি ঘটনার অভিঘাত কিন্তু একই—ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন কিছুটা অনিশ্চিত অথবা এর বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া।

অবশ্য কারো কারো চোখে না পড়লেও দুপক্ষের অমিল অনেক বেশি স্পষ্ট। দেড় দশক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন-বঞ্চিত বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য দল চায় দ্রুত ক্ষমতা নির্ধারণী, নির্বাচনি রাজনীতির অংশীদার হতে। উল্টোদিকে হাসিনারা নির্বাচন ভন্ডুল করে রাজনৈতিক শূন্যতা ও অনিশ্চয়তা জিইয়ে রাখতে চায়; যাতে তাদের দলের তিন তিনটি নির্বাচনি কুকীর্তি আড়াল করা এবং দলটির বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা এড়ানো সম্ভব হয়। হাসিনার এ চাওয়া প্রকাশ করার আগেই আগমনি গান গেয়ে ইতোমধ্যেই ঐকমত্য প্রকাশ করেছে দেশ-বিদেশের কিছু সুশীল ব্যক্তি ও গোষ্ঠী।

ফ্যাসিবাদী হাসিনার ভোট ডাকাত আওয়ামী লীগকে ভোটে আসার সুযোগ দেওয়ার নামই যদি হয় অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন, তাহলে চোর, দস্যু, খুনি, ঘুসখোর, দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারকারী বা চোরাচালানকারীদের কী অপরাধ যে তারা তাদের কাজ থেকে বঞ্চিত হবে!

কী আহ্লাদ, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এর জোচ্চুরির নির্বাচনি প্রহসনে ক্ষমতা ধরে রাখা হাসিনার হারানো রাজত্ব ফিরে পেতে এবং ২০২৪ বিপ্লবের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার সুযোগ তার হাতে তুলে দিতে হবে এ জাতিকে! ফ্যাসিবাদী রাজনীতি, আবার!

সুতরাং আজকের বাংলাদেশে রাষ্ট্র পুনর্গঠনে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় এবং সম্প্রীতির সমাজ নির্মাণে গণতন্ত্র হত্যাকারী, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ একটি অগ্রহণযোগ্য শক্তি। পৃথিবীর কোথাও গণতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাস না করা দল কি নির্বাচনি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার যোগ্যতা রাখে?

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অংশ নেওয়া বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ প্রায় ৩০টি দল এই মুহূর্তের রাজনৈতিক অংশীজন। এর অধিকাংশই হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে শুধু এক কাতারে ছিল তা নয়, এখনো দলীয় স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও তাদের মতাদর্শিক ও কৌশলগত ভিন্নতা কমই, যদি জনগণের রাষ্ট্রগঠন এবং তাদের কল্যাণই রাজনীতির ব্রত হয়ে থাকে।

তাহলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর এবং তা বাস্তবায়নের আদেশ জারি নিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলো এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে ত্রিমুখী ‘উত্তেজনা’ তৈরি হলো শুধুই কি নানা বিষয়ে মতভেদ ও ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের সংঘাতে?

৫ আগস্ট ২০৩৪-এ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর এবং প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের পক্ষের সব শক্তি একমত হয় সংস্কার, জুলাই হত্যাকাণ্ড ও গুম খুনের বিচার এবং একটি সর্বজনীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে। সেই অর্থে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে সহযোগিতা করাটাও ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর অলিখিত ঐকমত্যের ফসল।

তবে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি-সংবলিত জুলাই সনদ প্রস্তুত ও স্বাক্ষর এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কেন এত মতভেদ তৈরি হলো, তা যেকোনো সরল পর্যবেক্ষকের কাছেই হতে পারে আশ্চর্য ব্যাপার। দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছার পর ভিন্নমতের সুযোগ কোথায়, তাও বোঝা মুশকিল। কেনই বা ঐকমত্য কমিশন রাজি, গড়রাজি এবং ভিন্নমতের দফা সন্নিবেশিত করে একটি জোড়াতালির দলিল তৈরি করল, সেটি একটি প্রশ্ন।

বাংলাদেশের রাজনীতির ঐতিহাসিক ট্র‍্যাজেডি হলো এখানে আলোচনার টেবিলে রাজনৈতিক সংকট মিটে না, আবার সংকট দীর্ঘায়িতও হয় না। দলীয় প্রতিশ্রুতি হোক বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা হোক, আমাদের রাজনৈতিক চুক্তিভঙ্গের ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ।

সে কারণেই হয়তো অনেকেই নির্বাচন ও কোনো দলের এককভাবে ক্ষমতাসীন হওয়ার আগেই সনদে সই করে সংস্কার বাস্তবায়নের লিখিত গ্যারান্টি চেয়েছেন। কিন্তু কেউ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে চাইলে ঠেকাবেন কী দিয়ে, বিকল্প রাজনীতি ছাড়া?

রাজনৈতিক দলগুলোও যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিশ্চিতে গণভোট আয়োজন এবং সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ল, তাও হয়তো প্রতিপক্ষকে পুরোনো মানসিকতা দিয়ে বিচার এবং মাঠে হার-জিতের ভয় থেকেই। যেন গণভোট আগে-পরে হওয়ার ওপর জাতীয় নির্বাচনে নিজেদের অংশগ্রহণের ফল নির্ভর করছে। যেন ভবিষ্যৎ সংসদে বিরোধী ও সরকারি দলের মধ্যে সহযোগিতার কোনো প্রয়োজন হবে না, সম্ভবও হবে না।

এখানেই হাসিনার সাফল্য—তিনি এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি উৎপাদন ও সংরক্ষণ করেছেন যেন এক দল আরেক দলকে অবিশ্বাস ও শত্রুজ্ঞান করে। যাতে সমাজে সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ ‘রুলস অব দ্য গেম’ মানতে না চায় আম-জনতাও।

দেড় দশক বাংলাদেশের মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে হাসিনা এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করে গেছেন, যাতে তাদের কণ্ঠ না শোনা যায় এবং তাদের অন্তত ২০৪১ সাল পর্যন্ত অগ্রাহ্য করা যায়। সেই জনতার ধাওয়ায় তার ও দোসরদের শেষ রক্ষা হয়নি কিন্তু বিপ্লব শেষে আবার খানিকটা নীরব হয়ে পড়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ।

তৃণমূলের মতামত জানতে ঐকমত্য কমিশনের সক্রিয় সদস্যরাও হয়তো জনগণের দোরগোড়ায় যেতে উৎসাহিত বোধ করেননি। সুবক্তা প্রফেসর ইউনূসকে গণসংযোগের সভায় লাখো লাখো মানুষের সামনে হাজির করেও তো পরিবর্তনের দলিল ও অন্যান্য পদক্ষেপ ব্যাখ্যা করা যেত।

সে ক্ষেত্রে ঐকমত্য নিঃসন্দেহে আরো বিস্তৃত এবং জনগণের বড় অংশ এর শরিক ও সমর্থক হতো পারত। তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর জনমতের ইতিবাচক চাপ থাকত।

মাঠপর্যায়ে সংলাপ, নানা গোষ্ঠীর মধ্যে তর্কবিতর্ক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের মধ্যে সরাসরি আলোচনা হলে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সহজতর হতো এবং সরকারও সাম্প্রতিক সমালোচনা থেকে নির্ভার থাকতে পারত।

জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে সাংস্কারের তালিকা এবং কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে দূরদর্শী রাজনীতির অভাব যে ছিল, হাসিনার লোকরা তা বুঝতে পেরেই অডিও বার্তা ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে তাকে রাজনীতির বাজারে এনেছে নতুন করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা অর্জন, গৃহযুদ্ধের অবসান কিংবা বিপ্লবোত্তরকালে জাতীয় দলিল স্বাক্ষর হয় সর্বসম্মতভাবে নিষ্পন্ন অথবা একজন বা একদল মহান নেতার নেতৃত্বে তৈরি হয় জাতীয় দিকনির্দেশনা। সংস্কারের আলোচনায় বাংলাদেশের মতো আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বোধ হয় অনুসরণ করা হয়নি তেমন কোথাও।

২০২৪-এর রাজনৈতিক পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় সুফল হাসিনার দানবীয় শাসন থেকে শাসকরা ছাড়া বাকি সবার মুক্তি। তবে বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের সংস্কার কার্যক্রম এখন পর্যন্ত খুব সফল ‘কেস’ (ঘটনা) নয়, আবার ঠিক ব্যর্থও নয়।

এবারের রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেও দুটি পরিবর্তনের বিষয় লক্ষ করা যায়—ক. পুরোনো রাজনীতি এদেশে সেকেলে হয়ে পড়েছে; এবং খ. নতুন প্রজন্মের জন্য নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের চাহিদা তৈরি হয়েছে।

জুলাই সনদ নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি এবং এর বাইরেও রাজনৈতিক সমাধান রাজনীতিকদের হাতে আছে এখনো। শুভ শক্তিরা কি পরস্পরের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে রাজি, নাকি একমত হতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন, তা-ই নির্ধারণ করবে আগামী বাংলাদেশের পথ।

লেখক : সাংবাদিক

১৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয়, তবু কেন এত যানজট

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কত দূরে বাংলাদেশ

ভারত-মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা উচিত

ট্রাম্পের জাতিসংঘ ভাষণ ও রোহিঙ্গাসংকট

দক্ষিণ এশিয়ায় সরকারি চাকরির সামরিকীকরণ

হাসিনাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেন বলা যায় না

‘বিশ্বাসঘাতক’ ও ‘প্রতারক’ সরকারের অধীনে নির্বাচন কীভাবে

প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও এনআইডি বিড়ম্বনা

‘নিরপেক্ষতা’র পক্ষ-বিপক্ষ

আমেরিকার ‘সফট পাওয়ার’কে ধ্বংস করছেন ট্রাম্প?