বিশ্বের একমাত্র কার্বন-নেগেটিভ দেশ ভুটান। হিমালয়ের বুকে অবস্থানকারী এই দেশের ৭০ শতাংশ বনাঞ্চল থাকায় বিষাক্ত গ্যাস পরিবেশে মেশার আগেই বিলীন হয়ে যায়। দেশের মানুষ ও সরকার পরিবেশ সচেতন। তারা জানেন প্রকৃতির যত্ন নিলে প্রকৃতিও তাদের যত্ন নেবে।
দিনটি ছিল ১৮ আগস্ট সোমবার। ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ড্রুক এয়ার লাইনসের (ভুটানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় বিমান) চেক-ইন কাউন্টার থেকে বোর্ডিং ও ইমিগ্রেশন শেষ করে এয়ারলাইনসে চড়ে বসলাম ভুটানের উদ্দেশে। এক ঘণ্টা ২০ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম ভুটানের পারো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে।
তবে এয়ারপোর্টে এয়ার লাইনস ল্যান্ড করার আগের অভিজ্ঞতা অন্যান্য দেশের বিমানবন্দরের মতো নয়, অনেকটাই ভিন্ন। ছোট এয়ারপোর্ট। বিমান নিচে নামার আগে বিরল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে যাত্রীদের। এয়ারলাইনসকে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চলতে হয়। দুপাশে বিশাল আকৃতির পাহাড়। পাহাড়ের পাশ দিয়ে বিমানের ডানা কখনো ডানে কখনো বামে কাত হয়ে চলাচল করে। হার্ট দুর্বল মানুষের এই দৃশ্য ভয়ের কারণ হলেও ভয় পাবেন না। কারণ ভুটানের পারো এয়ারপোর্টে পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা নেই।
বিমানবন্দরটি পারো নদীর ধারে গভীর উপত্যকায় অবস্থিত এবং এটি ১৮ হাজার ফুট উঁচু পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। এ কারণে ভুটানের পাইলটদের নিখুঁত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়, যা পারো বিমানবন্দরকে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ এবং দর্শনীয় বিমানবন্দরের একটি হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।
ছোট্ট উঠানের মতো বিমানবন্দরের পরিধি। বিমান ওঠানামার জন্য একটিমাত্র রানওয়ে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭ হাজার ৩৩২ ফুট ওপরে বিমানবন্দরের অবস্থান। ভুটানবাসীদের দৃষ্টিতে বৈদ্যগুরু পদ্মসম্ভব বাঘের পিঠে চড়ে তিব্বত থেকে উড়ে এসেছিলেন এখানে। তাই পারো এয়ারপোর্টি ভুটানবাসীদের কাছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ স্থান।
আমরা এয়ারপোর্টে নামলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যকার রেজাউল একরাম, সংগীতশিল্পী ও আর্কিটেক্ট মুজিবুর রহমান স্বপন, একটি কলেজের অধ্যাপক কামরুল হাসান ও অঙ্কিতা নামের একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্বসহ আমরা ছয়জন। আমন্ত্রণ জানান ভুটান ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের পক্ষে পেমা লেনাদেন নামের একটি মেয়ে।
পেমা লেনাদেন ভুটান ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টে ট্যুরিজম অপারেশন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। পেমাকে দেখলেই বোঝা যায়, ভুটানের মেয়েরা কতটা সুন্দরী ও স্বাধীনচেতা। এখানকার মেয়েরা ছোট থেকে বৃদ্ধা—সবাই সবসময় জাতীয় পোশাক পড়েন।
আমাদের ছয়জনের জন্য দুটি গাড়ি পারো এয়ারপোর্টে অপেক্ষমাণ ছিল। গাড়িতে ওঠার আগে সবাই তো বিমানবন্দরের চারপাশের মেঘ দেখে আনন্দে আত্মহারা, ছবি তুলতে ব্যস্ত। এয়ারপোর্টের কারুকাজ ও নকশা দেখে সবাই মুগ্ধ। ভুটানের ঐতিহ্য অনুযায়ী কাঠমিস্ত্রি সৌরশক্তি ও স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিমানবন্দরের নকশা তৈরি করেছে।
এবার আমাদের যাত্রা শুরু হলো ভুটানের ভিলেজ থ্রি গন্তব্যস্থানে। পাহাড়ের উঁচু-নিচু সরু পথে চলছি আমরা । চারদিকে সাদা মেঘের ভেলা উড়ছে। কখনো কালো কখনো সাদা মেঘ হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে। চলার পথে দেখা যায় পাহাড়ের ঢালুতে গ্রামের জীবন প্রকৃতির সঙ্গে জড়িত ভুটানিজদের জীবনধারা। মেঘে ঢাকা আকাশ, পাহাড়, নদী ও সবুজ বনাঞ্চল ভুটানের পরিবেশকে অত্যন্ত সুন্দর ও শান্ত করে রেখেছে। এককথায় বলা যায়, সুখী মানুষের দেশ ভুটান।
ভুটানের নাগরিকরা গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠে। কৃষিকাজ তাদের আয়ের প্রধান উৎস। ধান, ফলমূল ও সবজি চাষ এখানকার অন্যতম প্রধান কাজ। ভুটানের গ্রামগুলো নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে ঠাসা। কাঠের বাড়ি, প্রার্থনার পতাকা ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক ভুটানের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভুটানের মানুষ এমনই সুখী যে তারা আধুনিক শিক্ষার সূচনার পর থেকে ভুটানের ৭০ শতাংশ এলাকায় সবুজায়ন করে জীবনকে প্রাণবন্ত করেছে, যেখানে মানুষ প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করে।
বেলা ১টায় আমাদের গাড়ি পৌঁছাল ভিলেজ থ্রিতে। সুউচ্চ পাহাড়ে ভিলেজ থ্রির অবস্থান। বিশাল পাহাড়ের ঢালে মনোরম পরিবেশে রিসোর্টে আমাদের থাকতে দেওয়া হলো। কিন্তু রুমে অক্সিজেনের অভাবে আমাদের সফরসঙ্গী রেজাউল একরাম রাজু ও মজিবুর রহমান স্বপন ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমরা উচ্চতায় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডলের চাপ কমে যায়। পরে তাদের স্থানীয় হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়েছে। অবশেষে সেদিনই সন্ধ্যায় স্থান পরিবর্তন করে আমরা চলে এলাম পারো নদীর তীরে পারো এয়ারপোর্ট এলাকায় তাশি নামগায়ে রিসোর্টে। পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপরীতে পারো নদীর তীরে এটির অবস্থান। রিসোর্টে বসে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায়। ঐতিহ্যবাহী ভুটানি স্থাপত্য নকশা এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধাগুলো একত্র করে ফাইভ স্টার মানের রিসোর্ট তৈরি করা হয়েছে। রিসোর্টের সামনে রয়েছে কৃষি খামার, প্রচুর আপেল, নাশপাতি ও ফুলের বাগান।
ভুটানের দ্বিতীয় দিনে সকাল ১০টায় আমাদের যাত্রা শুরু ভুটান ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রামে। পাহাড়ের ঢালে সরু রাস্তায় প্রায় ছয় হাজার ফুট ওপরে উঠবে গাড়ি। ট্রাফিক জ্যাম, গাড়ির হর্নের বিকট শব্দ, কালো বিষাক্ত ধোঁয়া—কিছুই নেই ভুটানে, নেই রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল। ট্রাফিক পুলিশরাই গাড়ি ও রাস্তার সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করেন। ভুটানে কাউকে কখনো ট্রাফিক জ্যামের মুখে পড়তে হয় না।
পারো থেকে থিম্পু
ভ্রমণের তৃতীয় দিনে সকাল ১০টায় আমরা পারোর তাশী নামগায়ে রিসোর্ট থেকে ভুটানের রাজধানী শিমপুর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছি। সঙ্গে আমাদের গাইড হিসেবে রয়েছেন ভুটান টুরিজম ডিপার্টমেন্টের সদস্য সোনম দর্জি। পারো থেকে থিম্পুর দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার । যেতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। তবে আমাদের সময় লেগেছে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। যাওয়ার পথে পারো নদীর তীর বনমোরগ দিয়ে দুপুরের খাবার খাই। নদীর ধার, ছোট জনপদ, সবুজ উপত্যকা, স্থানীয় বাসিন্দাদের ফল হস্তশিল্পের দোকান এবং বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে দেখতে থিম্পু যাওয়া ছিল আমাদের বিলম্বের মূল কারণ।
থিম্পুতে দর্শনীয় স্থান
রাজধানী শহর থিম্পুতে হাঁটা দূরত্বেই দেখা যাবে থিম্পু নদী, মেমোরিয়াল চর্টেন, সিটি ভিউ পয়েন্ট, ক্লক টাওয়ার, থিম্পু জং, পার্লামেন্ট হাউস, লাইব্রেরি ও থিম্পু ডিজং। শহর থেকে একটু দূরেই রয়েছে বুদ্ধ দর্দেন্মা স্ট্যাচু, থিম্পু ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চর্টেন ও চিড়িয়াখানা, যেখানে সংরক্ষিত আছে ভুটানের জাতীয় পশু তাকিন।
ঘুরে আসতে পারেন পুনাখা
যদি হাতে সময় থাকে তবে ঘুরে আসতে পারেন ভুটানের দর্শনীয় স্থান পুনাখা। পুনাখা ভুটানের সাবেক রাজধানী। ১৭০০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ভুটানের রাজধানী ছিল পুনাখা। এরপর রাজধানী থিম্পুতে স্থানান্তরিত হয়। রাফটিংয়ের জন্য জগদ্বিখ্যাত পুনাখা। এছাড়া রয়েছে, পুনাখা জং, আর্ট স্কুল, ন্যাশনাল লাইব্রেরি ও ফোক হেরিটেজ জাদুঘর, লাখাং মন্দির, তালো মনস্ট্রি ও পেলিরি মন্দির ঘুরে চলে যাওয়া যেতে পারে ফু ছু নদীতে।
কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশ থেকে বিমান অথবা বাই রোডে বা সড়কপথে ভুটান যাওয়া যায়। বর্তমানে ভারতের ভিসা বন্ধ থাকায় একমাত্র যাওয়ার অবলম্বন হচ্ছে বিমানে। এক্ষেত্রে ভুটানের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন ড্রুকএয়ার সপ্তাহে দুদিন বাংলাদেশ-ভুটান চলাচল করে।
ভিসা প্রসেসিং
বাংলাদেশিদের জন্য ভুটানে যেতে আগে থেকে ভিসার প্রয়োজন নেই। ভুটানের ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট দেখালে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সাত দিনের ভিসা পাওয়া যায়। সাত দিনের বেশি ঘুরতে চাইলে থিম্পু ইমিগ্রেশন অফিস থেকে আলাদা করে পারমিট নিতে হয়।