হোম > মতামত

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কে বেশি অসহায়

ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা

বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের অনেক গুণ থাকলেও, যে গুণটির বড্ড অভাব, তা হলো আত্মপর্যালোচনার অভ্যাস। কিন্তু এর জন্য পুরোপুরি তাদের দায়ী করা চলে না। কারণ, তাদের কর্মকাণ্ডের যারা দর্শক-শ্রোতা তথা (সু)ফলভোগী, অর্থাৎ আমাদের মতো আমজনতা, আমরা তাদের কাজকে সেটা ভুল হোক, ভালো হোক হাততালি দিয়ে আর প্রশংসায় ভাসিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাই যে, তাদের অভিধান থেকে ‘আত্মপর্যালোচনা’ শব্দটিই বিলুপ্ত হয়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তিতে কজন উপদেষ্টা আত্মপর্যালোচনা করেছিলেন তাদের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সফলতা ও ব্যর্থতার পরিমাপ নির্ণয় করার জন্য? আবার তাদের কাজের (সু)ফলভোগী হিসেবে সাধারণ মানুষইবা কতখানি আগ্রহী ছিলেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে তাদের কাজকে সমালোচনা করতে?

এই সংস্কৃতি আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। এমনকি মেধাবী অর্থনীতিবিদ, প্রসিদ্ধ আমলা, যশস্বী কূটনীতিবিদ, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশকে সম্মানজনকভাবে তুলে ধরার ব্যাপারে প্রভাবশীল ব্যক্তিরা সরকারের অংশ হয়েও পারেননি এই সংস্কৃতির সূচনা করতে। ফলে শেষবেলায় জমা হচ্ছে শুধু আফসোস আর হতাশা। যে বাংলাদেশ এ সরকার বিনির্মাণ করতে পারত, তা আর কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু রোহিঙ্গা সংকটের কথাই ধরা যাক।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কাজ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার যে প্রক্রিয়ায় কাজে নেমেছিল, তাতে রোহিঙ্গা সংকটের মতো জটিল বিষয়কে প্রজ্ঞার সঙ্গে সমাধানের পথে এ সরকার নিয়ে যেতে সক্ষম, এমন ধারণা পোষণ করতে দেখা গিয়েছে বাংলাদেশের অনেককে তো বটেই, রোহিঙ্গাদেরও একটা বড় অংশকে। আজ দশ মাস পর যদি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের সম্ভাব্য যাচাই করা হয়, আমরা কী দেখতে পাই? এ বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে সম্প্রতি জাতিসংঘে রোহিঙ্গাবিষয়ক সম্মেলনে আমরা কী পেলাম, তা সংক্ষেপে জানা যাক।

এ সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্জন তিনটি এবং তিনটিই গুরুত্বপূর্ণÑ১. কিছু তহবিল পাওয়ার নিশ্চয়তা, ২. রোহিঙ্গা ইস্যুকে একটা এজেন্ডার মধ্যে রাখা এবং ৩. এই প্রথম রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘে একটা সম্মেলন করতে পারা। কিন্তু প্রায় জনশূন্য হলরুমটিতে সম্মানিত রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাদের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে ভাষাগত দক্ষতার নমুনা মিললেও সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপের ছিটেফোঁটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

সাধারণ পরিষদ সভাপতি তার বক্তব্যে বললেন, ‘এই সংকটের মূল কারণ জানতে হবে।’ এত বছর পরও জাতিসংঘ তাহলে এ সংকটের কারণই জানে না? অস্ট্রেলিয়ার সাবেক রাজনীতিবিদ জুলি বিশপের কণ্ঠে ঝরল হতাশা, ‘সময় আমাদের পক্ষে নয়’। আমেরিকার বিশেষ দূত চার্লস হার্ডার যেহেতু ৬০ মিলিয়ন ডলার অনুদানের আশ্বাস নিয়ে এসেছিলেন, তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন এবার রোহিঙ্গাদের জীবিকার্জনের সুযোগ দিক বাংলাদেশ (বাংলাদেশি কেউ এ কথা বললে অবশ্য তাকে দেশবিরোধী মনে করা হয়)। এছাড়া, অন্যরা তাদের বিবৃতিতে মোটামুটিভাবে রোহিঙ্গাদের আর্থিক সহায়তাদানে বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলেন। সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সম্মেলনে শুধু অনুদানের বিষয়টিই প্রাধান্য পাবে? কার্যকর সমাধানের কথা একটা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিও বলবে না? এমন সম্মেলন আয়োজনে জাতিসংঘ তার অসহায়ত্বই প্রমাণ করল। আর অতীতের বাংলাদেশের মেরুদণ্ডহীন কূটনীতি রোহিঙ্গা সংকটকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই এত বছর পরও তারা সংকটের কারণ খোঁজায় ব্যস্ত।

কানাডিয়ান কূটনীতিবিদ বব রে অবশ্য বললেন, অসমাধানযোগ্য কোনো সমস্যা এটা নয়, এটা বরং ইচ্ছাশক্তির অভাবে সমাধান না হওয়া ব্যাপার। বব রের এ কথা বলার কারণ শুধু তার কূটনৈতিক দূরদর্শিতা নয়। তিনি রোহিঙ্গা সংকটকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন গভীরভাবে এবং দীর্ঘসময় নিয়ে। শুধু লোকদেখানো ক্যাম্প পরিদর্শনের মধ্যে আটকে থাকেননি। কিন্তু অন্যরা রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল পাঠানোয় মনোনিবেশ করেছেন। তহবিল অবশ্যই বাংলাদেশের প্রয়োজন আছে। আবার এই তহবিলই যে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য রাখার ব্যাপারে অনুপ্রেরণাÑতা কি অস্বীকার করার উপায় আছে?

লক্ষণীয়, ৬৬ দেশের প্রতিনিধির মধ্যে এমন কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি অনুপস্থিত ছিলেন, যাদের সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। কোনো কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অভিযোগ তুলেছে, কেন বাংলাদেশ থেকে একজন রোহিঙ্গাকেও সেই সম্মেলনে নেওয়া হলো না। কুতুপালং ক্যাম্প থেকে দু-একজন রোহিঙ্গা সেখানে গেলেই জাতিসংঘের সম্মেলন তাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যেত? যেত না। তেমনি তরুণ প্রজন্মের নবীন রাজনীতিবিদদের কয়েকজনকে যাদের রোহিঙ্গা বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি, তাদের এবং রোহিঙ্গা বিষয়ে বিগত সরকারের রোহিঙ্গা নীতির আজ্ঞাবহ ব্যক্তিদের সম্মেলনে নিয়ে গেলে তা কার্যকর ফল আনতে পারে না।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব নয়, সেটি অতীতে যেমন প্রমাণ হয়েছে, এ সম্মেলনেও তা প্রমাণ হলো। সে কারণেই বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতি দিলেন তহবিলের। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের লক্ষ্য ছিল তহবিল সংগ্রহ। আর তাই রোহিঙ্গাদের এফডিএমএনের মতো বিচিত্র নামে অভিহিত করা হয়েছিল, শরণার্থী হিসেবে নয়। কোনো নীতি শরণার্থীদের নিয়ে তৈরি করা হয়নি। পরিতাপের বিষয়, একই পথে চলছে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের কাজ। তাই আজ দশ মাস পর রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে বসলে রোহিঙ্গাদের মতো বাংলাদেশের মানুষও হতাশ হয়।

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল বর্তমান সরকারের। সময় শেষ হয়ে এসেছে। অথচ বিগত সরকারের রোহিঙ্গা নীতি যেমন এ সরকার ত্যাগ করতে পারেনি, তেমনি চায়নি রোহিঙ্গা সংকটের জটিলতা বুঝতে। একে যতই ‘বৈশ্বিক দায়বদ্ধতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হোক না, বিশ্ব এর দায়-দায়িত্ব নেবে না। যেমনটি নেয়নি গাজায় ইসরাইলের মানবতাবিরোধী হামলা বন্ধের। আমেরিকা-মধ্যপ্রাচ্যে গোটা দু-এক সম্মেলন আয়োজনের মধ্যে যে এ সংকট থেকে মুক্তির উপায় মিলবে না, তা বোঝার জন্য কূটনীতি বা অর্থনীতি শাস্ত্রের জ্ঞানের চেয়ে রোহিঙ্গা সংকটের স্বরূপ নিয়ে ধারণা থাকা জরুরি ছিল।

জরুরি ছিল আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গা বিষয় ও আরাকান আর্মির জন্য যে সরবরাহ বাংলাদেশ থেকে যেত (এখনো যায়), তা নিয়ে দরকষাকষি করা। জরুরি ছিল আরাকান আর্মির তত্ত্বাবধানে মাদকের যে জমজমাট ব্যবসা টেকনাফ হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর করা। জরুরি ছিল বান্দরবানে মিনি চিকেন নেকের কাছে কড়া প্রহরা নিয়োগ করা যেন আরাকান আর্মি শুধু রাখাইন নয়, বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যেতে না পারে। জরুরি ছিল চীনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। জরুরি ছিল রোহিঙ্গা বিষয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের অভিমত ও অভিজ্ঞতা জানা। রোহিঙ্গা সংকটের মতো জটিল বিষয়ে গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও নীতিমালাকে এক সুতোয় গাঁথার মনোভাব আমাদের এখনো তৈরি হয়নি।

জরুরি ছিল রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, মিয়ানমার কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছে, গণহত্যার শিকার হয়েছে কিন্তু তারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়Ñএ বয়ান প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজুড়ে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করা। জরুরি ছিল রোহিঙ্গা ইস্যুতে আগে জাতীয়ভাবে ঐকমত্যে পৌঁছানো। জরুরি ছিল রোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। জরুরি ছিল রোহিঙ্গাদের দেশে পাঠানোর উদ্যোগের পাশাপাশি কক্সবাজারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিয়োজিত করা। জরুরি ছিল গণহত্যাকারী মিয়ানমারের বিচারের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য উদ্যোগী হওয়া। জরুরি ছিল একটা শরণার্থী নীতি প্রণয়ন করা।

এর অনেকগুলো কাজ এখনো শুরু করা যায়নি। মিয়ানমারের সামরিক সরকার আর আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের প্রতি একই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। সুতরাং মেরুদণ্ড সোজা রেখে বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বলিষ্ঠভাবে কথা বলতে না পারে, তাহলে বাংলাদেশের অসহায়ত্ব ঘুচাতে কেউ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে না। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে যারা সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং গত দশ মাসে অনেক আশার বাণী শুনিয়েছেন, তারা কি এবার একটু আত্মপর্যালোচনা করবেন?

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

শান্তির মুখোশে গাজায় টনি ব্লেয়ারের প্রত্যাবর্তন

মেধা পাচার রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিচ্ছে

মুসলিম বিদ্বেষ ও ভারতের বিনোদন সংস্কৃতি

দুর্ঘটনা না নাশকতা

নেতৃত্ব নির্বাচনে সচেতনতার ঘাটতি

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফল কী বার্তা দেয়

তিস্তাপাড়ে আলোর মশাল

যুদ্ধবিরতি যেসব সমস্যায় ফেলেছে নেতানিয়াহুকে

বাম ও ডান : মতাদর্শ নাকি রাজনৈতিক লেবেল

যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয় ন্যাটো