হোম > মতামত

আধুনিক ঢাকার রূপকার জি এ মাদানি

তারিক হাসান

আজকের গুলশান, বনানীর বাসিন্দাদের মধ্যে খুব কম লোকই জানেন এই প্লটগুলোর আদি মালিকের অনেককেই জোর করে প্লটগুলো গছিয়ে দিয়েছিলেন গুলাম আহমেদ মাদানি। প্রাক্তন এই আইসিএস অফিসার ছিলেন ১৯৬০-এর দশকে ডিআইটির (ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট) প্রথম চেয়ারম্যান, যিনি শুধু মাদানি নামেই বহুল পরিচিত। কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে তিনি সদ্য বিবাহিত এক ফরেস্ট অফিসারের বাসায় নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন, ফেরার সময় অফিসারকে ঢাকায় অফিসে দেখা করতে বলেন। সেই অফিসার ঢাকায় দেখা করতে এলে তাকে গুলশানে একটি প্লটের কাগজ ধরিয়ে দেন মাদানি। ভদ্রলোক টাকা নেই বলে কেটে পড়তে চাইলে নাছোড়বান্দা মাদানি বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে টাকা আনতে বলেন, শেষমেশ প্লট গছিয়েই ছাড়েন। জি এ মাদানি সম্পর্কে জানতে তার সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি অনেক দিন ধরে। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে কানাডা বসবাসরত ঢাকার নবাব পরিবারের এক সদস্যের মাধ্যমে মাদানির মেয়ে আয়েশার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আয়েশা ইসলাম তার ভাই হাসান মাদানির নম্বর দেন তাদের বাবার কর্ম সম্পর্কে জানতে।

গুলাম আহমেদ মাদানির জন্ম ১৯১৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের মিরাটের অভিজাত নবাব পরিবারে। দাদার হাতে গড়া বিখ্যাত মুস্তফা প্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেছেন। পড়ালেখা করেছেন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা নবাব মোহাম্মদ ইসমাইল খান ছিলেন আইনজীবী এবং জিন্নাহর সহচর, পরে তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। দাদা নবাব মোহাম্মদ ইশহাক আহমেদ খান ছিলেন মুরাদাবাদের সেশন ও দায়রা আদালতের জজ। তিন ভাইয়ের মধ্যে জি এ মাদানি এবং ইকরাম আহমেদ ছিলেন আইসিএস অফিসার। ইকরাম আহমেদ কুমিল্লার এসডিএম (সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট) ছিলেন। অন্য ভাই ছিলেন সিএসপি অফিসার। মাদানি ১৯৩৭ সালের আইসিএস ব্যাচে যোগ দেন। দশ বছরের অধিক সময় তিনি বেঙ্গল প্রদেশে কাজ করেন। ভারত ভাগের পরপরই তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান চলে যান। বাবা ইসমাইল খান ভারতীয় মুসলমানদের অধিকার আদায়ের জন্য জন্মভূমি ভারতে রয়ে যান। ১৯৫২ সালে মাদানি ঢাকায় আসেন বিভাগীয় কমিশনার হয়ে।

মাদানিকে আজও মানুষ স্মরণ করে আধুনিক ঢাকার রূপকার হিসেবে। গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকার পরিকল্পিত নগরায়ণের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন তার হাত দিয়েই হয়েছে ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে। নগর-উন্নয়নের ধারণা কোথায় পেয়েছিলেন জানতে চাইলে জি এ মাদানির ছেলে ৭৭ বছর বয়সি হাসান মাদানি বলেন, তার বাবাকে ভারত ভাগের পরপরই পাকিস্তান সরকার নগর-উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণে পাঠায়। বায়তুল মোকাররম মসজিদের বাস্তবায়ন পরিকল্পনায়ও ছিলেন মাদানি, যদিও তিনি ভিন্ন একটি স্থানে কাবা শরিফের আদলে মসজিদটি করতে চেয়েছিলেন। মাদানির ঢাকায় কর্মকাল প্রথম দফায় শেষ হয় ১৯৬১ সালের শেষের দিকে, তিনি পেশোয়ারের কমিশনার হিসেবে যোগ দিতে পাকিস্তান ফিরে যান। পেশোয়ারে দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় তিনি ঐতিহাসিক খায়বার পাসের কাছে বাব-ই-খাইবার নামে একটি মধ্যযুগীয় ধাঁচের প্রবেশদ্বার স্থাপন করেন। পাকিস্তানে পিইসিএইচএসের (পাকিস্তান এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি) সম্প্রসারণে মাদানি ব্যাপক অবদান রাখেন। ওই এলাকায় তার জনপ্রিয়তা থাকায় অবসরের পর ১৯৭১ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তিনি পিইসিএইচএস এলাকা থেকে সদস্য নির্বাচিত হন।

পুরান ঢাকার বাইরে গিয়ে ঢাকার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা পাস হয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়। মাদানি তখন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার। যেহেতু ডিআইটি তখনো স্থাপিত হয়নি ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারই ছিলেন শহরের উন্নয়ন পরিকল্পনার কান্ডারি। তার সুপারিশেই গুলশান, বনানী, বারিধারা, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকার আবাসনের এই মহাপরিকল্পনা তৎকালীন যুক্তফ্রন্টের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খায়রাত হোসেন অনুমোদন করে দেন। ১৯৫৮ সালে ডিআইটি স্থাপিত হলে জি এ মাদানিকে পাকিস্তান সরকার প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি দিনরাত নিরলস তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করতে থাকেন। স্কুল ছুটির পর নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ছুটে চলতেন গুলশান-বনানীর উন্নয়নকাজ তদারকি করতে। অফিসে কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা কোনো উঠতি ব্যবসায়ী দেখা করতে এলেই তিনি প্লট বিক্রির চেষ্টা করতেন। সে সময় গুলশান তেমনটা আকর্ষণীয় ছিল না ধানমন্ডির তুলনায়, কারণ গুলশান ছিল গ্রামের মতো। অন্যদিকে ধানমন্ডিতে ছিল মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের বসতি। মাদানির প্রথম দফায় ঢাকায় কর্মকাল শেষ হয় ১৯৬১ সালের শেষের দিকে। ১৯৬৪ সালে আবার ঢাকায় ডিআইটির চেয়ারম্যান হিসেবে ফেরত আসেন। এ সময়ই তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন তার কল্পনার গুলশান-বনানীকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে। ঢাকায় মাদানির দ্বিতীয় দফায় কর্মকাল খুব একটা সুখকর ছিল না। ষাটের দশকে ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছিল। হাসান মাদানি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা আগের মানুষের সমস্যা ও অসন্তোষের গভীরে যেতেন না, ফলে মাদানির মতো সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা খুব বেকায়দায় ছিলেন। যেমন : ১৯৬৯-এর দিকে এক ভয়াবহ সাইক্লোনে পূর্ব পাকিস্তান লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সামরিক শাসক আইয়ুব খান চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ দেন। মাদানি বোঝাতে ব্যর্থ হন কেন চব্বিশ ঘণ্টায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা সচল করা অসম্ভব। দুজনের মধ্যে ব্যাপক বাগ্‌বিতণ্ডা হয়, একপর্যায়ে মাদানি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। তিনি ১৯৭০ সালে করাচি যান চাকরির বাকি আনুষ্ঠানিকতা সেরে আসার জন্য, যাওয়ার আগে গুলশানের বাসাটি ব্রিটিশ হাইকমিশনের কাছে ভাড়া দিয়ে যান। মাদানির মেয়ে আয়েশা বলেন, তার বাবার পরিকল্পনা ছিল ঢাকায় থিতু হবেন, যেহেতু এই শহর তার ভীষণ প্রিয় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় ফেরার আগেই পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় তারা আর ফেরত আসতে পারেননি। মাদানি পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার বেদনা সইতে পারেননি। দেশ স্বাধীনের খবর শুনে হার্ট অ্যাটাক করেন। অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হয়েছিলেন, অতঃপর ১৯৭৯ সালে তিনি করাচিতে মৃত্যুবরণ করেন।

জি এ মাদানির ছেলেমেয়েরা ঢাকার হলিক্রস স্কুল, নটর ডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে। বিশেষত, মরিয়ম মাদানি বিএতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। মাদানির দুই ছেলে এবং তিন মেয়ের মধ্যে হোসেন মাদানি কানাডায় এবং মরিয়ম মুনিফ মাদানি আমেরিকায় বসবাস করেন। বাকি ছেলেমেয়েরা করাচির পিইসিএইচএস এলাকায় বাস করেন। মাদানির স্ত্রী সালমা ফিরোজা বানু ২০২১ সালে মারা যান করাচিতে, ভদ্রমহিলা দিল্লির গুরগাঁওয়ের অভিজাত লোহারু পরিবারের মেয়ে। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের ঢাকা কেমন ছিল জানতে চাইলে হাসান মাদানি বলেন, ঢাকা ছিল সবুজ প্রাণবন্ত এক শহর। পাড়া-মহল্লায় ফুটবল-ক্রিকেট খেলা হতো নিয়মিত। শবেবরাত, শবেকদর ও অন্যান্য ধর্মীয় দিবসে প্রতিবেশীদের মধ্যে খাবার আদান-প্রদানের ঐতিহ্য ছিল। প্রচুর ইউরোপিয়ান মানুষের বাস ছিল তখন ঢাকায়। তারা মিন্টো রোডে থাকতেন, মাঝেমধ্যে বাবার সহকর্মীদের বাসায় বেড়াতে যেতেন। বাবা খুব সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। ছেলেমেয়েদের বিলাসী জীবনযাপনের সুযোগ দিতেন না। মাদানি ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে পছন্দ করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাদানির পরিবার অর্থকষ্টে পড়ে যান, তারা ভেবেছিলেন গুলশানের বাসা থেকে ভাড়া পাবেন কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তারা বাড়িটি আর ফেরত পাননি। মাদানির ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশের খবর রাখেন নিয়মিত, খবর রাখেন এদেশের রাজনীতির। তার বাবা চাইলেই অনেকগুলো প্লট বিভিন্ন নামে নিতে পারতেন কিন্তু মিরাটের নবাবের সন্তানের সে রুচি হয়নি। মাদানি পরিবার বাংলাদেশের মঙ্গল চায়, পাকিস্তানের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের অকৃত্রিম সম্পর্ক চায়। বাংলাদেশ তথা ঢাকার সঙ্গে মিশে আছে তাদের শৈশব ও কৈশোরের অনেক স্মৃতি। গুলশান থেকে জলসিঁড়ি অভিমুখী রাস্তাটির নাম ‘মাদানি অ্যাভিনিউ’ রাখা হয়েছে জেনে তারা ভীষণ খুশি।

লেখক: সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা

ইহুদিবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মামদানির লড়াই

আমাদের রাজনীতির মুকুটহীন সম্রাট ভাসানী

হাসিনার সব অপরাধেরই বিচার হওয়া উচিত

বাংলাদেশ ঘিরে দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্ব

দুর্নীতি দমনে নির্মমতাই কি শেষ পথ?

ভারতের ইসরাইল-প্রীতি : সুদূরপ্রসারী প্রভাব

রোহিঙ্গা সংকট : বাস্তবতা ও অগ্রগতির পথ

এবারের নির্বাচনে ভোটারদের ভাবনা

গ্রাম আদালত : ন্যায়বিচারের নতুন যাত্রা

অদূরদর্শী নেতাদের বিজয় : দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতা