হোম > ফিচার > সাহিত্য সাময়িকী

জুলাইয়ের মায়েরা

লতিফুল ইসলাম শিবলী

অলঙ্করণ: মুকুল রেজা

কালো অক্ষরে ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকল এই জাতির জীবনে দুটি কালোরাত। ৪ আগস্ট ২০২৪-এর দিবাগত রাতটা, ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর কালোরাতের মতোই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার রাত ছিল। ৬ আগস্ট পূর্বনির্ধারিত ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ প্রোগ্রামটি একদিন এগিয়ে নিয়ে ৫ তারিখে করা হয়। ৪ আগস্টে হাসিনার খুনি বাহিনীর হাতে প্রচুর ছাত্র-জনতা শহীদ হলে লংমার্চের দিন কৌশল হিসেবে দ্রুত বদলে দেওয়া হয়। আর এভাবেই খুনি হাসিনার ক্ষমতার আয়ু কমে আসে এক দিন। ইতিহাসে লেখা হয়ে গেল এক নতুন তারিখ ‘৩৬ জুলাই’।

৪ তারিখ উৎকণ্ঠার সেই রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, যেভাবেই হোক ‘লংমার্চ টু ঢাকা’কে সফল করার জন্য রাস্তায় নামতে হবে। পেছনে ফেরার আর কোনো পথ নেই, কারণ আগের দিন এক ভিডিওবার্তায় আমি সরাসরি হাসিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়েছিলাম। সেই ভিডিওর পর আমার আর বাঁচার কোনো পথ ছিল না। ৪ তারিখ মধ্যরাতের দিকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখলাম—‘ইনশাআল্লাহ আগামীকাল শাহবাগে থাকব, ‘উড় ড়ৎ পড়ব।’

এটা ছিল আমার নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিজ্ঞা। যত বিপদই হোক, আমি শাহবাগ চত্বরে যাবই। ১৯ জুলাইয়ের পর থেকে আমরা চোখের সামনে অসংখ্য মৃত্যু দেখে ফেলেছি। একেকটি মৃত্যুতে আমাদের সাহসের মাত্রা দ্রুত ধাপে ধাপে বাড়াতে শুরু করেছিল। আমি আমার নিজের অনুভূতি থেকে বলতে পারি, ৪ তারিখের রাত ছিল বহু মানুষের জীবনে মৃত্যুকে জয় করার রাত। অনেকের জন্য সেই রাত ছিল মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর প্রস্তুতির রাত। কত মানুষ সারা রাত জায়নামাজে সেজদায় পড়ে ছিল। কত শত মা সন্তানের নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর দরবারে মোনাজাতে রোনাজারি করেছেন। মহান আল্লাহ সেসব প্রার্থনা কবুল করেছেন। সেই রাতেই হাসিনার তকদিরে অপমানজনক পতন আর পলায়ন নির্ধারিত হয়ে গেছে। আমি ফজর সালাত শেষে জীবনের সব অপরাধের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম। আর ৫ আগস্টের সকালে ঘর থেকে বেরোনোর সময় লিখলাম জীবনের শেষ স্ট্যাটাস, ‘উড় ড়ৎ পড়ব, হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মালওয়াকিল’।

৫ আগস্টের থমথমে নিস্তব্ধ ঢাকার বিভিন্ন অলিগলি দিয়ে পৌঁছালাম বিএসএমএমইউ হাসপাতালের আউটডোর ও আজিজ মার্কেটের মাঝখানের গলিতে। বলে রাখি, শাহবাগ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি, শহীদ মিনার বিপ্লবের এসব সিম্বলিক হটস্পটগুলোর কাছাকাছি থাকার জন্য আমি আগে থেকেই গোপনে অবস্থান করতাম কাঁঠালবাগান-হাতিরপুল এলাকায়, আমার ভাইয়ের বাসায়। বিএসএমএমইউর সেই গলিতে পৌঁছে আমার হৃদয় ভেঙে গেল। আমার মতো কয়েকজন ছাত্র-যুবক-কর্মজীবী মানুষ ছাড়া আর কেউই নেই।

আমি বিমর্ষ হয়ে চারদিক পর্যবেক্ষণ শুরু করলাম। কাঁটাবন মোড়ে আর্মিরা রোড ব্লক করে রেখেছে, বিপরীত দিকে শাহবাগের মোড়ও একইভাবে ব্লক করা। কোনোভাবেই শাহবাগ পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছিল না। আমরা সেই কয়েকজন নিজেদের সান্ত্বনা ও মটিভেট করা শুরু করলাম। আমি বলেছিলাম, ‘ভাইয়েরা আজ না হোক কাল হবে, কাল না হলে পরশু; কিন্তু হাসিনাকে যেতেই হবে।’ আমরা সেই কজন মিলে একটা গ্রুপ ছবি তুলে রেখেছিলাম। যদি আমাদের মধ্যে কেউ আজ মারা যায়, তবে এই ছবি যেন আমাদের পরিবারের কাছে শেষ অবস্থার ছবি হিসেবে পৌঁছে দিকত পারব। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গলির ভেতরে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে আমরা সেই কজন পরিণত হলাম কয়েকশতে। সংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের উত্তেজিত করে তুলল। আমরা পরিণামের কথা না ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে, এখন মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ের দিকে যাব। মিছিল নিয়ে নামার ঠিক আগ মুহূর্তে আমি আমার এক ছোট ভাইকে ফোন দিয়ে আমার লোকেশন জানিয়ে বললাম, ‘মিছিল নিয়ে যাচ্ছি শাহবাগের মোড় দখল করতে, আমি গুলি খেলে আমার লাশ পড়ে থাকবে বিএসএমএমইউর ‘এ’ ব্লকের নিচের রাস্তার ওপর।’ ফোন কেটেই আমরা মিছিল নিয়ে গলি থেকে নেমে পড়লাম রাস্তায়। গগনবিদারী স্লোগান তুলে ‘এক দফা এক দাবি- হাসিনা তুই কবে যাবি’ বলতে বলতে আমরা কিছুদূর আসতেই শাহবাগের দিক থেকে হ্যান্ডমাইকে আর্মিরা আমাদের সতর্ক করে বলল, ‘আর সামনে আসবেন না, সরে যান’। আমরা থমকে গেলাম। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা পিছিয়ে এলাম।

আমরা নিজেদের মধ্যে দ্রুত শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, লোকজন আরও বাড়লে আমরা আবার নামব। এদিকে গলির ভেতর লোকসংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। বেলা ১২টার দিকে শত ছাড়িয়ে সংখ্যা তখন হাজারে। আমরা আবার মিছিল নিয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। সে সময় তসবি হাতে দুজন বয়স্ক মহিলা আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘শোন বাবারা, তোমরা আমাদের মিছিলের সামনে রাখবা, মহিলা দেখলে ওরা গুলি চালাবে না’। সেই উত্তেজনা আর হইহুল্লোড়-ভিড়ের মধ্যে তাদের তখনকার কথার গুরুত্ব বুঝতে পারিনি। হুহু করে আমরা যখন সংখ্যায় বাড়ছিলাম, ঠিক তখন আমাদের অবস্থান থেকে মাত্র এক কি দেড় কিলোমিটার দূরের চাঁনখারপুল এলাকায় আওয়ামী ফ্যাসিস্ট পুলিশ গণহত্যা চালাচ্ছে। সেখানে শহীদ হয়েছে বহু তরুণ। সৌভাগ্যবশত সেদিন শাহবাগের এদিকটায় হাসিনার পুলিশ বা বিজিবি ছিল না। বেশ কয়েকটি ঘটনায় আমরা তখন বুঝে নিয়েছিলাম সেনাবাহিনী জনগণের সঙ্গে আছে। সেটা আমাদের কনফিডেন্স বাড়িয়ে দিয়েছিল।

জোহরের আজান হচ্ছে, আমরা একটা ছোট্ট নামাজের বিরতি দিয়েছিলাম। কিন্তু ছাত্র-জনতার ভেতর তখন আটকে রাখা বুনো ঘোড়ার উদ্যাম। সেই উদ্যাম নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম মূল সড়কে। চিৎকার করে স্লোগান দিতে দিতে আমরা পৌঁছে গেলাম শাহবাগ চত্বরে। সেনাবাহিনী আমাদের জায়গা ছেড়ে দিল। আমরা হলাম শাহবাগ চত্বর দখলকারী প্রথম দল। পরের দুই ঘণ্টার মধ্যে বদলে গেল বাংলাদেশের ইতিহাস। রক্তের ওপর নির্মিত হল এক নতুন তারিখ ‘৩৬ জুলাই’। আমার আজও সেই দুই মায়ের কথা মনে পড়ে। আমি তাদের পরিচয় জানি না। সেই দুই মা যারা আমাদের ঘাতকের গুলি থেকে বাঁচানোর জন্য মিছিলের সামনে থাকতে চেয়েছিলেন। এখন বুঝতে পারি এই মায়েরাই জন্ম দিয়েছেন আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ইয়ামিন, ওয়াসিম আর আনাসদের মতো দুই হাজার শহীদকে। প্রতিটি শহীদ সন্তানের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন এমনসব মা। জুলাইয়ের প্রতিটি শহীদের, প্রতিটি আহতের, প্রতিটি ফোটা রক্ত আর সাহসের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এসব মহীয়সী নারী, আমাদের রক্তাক্ত জুলাইয়ের মায়েরা।

যেই ডিলিউশন সত্য

প্রাচীন ভারত থেকে আধুনিক দুনিয়ায়

তরুণ কবি আরফান হোসাইন রাফির নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘সুদিন ফিরে আসছে’

বাবুইর ৩০০ শব্দের গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেলেন তরুণ ৫ লেখক

১ ফেব্রুয়ারি থেকে বইমেলা আয়োজনের দাবিতে ১১ নভেম্বর সমাবেশ ও পদযাত্রা

বইয়ের পাতায় পাতায় দেড় দশকের নিপীড়নের ইতিহাস

আবদুল করিমের ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সেমিনার

জঙ্গি নাটক নিয়ে সাংবাদিক আবু সুফিয়ানের নতুন বই ‘ডার্ক ডকট্রিন’

ডাকসু নিয়ে গ্যাঞ্জাম করতে আসিনি, প্রশ্ন করতে এসেছি: মেঘমাল্লার বসু

আলেম-লেখকদের আগমনে প্রাণবন্ত পরিবেশ