সাহিত্য আমাদের চিন্তার বাহন; কিন্তু সে বাহনমাত্র নয়। সাহিত্য এক প্রক্রিয়া, গতি, যা চিন্তাকে তার উৎসের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সাহিত্য যে উপাদানগুলোর সমন্বয়ে গঠিত, সেগুলোকে যদি বিশ্লেষণ না করা হয়, তবে সাহিত্য শুধু প্রকাশের মাধ্যম হয়ে থাকবে, আত্ম-অনুসন্ধানের পথ রচনা করবে না। আমরা তখন ভাবব, কিন্তু ভাবনার উৎস ও গন্তব্য জানা থাকবে না। কেবল প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করব—যেন জণগণের ক্ষোভ, যা সময়ের প্রতি প্রতিধ্বনি মাত্র।
সাহিত্যিক গাঁথুনির যে নির্মাণ, যেখানে ধারণা, ভাষা, অনুভূতি ও ইতিহাসের স্তরগুলো মিলিত হয়—সেই স্টেজ যদি নির্মিত না হয়, তবে আমাদের উচ্চারণও মঞ্চহীন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ চিন্তার রূপান্তর তখন ঘটবে না, উচ্চারিত হবে কেবল তার আকুতি।
জুলাই ২০২৪, আমাদের সামনে এক বিরতিচিহ্ন টেনে দিয়েছে। এই বিরতি আসলে এক অন্তর্বর্তীকাল। আমাদের ভূমি, আমাদের ইতিহাস, আমাদের অভ্যন্তরীণ ভূগোল কখনোই নিরবচ্ছিন্ন আনুকূল্যের মধ্যে ছিল না। এখানে প্রতিটি স্থিতি আসলে ঝড়ের প্রস্তুতি, প্রতিটি শান্তি পরবর্তী অস্থিরতার ভূমিকা। আনুকূল্যের মুহূর্তে আত্মসমালোচনা করতে হয়, বিরতির মধ্যেই পরবর্তী ঝড়ের জন্য প্রস্তুত হতে হয়। কেননা চিন্তার স্থবিরতা বা চর্বণ নয়, তার ধারাবাহিক নবজন্মই আমাদের প্রকৃত ঐতিহ্য। এই নবজন্ম পুনর্গঠনের দাবি করে।
আমাদের পুনর্গঠিত সাহিত্যে থাকবে ontological vessel, যার ভিতর দিয়ে চেতনার ধারা নিজেকে প্রকাশ করে। এই সাহিত্য কোনো বিচ্ছিন্ন শিল্প নয়, বরং আত্মপরিচয়ের ভাষিক ও ঐতিহাসিক বুনন।
কিন্তু আত্মপরিচয়ের গঠন কেমন হবে, এটা মুখ্য সওয়াল। এক্ষেত্রে আমি existential reconstruction-এর কথা বলছি; নিজেকে পুনর্গঠনের জন্য নিজের অস্তিত্বের উপাদানগুলোকে বিশ্লেষণ করা, তাদের উৎস ও কার্যকারিতা খুঁজে বের করা এবং নতুনভাবে স্থাপন করার কথা বলছি । পুনর্গঠনের জন্য আমি আমার চিন্তা ব্যবস্থাকে, আমার সাহিত্যকে, আমার আত্মপ্রকাশকে, আমি যেসব উপাদান দিয়ে আমি হয়ে উঠি—এই উপাদানগুলোকে আবিষ্কার করব এবং তাকে প্রতিষ্ঠিত করব, প্রতিস্থাপন করব।
কাজটি বোঝার জন্য আমরা যেসব উপাদানের দিকে তাকাতে পারি, এর মধ্যে একটা হলো সাংস্কৃতিক সীমান্ত। একটা রাষ্ট্রের সীমান্ত থাকে—ভূমি, পানি ও আকাশ দিয়ে এ সীমান্ত গঠন করা হয়। কিন্তু সংস্কৃতিরও একটা সীমান্ত থাকে। সংস্কৃতির সীমান্ত রাষ্ট্রীয় সীমান্তকে অতিক্রম করে। রাষ্ট্রের সীমানা পরিবর্তনশীল—সে রাজনীতি ও যুদ্ধের ফলাফল।
কিন্তু সংস্কৃতির সীমান্ত গঠিত হয় আচার, বিশ্বাস, স্মৃতি, ভাষা, প্রতিরোধ ও প্রতীক দ্বারা। রাষ্ট্রের সীমান্ত বারবার বদলায়, কিন্তু সংস্কৃতির সীমান্ত আলাদা। এটা যে অনড় বা স্থানু, তা নয়। কিন্তু সাংস্কৃতিক সীমান্তটা খুব কম বদলায়। আমাদের সাংস্কৃতিক সীমান্ত আজও আছে, ছিল অতীতেও।
এখানকার বুদ্ধিজীবীদের চোখে বিষয়টা খুব কমই ধরা পড়েছে। আমাদের যে সাংস্কৃতিক সীমান্ত আছে, এটা আমরা বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে পাই, এই সীমান্ত পৌরাণিক সাহিত্যের মধ্যে আছে। সংস্কৃত ভাষার দুই হাজার বছর পূর্বের বয়ানের মধ্যে তাকে পাই। আমরা দেখতে পাই, বৈদিকরা কবিতা আকারে, মন্ত্র আকারে আমাদের তিরস্কার করছে। বৈদিক সাহিত্যে এই অঞ্চলের প্রতি ঘৃণা, তিরস্কার এবং অসুরভূমি আখ্যাদান আসলে এক গভীর civilizational anxiety প্রকাশ করে। এর মানে হলো, তারা এখানকার সভ্যতা, জাতি বা সংস্কৃতির প্রতি গভীর ভয়, অনিশ্চয়তা ও মানসিক প্রতিক্রিয়ায় বিচলিত ছিল। বাংলাকে তারা শুধু রাজনৈতিক বা সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেনি; বরং অস্তিত্বগত ও সাংস্কৃতিক স্তরে হুমকি হিসেবে দেখেছিল। এই পরিস্থিতিতে আধিপত্যবাদীরা ঘৃণা, তিরস্কার, দমন ও সাংস্কৃতিক উচ্ছেদের চেষ্টা করে। তারাও সেটা করেছিল।
বৃহৎ বঙ্গ বরাবরই ছিল বৈদিক আর্য সংস্কৃতির বাইরের দেশ। বৈদিক আর্যভাষীরা ভারতের পূর্বাঞ্চল বিদেহ বা মিথিলা পর্যন্ত তাদের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছিল। তাদের প্রত্যেকটা অভিযান বাংলায় এসে থেমে গেছে। আমাদের যেটা করতোয়া নদী, সেটাকে তারা বলত সদানীরা, এই নদীর ওপারে তাদের বিজয় অভিযান কখনো আসেনি। বিজয়ী হয়ে যখন আসতে পারেনি, তখন তারা এই ভূমিকে বলেছে অসুরের ভূমি, দস্যুর ভূমি, পাশবিক ভূমি। এখানকার ভাষাকে ইতরের ভাষা, জঙ্গলের ভাষা, আরণ্যক ভাষা ইত্যাদি অভিধা দিয়েছে, তিরস্কার করেছে। যেহেতু তারা আমাদের অধিকার করতে পারছে না, দখল করতে পারছে না এবং আমরা তাদের অনবরত প্রতিরোধ করছি। ফলে তারা বলেছে, ওই ভূমিতে কেউ যদি তীর্থের জন্য যায়, তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কারণ সে সাংস্কৃতিক পবিত্রতা হারিয়েছে। অর্থাৎ এখানে একটা সাংস্কৃতিক সীমান্ত ছিল।
মজার ব্যাপার হলো, যাকে আর্যরা বলছে প্রায়শ্চিত্ত করার ভূমি, নিকৃষ্ট ভূমি—সেই ভূমি দখল করার জন্য একের পর এক অভিযান করছে! এই ভূমিকাটাকে কীভাবে নিজেদের করে নেওয়া যায়, এই চিন্তায় তাদের শাসকশক্তি সক্রিয় এবং তাদের চিন্তক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দও বিচলিত।
এই প্রতিরোধী মানুষ হলেন এখানকার অস্ট্রিক, নর্ডিক, দ্রাবিড়, আলপাইন ইত্যাদি জনগোষ্ঠী, এখানকার ভূমির সন্তানরা। তাদের ছিল সংহত রাষ্ট্র ও সমাজ, সবল শাসক। তারা খ্রিষ্টপূর্ব চার শতক পর্যন্ত আর্য প্রভাবকে এখানে ঢুকতে দেয়নি । মৌর্যদের বিজয়ের পর থেকেই আর্য প্রভাব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, বিশেষ করে অশোকের আমলে প্রশাসনিক ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তৃত হয়। পরবর্তী সময়ে গুপ্ত যুগে (চতুর্থ-পঞ্চম শতক) আর্য ধর্ম, সংস্কৃত ভাষা ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি বাংলায় স্থায়ীভাবে শিকড় গাঁথে। আর্যদের আধিপত্য মূলত সাংস্কৃতিকভাবে জয়ী হয়। এই আধিপত্য সওয়ার হয় ভাষার ওপর, হামলা করেছিল জীবনবোধের ওপর, বিশ্বদৃষ্টির ওপর। জীবনটাকে কীভাবে দেখব, জগৎটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব, তার একটা দৃষ্টি এবং ভঙ্গি তারা নিয়ে এসেছিল এখানে। সামাজ বিন্যাসের জন্য বর্ণবাদ তারা নিয়ে এসেছিল। তারা কাস্ট হায়ারার্কির ভিত্তিতে পিরামিডাকৃতির সমাজ গঠন করে। যেখানে সবার ওপরে ব্রাহ্মণরা। আর সবার নিচে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, বিশেষত দ্রাবিড়রা। এই শ্রেণিবিন্যাস শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয়ভাবে বৈধতাপ্রাপ্ত বৈষম্য ব্যবস্থা গঠন করে, যেখানে জন্মগতভাবে সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়।
এই ব্যবস্থার মাধ্যমে আর্যরা একটি হেজেমনিক সোশ্যাল অর্ডার প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে উৎপাদন, কর, শাস্তি ও ন্যায়বোধের ক্ষেত্রেও বৈষম্যকে স্থায়ী ও পবিত্র আইন বানানো হয়। ব্রাহ্মণ শ্রেণি করমুক্ত, মর্যাদাসম্পন্ন ও অপরাধের ঊর্ধ্বে; অন্যদিকে শূদ্র ও দ্রাবিড় শ্রেণি শ্রমনির্ভর, করদাতা, অবমূল্যায়িত ও সমস্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
বাংলায় একটি জাতিগত দমনভিত্তিক সামাজিক বিন্যাসের উদ্ভব হলো, যেখানে বৈদিক সংস্কৃতি ও ধর্ম ব্যবহৃত হয়েছে শ্রেণিশক্তির বৈধতা প্রতিষ্ঠার উপকরণ হিসেবে। এই বৈষম্য ব্যবস্থার সঙ্গে আমরা লড়েছি হাজার বছর। এই আধিপত্যের মূল চরিত্রে যুক্ত ছিল ভাষাগত উপনিবেশ বা Linguistic Colonization । সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে আর্যরা এক ধরনের সাংস্কৃতিক শ্রেণিবিন্যাস তৈরি করে, যা স্থানীয় দ্রাবিড় ও মাগধী-ভাষাভাষী জনগণ ও তাদের ভাষাকে লাঞ্ছিত করতে থাকে। ভাষা এখানে শুধু যোগাযোগের উপকরণ নয়, বরং ক্ষমতাচর্চার মাধ্যম হয়ে ওঠে।
বাংলার মানুষ এই আধিপত্যবাদের সঙ্গেও লড়েছে। আর্যদের সঙ্গে লড়েছে মানে সামগ্রিক একটা জীবনবোধের সঙ্গে লড়েছে। লড়েছে তারা, যারা এই ভূমিতে ধান নিয়ে এসেছে, গম নিয়ে এসেছে, চাষের পদ্ধতি নিয়ে এসেছে। যাদের জীবনাচার বাংলার মন ও ভূমির চরিত্রগঠন করেছে, আকার গঠন করেছে, খাদ্যরুচি গঠন করেছে, মনোচরিত্র ও মেজাজ নির্মাণ করেছে এবং আমাদের ভাষার শব্দসম্ভারের মধ্যে এখনো সেই পূর্বপুরুষের স্বাক্ষরগুলো রয়ে গেছে। আমাদের রক্তের মধ্যে বহন করছি, চোখের গঠনের মধ্যে বহন করছি, কপালের খুলির মধ্যে বহন করছি। এর সঙ্গে পরে আর্যদের প্রভাবও যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মূলীভূত আকার গঠন করেছে এই দ্রাবিড়-অস্ট্রিকরা। এই মানুষগুলো পরে বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করেছে। এই মানুষগুলো জৈন হয়েছে। এই মানুষগুলো চর্যাপদ রচনা করেছে। এরা লড়ছিল বৈদিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে। সব রকমের জুলুম-নিপীড়নের স্রোতের সামনে লড়াই ত্যাগ করেনি। এরাই মুক্তি সন্ধান করল ইসলামের দাওয়াতে। ইসলামের সত্যের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল সবচেয়ে বেশি বৌদ্ধরা, তারপর নিম্নশ্রেণীয় মজলুম হিন্দুরা। ইতিহাসের এই যে ধারা, সেটা আমরা জানি না, জানতে দেওয়া হয় না। এর পেছনে আছে ব্রিটিশ উপনিবেশের রাজনীতি।
ব্রিটিশরা যে হিস্ট্রি আমাদের শেখাল, সেখানে দুটা পক্ষ তৈরি করেছে—একটা বহিরাগত, আরেকটা স্থানীয়। সব অঞ্চলে একটা বহিরাগত শ্রেণি তারা তৈরি করেছে, কারণ ব্রিটিশরা বহিরাগত। এখানকার সম্মিলিত জনগোষ্ঠী তাদের আধিপত্যের মোকাবিলা করছে। এই মোকাবিলাটাকে ভাঙতে হলে এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আরেকটা বহিরাগত শ্রেণি বানাতে হবে। তাই তারা মুসলিমদের বহিরাগত বানাল। দেখাতে চাইল, এখানকার ভূমি, ভাষা ইত্যাদির শত্রু হচ্ছে মুসলিমরা। এর প্রতিফলন এখনো তাজা—আমাদের বাচ্চাদের আমরা শিখাচ্ছি আমাদের সাহিত্যে একটা অন্ধকার যুগ আছে এবং ১২৫০ সাল থেকে সেটার শুরু । ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজির নদীয়া জয়ের ঘটনা ঘটল, তার পর থেকে অন্ধকার যুগ শুরু হয়ে গেল। তারপর প্রায় দেড়শ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার যুগ ছিল। এর মানে এই যে, আমি এই পুরো বয়ানটাকে ভাঙার কথা বলছি। কারণ উপনিবেশ যেভাবে দেখিয়েছে—আমার সন্তান সেভাবেই দেখছে আমার ইতিহাসকে। দেখছে মুসলমানরা এখানে অন্ধকার বহন করে নিয়ে এসেছিলেন। যারা এই বিবরণ দিয়েছে, তারা বলেছে, এই সময়ে নিষ্ঠুরতা এমন চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, বাঙালি সাহিত্য চিন্তা করবে, সাহিত্য সৃষ্টি করবে, এই অনুভূতি সে হারিয়ে ফেলেছিল। এই অন্ধকার যুগ ব্যাকরণগ্রন্থের মধ্যে আছে—স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেউ চ্যালেঞ্জ করছে না, প্রশ্ন করছে না। এই আরগুমেন্ট সম্পূর্ণ ভুল।
নিষ্ঠুরতা যখন চরমে যায়, তখন মানুষের সৃষ্টিশীল অনুভূতিগুলো সজাগ হয় এবং সে সময় মানুষ সবচেয়ে ভালো সৃষ্টিকর্ম করে। বাঙালি তার সবচেয়ে খারাপ সময়ে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছে, নজরুলকে পেয়েছে।
ঔপনিবেশিক যে মানসগঠন, ঔপনিবেশিক যে শৃঙ্খলা, গোটা শৃঙ্খলের আদত কাঠামোটাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে আমাদের। আমাদের সাংস্কৃতিক সীমান্ত যদি রক্ষা করতে না পারি রাজনৈতিক সীমান্ত আমরা হারাব। রাজনৈতিক সীমান্ত অকার্যকর হয়ে যাবে। অতএব আমাদের পরিচিত হতে হবে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের উত্তরাধিকারের সঙ্গে। বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের প্রতিরোধ কেবল রাজনৈতিক ছিল না, ছিল একই সঙ্গে সাংস্কৃতিকও, দার্শনিকও।
এই প্রতিরোধের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছে বৌদ্ধ-চর্যা, লোকসংস্কৃতি ও মরমি-চিন্তার ঐতিহ্য। এই ধারা সাহিত্যকে এক মুক্ত চেতনার আশ্রয় দিয়েছে, যেখানে আত্মা, ভূমি ও ভাষা একে অপরের সহযোগী শক্তিতে পরিণত হবে।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভাষার মুক্তি ও আত্মপরিচয়ের পুনরুদ্ধার। সংস্কৃতির পুনর্গঠনের প্রথম শর্ত ভাষার মুক্তি। ভাষা যখন শাসকশ্রেণির অস্ত্র হয়ে ওঠে, তখন সাহিত্যই হয়ে ওঠে প্রতিরোধের নতুন ব্যাকরণ। বাংলা ভাষা তার অস্তিত্ব অর্জন করেছে এই প্রতিরোধের ধারায়—সংস্কৃতের আধিপত্য ভেঙে, সাধারণ মানুষের ভাষাকে আত্ম-অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
আরেকটি বিষয় হলো, সাহিত্যিক পুনর্গঠন ও আত্মসত্তার রূপায়ণ। এই পর্যায়ে সাহিত্য আর কেবল শিল্প থাকে না, অস্তিত্বের পাত্র হয়ে ওঠে। যেখানে চেতনা নিজের অস্তিত্বের ইতিহাসকে চিনে ফেলে।
বাংলার সাহিত্যিক ঐতিহ্য সেই অস্তিত্ববোধের ভিতর দিয়ে এক ধরনের অস্তিত্ব-অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা রচনা করেছে, করবে।
আরেকটি দিক হলো ঐতিহাসিক স্মৃতি ও নৈতিক ধারাবাহিকতা। বাংলার ইতিহাসে বারবার ধ্বংস ও পুনর্গঠন ঘটেছে; কিন্তু আত্মতার স্মৃতি কখনো লুপ্ত হয়নি। এই স্মৃতিই সাহিত্যিক চেতনার নৈতিক কেন্দ্র। প্রতিটি যুগে সাহিত্য সেই স্মৃতিকে পুনঃপাঠ করে, পুনর্নির্মাণ করে—যাতে ইতিহাস হয়ে ওঠে এক নৈতিক উপস্থিতি।
আরেকটি দিক হলো ইসলাম ও মুক্তি-চেতনার সংযোগ। বৌদ্ধ-দ্রাবিড় ঐতিহ্যের মুক্তি-আকাঙ্ক্ষা ইসলামের ন্যায়ের দর্শনের সঙ্গে মিশে এক নতুন মানবতাবাদী রূপ নেয়। এই সংযোগের মধ্য দিয়েই বাংলার সাংস্কৃতিক আত্মা তার সামাজিক সমতা, ন্যায় ও একত্ববোধের ভিত্তি পায়। বাংলার সাহিত্য ও সমাজ এই মিলনের ধারাতেই পুনর্জন্ম লাভ করে, যেখানে ইসলাম বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক বিপ্লব।
আরেকটি কাজ করতে হবে। আধুনিকতার প্রশ্ন ও চিন্তার উপনিবেশ মোকাবিলা করতে হবে। ইউরোপীয় আধিপত্য বাংলায় নতুন ধরনের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। এমনকি জ্ঞান ও চিন্তার ক্ষেত্রেও। তারা উপনিবেশ গড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও একাডেমিক কাঠামোর ভিতরেও। সাহিত্যকে আবার সেই প্রতিরোধের বাহন বানাতে হবে, এবার লক্ষ্য হয় জ্ঞান ও চিন্তার মুক্তি।
আরেকটা জরুরি কাজ হলো আত্মপরিচয়ের সমকালীন পুনর্গঠন। আজ আমাদের সামনে প্রশ্ন—আমরা কারা, কোথা থেকে এসেছি এবং কীভাবে আমরা আমাদের চেতনার ইতিহাস বহন করব? এই পুনর্গঠন মানে অতীতের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং তার দার্শনিক পুনর্নির্মাণ।
বাংলার সাহিত্য যদি এই কাজ করতে চায়, তবে তাকে বহন করতে হবে জাতিসত্তার চিন্তার আত্মজীবনী, যেখানে ইতিহাস, ভূমি, ভাষা ও মানবিক ন্যায়ের ধারা একসূত্রে গাঁথা থাকবে।