হোম > সাহিত্য সাময়িকী > গল্প

আম্মা ও কুইন্সল্যান্ড

সাঈদ ইসলাম

দুদিন পার হতেই আম্মা বলা শুরু করল, ‘দম বন্ধ বন্ধ লাগে।’ বিষয়টা স্বামী-স্ত্রী কারো কাছেই সুখপ্রদ ছিল না। ব্যালকনিতে দাঁড়ালে খোলা হাওয়ায় মন ভরে যায়। কিচেনের পেছনটায় চেরির বাগান। শীতের মৌসুমে প্রায়ই মনে হয় আরেকটু আড়াল থাকলে ঘরগুলো গরম থাকত। সারা রাত ঘুম হলো না। ভোরে উঠে দেখি আম্মা ইজি চেয়ারে বসে পথে প্রবাসে পড়ছেন। অন্যান্য দিন আমাকে ডেকে তুলে বাইরে হাঁটতে বের হন। আজ একটা কথাও বললেন না। মনটা খচখচ করতে থাকল।

সারাকে নিয়ে একাই বের হলাম। বাসার খুব কাছেই ম্যাকাসিকি পার্ক। আরেকটা আছে বেনুন, একটু দূরে। আমরা সাধারণত ম্যাকাসিকিতেই আসি। জিমন্যাস্ট করা ইয়াং কিছু ছেলে আর দু-চারটা রোমান্টিক কাপল ছাড়া বাকি সব বয়স্ক লোকজন। তারা আসে দল বেঁধে। বাংলাদেশের মত কুইন্সপার্কে ব্যায়াম করতে আসা লোকজন নিজেদের গল্প করে না। রোবটের মতো নিজের কর্ম করে ঘরে ফেরে। অনেকেরই মুখচেনা, হাই হ্যালো ছাড়া কথা বলার তেমন সুযোগ হয়নি। এখানে রিটায়ার্ড পল্লির লোকজনের আধিক্য। ওল্ড হোম থেকেও আসেন অনেকে। একেকটা মুখ যেন বিচ্ছিন্ন বদ্বীপ। শেষ কবে পরিবারের কাউকে দেখেছে তাও হয়তো মনে নেই। মদারস-ডে, ফাদারস-ডে, আর ক্রিসমাস ছাড়া বছরের বাকি দিনগুলো একাই কাটে। সারার পীড়াপীড়িতে দ্রুত বাসায় ফিরি।

প্যারেল, আমাদের তিনতলায় থাকে। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করছে।

আম্মাকে ওই দিক থেকে আসতে দেখে জানতে চাইলাম, কই গেছিলা?

নিজের চোখেই তো দেখলা, আবার জানতে চাও কেন?

আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। আম্মার এমন আচরণের কোনো কারণ খুঁজে পাই না। বাংলাদেশ ছেড়ে এসেছি প্রায় ৯ বছর। বিভিন্ন অকেশনে চার-পাঁচবার যাওয়া হয়েছে। আম্মা কুইন্সল্যান্ডে এই প্রথম। খুব সম্ভবত দেশের জন্য মন কেমন করছে। আফটারনুনটিতেও এলেন না। উঁকি দিয়ে দেখি রান্নাঘরে রাজ্যের জিনিস নিয়ে বসেছেন। হালুয়া বানানোর উপকরণ। আম্মার হাতের হালুয়া দুনিয়ার সেরা জিনিসের একটা।

মিটসেফের ভেতর হালুয়ার ঘ্রাণে তৃষ্ণামাখা শৈশব ছিল আমার। আম্মা ছিলেন আমাদের কাছে জাদুকর, স্রেফ জাদুকর।

সন্ধ্যায় গ্যারেজে শব্দ হতেই আম্মা হালুয়াভর্তি বাটি এনে বললেন, যা ছেলেটারে দিয়ে আয়।

আমার কাছে বিষয়টা কৌতুকের মতো লাগল!

কোন ছেলে?

আম্মা কপাল কুঁচকে বললেন, প্যারেল।

আমি রাজি না হওয়ায় আম্মা নিজেই গেলেন। মিনিট তিনেকের ভেতর হালুয়ার বাটি হাতে ফিরেও এলেন।

সেই রাতে ভাত খেলেন না, এমনকি আমাদের সঙ্গে কোনো কথাও বললেন না। পরদিন আম্মাকে বোঝালাম, এখানকার কালচার আমাদের মতো নয়। সবাই ইন্ডিভিজুয়্যাল। কেউ কাওরে গোনে না। হেল্পের জন্য তারা প্রতিবেশীকে না ডেকে ইমারজেন্সিতে কল করে। ব্যালকনিতে নিয়ে সামনের আমের বাগান দেখিয়ে বললাম, দেখছ কত আম পইড়া রইছে! কেউ একটাতে হাতও দেবে না। নিপা ভাইরাস হইব!

বছর দুয়েক আগের ঘটনাটা আম্মার সঙ্গে শেয়ার করলাম। তখন এই বাড়িতে নতুন এসেছি। সারার বাবা তখনো আসেনি। মার্চের প্রচণ্ড গরমে এসি ছাড়া টেকা মুশকিল। আমাদের আসার চার দিন পর এলো রিহান হাওয়ার্ড। বয়সে আমাদের কাছাকাছি হবে। এক লরি মালামাল নিয়ে একাই সব সামলাতে থাকল। দেখেই বুঝতে পারলাম আনাড়ি, কাজকর্মে হাত একেবারেই কাঁচা। কিছুক্ষণ পরপর বসে পড়ছে আর টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছছে। ফ্রিজ থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি এগিয়ে দিয়ে বললাম, হ্যালো, আই অ্যাম ফারজিনা।

আই অ্যাম রিহান। বলে বইয়ের একটা শেলফ টানতে টানতে সিঁড়ির কাছে নিতেই একটা পায়া ছুটে গেল।

আমি বোতল হাতে দৃশ্য দেখছি। এক ঘুম দিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ উঠলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি রিহান একটা টেবিলে ঠেস দিয়ে আকাশ দেখছে। তখনো অনেক জিনিস গোছানোর বাকি। আমি একটা জুসের বোতল আর ঘরে বানানো দুটা স্যান্ডুইচ নিয়ে নিচে নামলাম। তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, ক্যান আই হেল্প ইউ?

অতিরিক্ত দায়িত্ববোধ আমাকে নতুন অভিজ্ঞতার সামনে দাঁড় করালো। এক ঘণ্টার মাঝে বছর সাতাশ কি আঠাশ হবে একটা ছেলে এসে রিহানের সব মালামাল প্রায় একাই গুছিয়ে ফেলল। মনে মনে ভাবলাম, মেয়েটার রাতটা অন্তত কাজ করতে হলো না।

দিন তিনেক পর বেবুন পুলিশ স্টপ থেকে কল এলো। সারার বাবাসহ আমাকে দেখা করে বিষয়টা তাদের বুঝিয়ে বলতে হলো। শেষে রিহানের কোনো অবজেকশন না থাকায় আমরা বাড়ি ফিরলাম!

তাকিয়ে দেখি আম্মা চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ডেকে তুলতেই জানতে চাইলেন, তারপর কী হইল?

মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। ধুর কিছু না, বলে বেডরুমে চলে এলাম।

এক মাস থাকার কথা থাকলেও দুই সপ্তাহ যেতে না যেতেই আম্মা দেশে ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলেন। উপায় না দেখে আমিও জোড়াজুড়ি করলাম না। তার কথা বলার মানুষ নেই! সারা তার নানুর জন্য কান্নাকাটি করায় কষিয়ে এক থাপ্পড় লাগালাম। রোববার রাতে ফ্লাইট ঠিক হলো। আম্মা আগের দিনই সব গুছিয়ে রাখলেন। আমি রাগে কোনো কিছুতেই হাত লাগালাম না। রাত ৯টায় এয়ারপোর্টের উদ্দেশে বের হলাম। সারা আম্মার কোলে বসে গল্প করছে। সারার বাবা বসেছে ড্রাইভারের পাশের সিটে। আমি জানালা দিয়ে শহর দেখছি। এত বছর থাকার পরেও কেমন অচেনা অচেনা লাগে। গাড়ি থেকে নেমে ওয়েটিংয়ে অপেক্ষা করছি। চেয়ে দেখি প্যারেল বিশাল এক কালো লাগেজ নিয়ে আমার পাশে বসেছে। কোথায় যাবে কে জানে! আমি উঠে অন্যপাশে হাঁটতে লাগলাম। দেমাগ বাংলাদেশিদেরও কম কীসে! প্লেনে ওঠার সময় হয়ে এলো। আম্মা আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলেন। আমিও হু-হু করে কাঁদলাম। বিদায় নিয়ে ফ্লাইটের দিকে এগুলেন। আম্মার পেছন পেছন প্যারেলও হাঁটতে থাকল। কিছুদূর গিয়ে বাঁ হাতে তার হোঁতকা ব্যাগটা নিয়ে ডান হাত আম্মার কাঁধে রাখল। আমি অবাক হয়ে সারার বাবার দিকে তাকালাম। সে বলল, আমি তো দুটো টিকেটই করেছি!

প্যারেলও প্রতি সিমেস্টার ব্রেকে এক মাস ভলান্টিয়ার সেবা দেয়। এবার যাচ্ছে বাংলাদেশে।

আম্মা ও প্যারেল হাঁটছে। আম্মার কাঁধে প্যারেলের হাত ক্রমেই ছায়ার মতো ক্ষীণতর হচ্ছে। বিদেশ-বিভুঁইয়ের এই এয়ারপোর্ট হঠাৎই কেমন চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে আকুয়ার বাসায় সাত বছরের আমি মিটসেফের সামনে দাঁড়িয়ে। পুকুরে গোসল সেরেই আম্মা ফিরে আসবেন। ভেসে আসবে হালুয়ার ঘ্রাণ। মুক্ত হবে জাদুর বাটি। আম্মাকে মনে হবে জাদুকর, স্রেফ জাদুকর!

নায়িকার ছবি

অবসর জীবনে

ভুল নামে ভোর

রাফ খাতা

আয়নাঘর

হয়তো পোয়েটিক জাস্টিস, হয়তো দুর্ভাগ্য