হোম > মতামত

বাংলাদেশ ঘিরে দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্ব

ইমরান রহমান

সৃষ্টির শুরু থেকেই জীবজগতে ছোট-বড় প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের অলিখিত লড়াই চলছে। বিরামহীন এই লড়াইয়ে সবল প্রাণীরা অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের হারিয়ে ক্রমে এই গ্রহে নিজেদের দখল নিশ্চিত করেছে। এই লড়াইয়ের চূড়ান্ত বিজয়ী মানুষ। এই বিজয় জল, স্থল, বৃক্ষ ও অন্তরিক্ষে একক কর্তৃত্ব শুধু তারই—এই বদ্ধমূল উপলব্ধি মানুষকে দিয়েছে। মানুষ তার এই পক্ষপাতদুষ্ট ভাবনাকে যৌক্তিক করতে গিয়ে বেমালুম ভুলে যাচ্ছে স্রষ্টার বিধান। পাখির অবাধ বিচরণের জন্য স্রষ্টা আকাশ সৃষ্টি করলেও মানুষ নির্বিচার ক্ষেপণাস্ত্রের গর্জনে তার সুনীল বুক বিদীর্ণ করতে কসুর করছে না; নিঃশ্বাসে খুশবুর বাহক হিসেবে বাতাসের সৃষ্টি হলেও তা প্রতিনিয়ত বিষাক্ত করে তুলছে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারে।

প্রকৃতির সঙ্গে এই সংঘাতের ইতিহাসে দেখা যায়—মহামারি, বন্যা, খরা, ভূমিধস, নদীভাঙন ও দাবানলের মতো বিপর্যয়গুলো মানুষকে শুধু দুর্ভোগেই ফেলেনি, বরং এসব দুর্যোগ তাকে পৃথিবীতে টিকে থাকার নানা শিক্ষাও দিয়েছে। প্রতিকূলতার মুখে বেঁচে থাকার সংগ্রামে সে নিজেকে বারবার চিনেছে নতুন রূপে! প্রকৃতির প্রতিটি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সে নিজের মধ্যে আবিষ্কার করেছে অজানা উদ্ভাবনী শক্তির, অপরিমেয় বৌদ্ধিক সক্ষমতার। প্রকৃতির সঙ্গে এই লড়াই থেকে মানুষ যে শিক্ষা পেয়েছে, পৃথিবীর আর কোনো শিক্ষাই তার চেয়ে বড় নয়। আজকের ‘তথাকথিত’ সভ্য পৃথিবী আসলে প্রকৃতির অবিরাম মোকাবিলায় ভূমির সর্বাত্মক ব্যবহারজনিত মানুষের টিকে থাকারই গল্প।

মানুষ প্রকৃতির স্বভাব পরিবর্তন করতে পারেনি, পারবেও না; কিন্তু প্রকৃতির পরিবর্তিত আচরণের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখেছে। এভাবেই এতদূর এসেছে। ঠিক এ কাজটি করতে পারেনি বলেই কালক্রমে বহু প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে। এই অভিযোজন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মানবসমাজে সংঘটিত হয়েছে বড় বড় অভিবাসন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, এমনকি ধর্মান্তরের মতো ঘটনা। বিশ্বমানচিত্রে এসেছে আমূল পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য। প্লেগ থেকে শুরু করে কোভিড-১৯ পর্যন্ত ইতিহাসে অন্তত ৫০টিরও বেশি মহামারির রেকর্ড পাওয়া যায়। এসব মহামারি মানুষকে শুধু অসহায়ভাবে নিয়তির কাছে পরাজিতই করেনি, বরং তার জীবনধারা, আচরণবিধি, রাষ্ট্রীয় কর্মকৌশল, খাদ্যাভ্যাস—সবকিছুকে বদলাতেও বাধ্য করেছে।

কিন্তু আজ যেন প্রকৃতির চেয়েও মানুষের বড় প্রতিপক্ষ মানুষ নিজেই। মানুষে মানুষে এই দ্বৈরথের কারণ কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ, যা ছোট-বড়, সবল-দুর্বল প্রতিটি জীবেরই মৌলিক অধিকার। এই সম্পদগুলোর দুটো—বিশুদ্ধ পানি ও নির্মল বায়ু। এগুলো ছাড়া একটি বাসযোগ্য পৃথিবী অকল্পনীয়, অচিন্তনীয়।

তেল দখল নিয়ে যে যুদ্ধগুলো ২০শ শতকের ইতিহাস রচনা করেছে, তা অনস্বীকার্য। তবে এখনো নিশ্চিত করে বলা যায় না, ভবিষ্যতে বাতাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোনো যুদ্ধ হবে কি না। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের কারণ হতে পারে পানি, যা জীবনেরই অন্য নাম। অথচ এই জীবনধারক উপাদানকে বেসরকারীকরণ বা মালিকানায় নেওয়ার প্রচেষ্টায় পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের লড়াই। বাতাসের অবাধ প্রবাহের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে অদূর ভবিষ্যতে মানুষে মানুষে লড়াই হবে কি না—প্রশ্নটি কিছুটা হাস্যকর মনে হলেও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার কিন্তু মানুষের সেই উদ্দেশ্যেরই ইঙ্গিতবাহী। এই আবিষ্কারের কী বিরূপ প্রভাব জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ছে, তা মানুষের ভাবনার বিষয় নয়!

যা হোক, বাস্তবতা হলো বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক সম্পদ ও বিশুদ্ধ পানির উৎস নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যে প্রতিযোগিতা চলছে, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। পৃথিবীব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে পানির চাহিদা এই প্রতিযোগিতাকে আরো তীব্র করেছে। গুরুত্বপূর্ণ জলাশয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে গৃহীত পদক্ষেপ ও পাল্টা পদক্ষেপগুলো আন্তর্জাতিক অস্ত্রবাজারকে চাঙা করছে, বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিরক্ষা বাজেট।

বর্তমানে বিশ্বের নদী, সাগর ও মহাসাগরগুলো বৈশ্বিক ভূরাজনীতির সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)’ যদি আমরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি, দেখা যাবে এটি আসলে পশ্চিমাদের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তথাকথিত ‘গ্লোবালাইজেশন’-এর নামে গড়ে তোলা একচেটিয়া প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানানোরই কৌশল। এর ফলে বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে ঘটছে ব্যাপক পরিবর্তন, আর জলভিত্তিক অর্থনীতির বিকাশে বন্দরনগরীগুলো দিন দিন হয়ে উঠছে আরো সমৃদ্ধ ও সক্রিয়।

কোভিড-১৯-পরবর্তী পৃথিবী কেমন হবে, তা নিয়ে সারা বিশ্বে ছিল প্রবল কৌতূহল। মৃত্যুর পাশাপাশি এই মহামারি মানবজীবনের প্রতিটি হিসাব-নিকাশকেই নতুনভাবে করতে বাধ্য করেছে। পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক শক্তিগুলো অতিমারি সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদনব্যবস্থা, বাজার কাঠামো, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও।

সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাগুলো প্রশ্ন তুলছে—আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ কি পশ্চিম থেকে পুবে সরছে? পুঁজিবাদের বহু বছরের চর্চিত ‘গ্লোবালাইজেশন’ কি ক্রমে ম্লান হয়ে যাচ্ছে সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের আলোকচ্ছটায়? কোভিড-১৯-এর উৎপত্তিস্থল চীন এই সংকটকে কৌশলগত সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে বলেই মনে হয়। করোনার টিকা নিয়ে জাতীয়তাবাদী খেলায় বিশ্ব ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যেকার কাদা ছোড়াছুড়ি দেখেছে। কোভিড মোকাবিলায় চীনের সাফল্য যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকাংশেই ম্লান করেছে। চীন যখন করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে, তখন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগ এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। ইতালি, স্পেন, সার্বিয়া, ইরানসহ বহু দেশে করোনা মোকাবিলায় সহযোগিতা দিয়ে চীন পুঁজিবাদী বিশ্বের একাংশের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কোভিড মোকাবিলায় নিজেকে এক সুপারপাওয়ার হিসেবে উপস্থাপনের যে প্রচেষ্টা চীন চালিয়েছে, তা এক অর্থে নজিরবিহীন বলা যায়।

এশিয়ার ভূরাজনীতিতেও করোনার অভিঘাত আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতাকে তীব্রতর করেছে। কূটনীতিক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে এখন প্রবল আলোচনা চলছে—দক্ষিণ এশিয়াই কি হতে যাচ্ছে পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র? দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত আঞ্চলিক প্রভাব চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দিন দিনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ যেন গরিবের ঘরে এক সুন্দরী বউ। বলা যায়, বাংলাদেশ আজ এই দুই পরাশক্তির টাগ অব ওয়ারের ফলে সবারই ভাবি।

লেখক: সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

দুর্নীতি দমনে নির্মমতাই কি শেষ পথ?

ভারতের ইসরাইল-প্রীতি : সুদূরপ্রসারী প্রভাব

রোহিঙ্গা সংকট : বাস্তবতা ও অগ্রগতির পথ

এবারের নির্বাচনে ভোটারদের ভাবনা

গ্রাম আদালত : ন্যায়বিচারের নতুন যাত্রা

অদূরদর্শী নেতাদের বিজয় : দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা

ইরান ও ইসরাইল কি আবার যুদ্ধে জড়াবে?

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় ঐক্যের পথ

ডায়াবেটিস : শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক দায়ের রোগ

হাসিনার রায়, ইউনূসের চমক