মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সংশ্লিষ্টতার পক্ষে ঢোল জোরেশোরেই বাজছে ওয়াশিংটনে। নীতিনির্ধারণী মহলে কেউ কেউ ফিসফিস করে আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে চিৎকার করে বলছেন গাজায় সরাসরি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য। গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি পর্যবেক্ষণের জন্য ইতোমধ্যেই প্রায় ২০০ মার্কিন সেনা ইসরাইলে মোতায়েন করা হয়েছে। রসদ ও নিরাপত্তায় বিশেষজ্ঞ এই বাহিনী ইসরাইলে একটি সামরিক-বেসামরিক সমন্বয় কেন্দ্রে কাজ করবে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার শুরুটা সাধারণত এ ধরনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে তারা সেখানে সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। গাজায় যুক্তরাষ্ট্র সে ধরনের কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে কি নাÑসেই প্রশ্নটি এখন সামনে আছে। কারণ, ইসরাইলে মোতায়েন করা মার্কিন সৈন্যরা যে গাজায় যে কোনো সময় প্রবেশ করবে না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার জামাতা জারেড কুশনার গাজাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলে সেখান থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আয়ের যে ফন্দি-ফিকির করছেন, তার বাস্তবায়ন খুব সহজ হবে না। সেটার বাস্তবায়নের জন্য গাজায় মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি লাগবে। যুক্তরাষ্ট্র গাজায় আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্স মোতায়েন করার কথা বললেও এই বাহিনী দিয়ে ট্রাম্পের উদ্দেশ্য সফল হবে না।
সেখানে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি অচিরেই দেখা যাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, হামাসসহ অন্যান্য প্রতিরোধ সংগঠনগুলো ট্রাম্প প্রশাসনের এ ধরনের উদ্যোগ মেনে নেবে বলে মনে হয় না। ফলে মার্কিন সেনাদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধাদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে।
কিন্তু আমেরিকান সৈন্যরা আবার মধ্যপ্রাচ্যের কাদায় আটকে যাওয়ার আগে, নীতিনির্ধারকদের সেখান থেকে পিছিয়ে এসে একটি মৌলিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা উচিত, গাজায় আমেরিকান সেনাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলার সম্ভাব্য কৌশলগত স্বার্থ কী? কোথাও সামরিক হস্তক্ষেপের যুক্তি সাধারণত মানবিক কারণ বা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উদ্বেগের ওপর নির্ভর করে। এগুলো আবেগের দিক থেকে আকর্ষণীয় বর্ণনা, তবে যাচাই-বাছাইয়ে শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য মানবিক সংকটে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। মানবতাবাদ আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির চালিকাশক্তি বা মূল কথা হলে, মার্কিন বাহিনীকে সব সময়ই এসব এলাকায় মোতায়েন করা হতো। কিন্তু বাস্তবে সে ধরনের কিছু ঘটেনি। কারণ মানবিক উদ্বেগ গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিশ্বের যেসব এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করেছে বা করছে, মানবিক ইস্যু সেখানে প্রধান কারণ বা নির্ধারক ছিল না এবং তা এখনো নয়।
দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি সামরিক সংশ্লিষ্টতার ক্ষেত্রে আমরা যা দেখি, তা হলোÑপ্রয়োজনীয়তার কথা বলে মিশনের প্রস্তুতি শুরু করা। এটি শুরু হয় সামরিক উপদেষ্টা প্রেরণ এবং গোয়েন্দা অভিযানের মাধ্যমে। এরপরের পর্যায় হচ্ছে বিমান সহায়তা দেওয়া। এরপর দ্রুতই মার্কিন সেনারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে নামমাত্র সহায়তামূলক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে তারা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
এগুলো অনুমাননির্ভর কোনো কথা নয় নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরু করার এটি একটি চিরাচরিত কৌশল। ভিয়েতনাম থেকে ইরাক হয়ে আফগানিস্তান পর্যন্ত মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের সুপরিচিত দৃশ্যপট এটি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সীমিত উদ্দেশ্য নিয়ে অভিযান শুরু হয়েছিল এবং এগুলোর সমাপ্তির লক্ষ্য ছিল অস্পষ্ট। এসব সংঘাতে মার্কিন সেনাদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের ক্রমবর্ধমান হতাহতের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটাই বেকায়দায় ফেলে দেয়।
কৌশলগত হিসাবও সমানভাবে সমস্যাযুক্ত। গাজা সংঘাত মূলত এমন বিষয়গুলোর মধ্যে নিহিত, যা আমেরিকান সামরিক শক্তির পক্ষে সমাধান করা সম্ভব হবে না। এগুলোর মধ্যে আছে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র, ইসরাইলি নিরাপত্তা উদ্বেগ, প্রতিযোগিতামূলক ঐতিহাসিক দাবি এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার গতিশীলতা। এসব জটিল সমস্যার সমাধান সর্বোচ্চ মাত্রার সামরিক শক্তি ব্যবহার করেও সমাধান করতে পারবে না। কারণ এগুলো রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমস্যা। সামরিক শক্তি কোনোভাবেই একটি টেকসই রাজনৈতিক সমাধান দিতে পারে না। এটি বরং আলোচনাকে আরো জটিল এবং বিরক্তিকে আরো গভীর করে তুলতে পারে।
অধিকন্তু, গাজায় সরাসরি মার্কিন সম্পৃক্ততা সংঘাতের গতিশীলতাকে বিপজ্জনক পন্থায় নতুন রূপ দেবে। এটি অপপ্রচারীদের হাতে যে নতুন অস্ত্রটি তুলে দেবে, যা ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার বিরোধকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিস্তিনি বা যুক্তরাষ্ট্র ও বৃহত্তর আরব স্বার্থের মধ্যে সংঘাতে রূপ দিতে পারে।
এটি সংঘাতের পরিধিকে বিস্তৃত করবে, যা পুরো অঞ্চলে চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর জন্য তাদের যোদ্ধা সংগ্রহের নতুন বয়ান বা পটভূমি তৈরিতে সহায়ক হবে। মার্কিন সৈন্যরা গাজায় জড়িত হয়ে পড়লে তা শুধু স্থানীয় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর জন্যই নয়, বরং ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া এবং গাজাকে একটি প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।
সুযোগ কাজে লাগোনোর বা ব্যবহারের যে ব্যয়, সেটার কথাও বিবেচনায় নিতে হবে। আমেরিকার সামরিক ও আর্থিক সম্পদ সীমিত। গাজায় যে ডলার ব্যয় করা হচ্ছে প্রতিটি এবং সেখানে যেসব মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে ও হবে, তা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও আর্থিক ক্ষমতাকে সীমিত করবে। এই দুটির কোনোটিই আর বিশ্বের অন্য কোনো সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলা বা অঙ্গীকার পূরণের জন্য ব্যয় করা ও মোতায়েন করার কোনো সুযোগ থাকবে না যুক্তরাষ্ট্রের সামনে।
গাজায় মার্কিন সংশ্লিষ্টতা এমন একসময়ে যখন চীনের সঙ্গে শক্তির প্রতিযোগিতাকে অন্যতম প্রধান কৌশলগত অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে ওয়াশিংটন। এই পরিস্থিতিতে গাজা সংকটে মার্কিন বাহিনীকে জড়িয়ে ফেলা কতটুকু যুক্তিসংগতÑসেই প্রশ্নটি সামনে আসছে। কিন্তু অস্বস্তিকর সত্য হলো সামরিক উপায়ে গাজা সংঘাতের সমাধান করতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র।
গাজায় মার্কিন সংশ্লিষ্টতার ফলে বরং দেশটির সম্পদের অপচয় হবে ও ব্যাপক প্রাণহানি ঘটবে। তারা সেখানে নিজেদের এমন এক সংঘাতে জড়িয়ে ফেলবে, যেখানে আমেরিকান স্বার্থ স্থানীয় এবং আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের চেয়ে গৌণ এবং এই খেলোয়াড়রাই শেষ পর্যন্ত ফল নির্ধারণ করবে।
মার্কিন নীতিনির্ধারকরা যদি মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আন্তরিক হন, তাহলে তাদের কূটনীতির পথকেই অনুসরণ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে তাদের উচিত হবে যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন দেওয়া, গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ সহজতর করা এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার সুযোগ দেওয়া।
সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে ভ্রান্তনীতিতে হাবুডুবু খাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা, তাতে কূটনীতি তাদের কম সন্তোষজনক একটি পন্থা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, সংঘাতের সমাধানে এটি অনেক বেশি পরীক্ষিত ও কার্যকর। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ওয়াশিংটন সম্ভবত এই পরামর্শ উপেক্ষা করবে। কারণ শক্তি প্রদর্শনের প্রলোভন অন্যপন্থাকে প্রতিরোধ করার জন্য নানা যুক্তি সামনে নিয়ে আসতে উৎসাহিত করে।
কিন্তু গাজায় আমেরিকান সেনা মোতায়েনের আগে ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের একটি মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া উচিত। সেই প্রশ্নটি হচ্ছেÑতারা কি বাস্তবসম্মত সময়সীমা এবং প্রস্থান কৌশলসহ স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই সংঘাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, নাকি তারা শুধু আরেকটি উন্মুক্ত জটের মধ্যে জড়িয়ে পড়বে? এর সবচেয়ে ভালো ও সঠিক উত্তরটি হচ্ছে পরের পন্থাটি, অর্থাৎ সংযম প্রদর্শন এবং কূটনীতিই হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
এশিয়া টাইমস থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী