আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ, তৎকালীন পাকিস্তান কিংবা এই উপমহাদেশের সামগ্রিক রাজনীতি ও আন্দোলন-সংগ্রামের এক অবিসংবাদিত অগ্নিপুরুষ ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তার জীবনটাই ছিল একটা সামগ্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। কখনো তার জীবনসংগ্রাম, কখনো সর্বাত্মক গণআন্দোলন, আবার কখনো জেল-জুলুম ও খেটে খাওয়া মানুষের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। মওলানা ভাসানীর দীর্ঘ ছিয়ানব্বই বছরের জীবনে সেই আন্দোলন-সংগ্রামের কোনো যতি-বিরতি ছিল না। কখনো প্রতিবাদী কৃষক সমাবেশ, কখনো শ্রমিক বিক্ষোভ, আবার কখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গণআন্দোলন বা অভ্যুত্থানের উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি করাই ছিল তার প্রাত্যহিক জীবনের রোজনামচা। সেটাই ছিল তার সংগ্রামী জীবনের অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক দর্শন।
অন্যায়, অবিচার, লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও বৈষম্য_সবকিছু উৎখাত করে মানুষের জন্য তার ন্যায়সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তার কোনো ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ ছিল না, ছিল না বিশেষ কোনো চাহিদা। দু-চারটি পরিধেয় বস্ত্র কিংবা প্রয়োজনীয় সামান্য কিছু ব্যবহারিক সামগ্রী ছাড়া না ছিল কোনো জমি কিংবা ভূসম্পত্তি, না কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা বৈষয়িক লেনদেন। সে জীবন ছিল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত।
নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী, আবদুল হামিদ খানের জন্ম হয়েছিল ১৮৮০ সালে তৎকালীন পাবনার সিরাজগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বাবা হাজি শরাফত আলী খান ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। ভাসানী পশ্চিমা প্রথাগত শিক্ষায় নয়, উচ্চতর ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তৎকালীন উত্তর ভারতের ইসলামি শিক্ষার কেন্দ্র দেওবন্দ মাদরাসার ছাত্র হলেও তিনি ক্রমেই ঝুঁকে পড়েছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী প্রগতিশীল ধারার রাজনীতির দিকে। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ভাসানী সর্বভারতীয় রাজনীতি, জাতীয় কংগ্রেস দল, খিলাফত আন্দোলন এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
তার জীবদ্দশায়, বিশেষ করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদের কথাই বেশি বলেছেন। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য ও লড়াই ছিল আপসহীন। আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার কোটি কোটি মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। সে কারণে গণমাধ্যম তাকে অনেক সময় আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার শোষিত, নির্যাতিত এবং বঞ্চিত মানুষের একজন দরদি নেতা ও নির্ভরশীল বন্ধু বলে আখ্যায়িত করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কারো কারো মতে, ভাসানীর রাজনীতি ছিল তার সমকালীন যুগের তুলনায় অনেক অগ্রসর। উপমহাদেশ, বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে, নিয়মতান্ত্রিক কিংবা সংসদীয় পদ্ধতিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসবে বলে ভাসানী বিশ্বাস করতেন না। সে কারণে তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাজপথে গণঅসন্তোষ প্রকাশ এবং সর্বোপরি গণআন্দোলন ও অভ্যুত্থানের পথ। আসামে ‘বাঙাল খেদা’ রাজনীতির বিরুদ্ধে তার নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে ওঠা এবং ভূমিহীন বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৪৭-পরবর্তী স্বাধীন-পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বায়ান্নর মাতৃভাষা আন্দোলন থেকে চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কিংবা তৎকালীন সময়ে বাঙালির তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ এবং পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ভাসানীর অগ্নিগর্ভ আন্দোলনের স্বরূপ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে।
ইতিমধ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মওলানা ভাসানী গঠন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ, যা মুসলিম লীগের তাঁবেদারি রাজনীতির জন্য এক মহাবিপর্যয় ডেকে এনেছিল। সে কারণে ঊনসত্তরের পূর্বাপর দুই দশকের অগ্নিঝরা গণআন্দোলনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে ভাসানীকে তুলে ধরেছিল ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ (প্রচণ্ড বিক্ষোভ বা সহিংসতার নবী) হিসেবে। অন্যদিকে ২০০৪ সালে অর্থাৎ তার মৃত্যুর বহু পরে বিবিসি লন্ডন থেকে তাকে সর্বকালের অষ্টম শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।
কৈশোর থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত তার ৯৬ বছরের জীবনটি ছিল সংগ্রামের একটি পরিপূর্ণ ইতিহাস। ভাসানী যেমন দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের হয়ে জমিদার, মহাজন, শিল্পপতিদের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তেমনি পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সার্বিক সংগ্রামে ছিলেন আপসহীন। তার দীর্ঘ জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকদের কারাগারে।
সাতচল্লিশে স্বাধীনতা লাভের দুবছর পর পাকিস্তান মুসলিম লীগ নামক অভিজাত কিংবা বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক সংগঠনের বিপক্ষে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে জনগণের অধিকার আদায়ের নেতৃত্বেই চুয়ান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে ভরাডুবি হয়েছিল মুসলিম লীগের।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও চুয়ান্নর প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজয়ের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহলের অনেকে বিশ্বাস করেন। ১৯৫২ সালের শুরুতে ভাসানী রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে মাঠে নামেন। তিনি সে সময় পুরান ঢাকার বার লাইব্রেরিতে একটি সর্বদলীয় ভাষা-সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন, যার সভাপতি ছিলেন তিনি স্বয়ং। আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তখন কারান্তরালে। তারপর সে বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ভাসানীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছিল। জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। তাতে কৃষক-শ্রমিক প্রজা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান ও হাজী মোহাম্মদ দানেশসহ অনেকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামেন। সে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ছিল বাঙালির জাতীয় জীবনের এক অসামান্য রাজনৈতিক মাইলফলক।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসকরা পূর্ববাংলার মানুষের সে বিজয়কে ফলপ্রসূ হতে দেয়নি। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারা পুরোনো ৯২-ক ধারা জারি করে পূর্ব পাকিস্তানের নবগঠিত সে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ভেঙে দেয়। এক নতুন প্রেক্ষাপটে শুরু হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বার্থ ও অধিকার আদায়ের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের অভাবে পাকিস্তান, বিশেষ করে তার পূর্বাঞ্চলে দেখা দেয় এক রাজনৈতিক শূন্যতা ও জাতিগতভাবে এক চরম হতাশা।
সে সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয় দফা কর্মসূচি সাধারণ মানুষের কাছে মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছিল। রাষ্ট্র ক্ষমতায় শেখ মুজিবকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে জেনারেল আইয়ুব যে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেননি, তা নয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ সালের এপ্রিল এবং পরে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। আইয়ুব খান তখন ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন কর্মসূচি সন্দেহে শেখ মুজিবকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীর অভিযোগ আনেন।
সে সময় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী প্রতিবাদের একমাত্র বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে এগিয়ে এসেছিলেন। ভাসানী পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের আনা সে অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক বলে উল্লেখ করে অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন। তাছাড়া আগরতলা মামলার শুনানির সময় পূর্ববাংলার মানুষ ভাসানীর দিকে তাকিয়ে দিকনির্দেশনার অপেক্ষা করছিল।
মওলানা ভাসানী তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি দিয়ে তখন বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে পাকিস্তানে একটি বিশাল রাজনৈতিক পরিবর্তন আসন্ন হয়ে উঠেছে। ভাসানী তখন উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিয়েছিলেন সামরিক স্বৈরশাসনের উৎখাত ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্যে। তার কাছে শেখ মুজিবের ছয় দফা কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। কারণ তার মূল লক্ষ্য ছিল আরো সুদূরপ্রসারী। তার মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা। তখন থেকে ভাসানী আহূত জনসভা এবং ঘেরাও আন্দোলনের কর্মসূচি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে অবস্থায় অর্থাৎ ঊনসত্তরের জানুয়ারির সূচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা মিলিত হয়ে ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে এবং আন্দোলনে যোগ দেন। তাতে ভাসানীর গণআন্দোলন আরো বেগবান হয়ে ওঠে।
মওলানা ভাসানী পরিকল্পিত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভাসানী ছাত্রদের ১১ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। সে অবস্থায় মওলানা ভাসানী আসাদ স্মরণে এক বিরাট গায়েবানা জানাজায় নেতৃত্ব দেন। জানাজা শেষে ১৪৪ ধারা ভেঙে ঢাকায় বিশাল মিছিল বের করা হয়েছিল এবং সে সময় দেশব্যাপী ‘ঘেরাও’র সঙ্গে ‘জ্বালাও-পোড়াও’য়ের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের গণবিক্ষোভের প্রতি সমর্থন জানায় পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, লাহোর, পেশোয়ার ও অন্যান্য স্থানের বিক্ষুব্ধ জনতা। তখন কাঁপন ধরে আইয়ুব শাহির গদিতে। গণআন্দোলনের তীব্রতায় ফলপ্রসূ হয়নি স্বৈরশাসক আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠক।
২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান নিজে আত্মরক্ষার স্বার্থে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিন ঊনসত্তরের ঘটনাবহুল গণঅভ্যুত্থানের বিশদ বিবরণসহ একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যাতে তারা সে অভ্যুত্থানের নায়ক হিসেবে সব কৃতিত্ব দিয়েছে মওলানা ভাসানীকে। তারা বলেছে, মওলানা ভাসানীর সুযোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া ছাত্র-জনতার সেই মহান অভ্যুত্থান সাফল্যমণ্ডিত হতো না।
মওলানা ভাসানীর ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সফল দিক হচ্ছে তার ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ। ভারত সবকিছু জেনেশুনেই তার পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তের প্রায় ২০ কিলোমিটার উজানে অর্থাৎ রাজশাহীর সন্নিকটে গঙ্গা নদীর ওপর একটি বিশাল বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফারাক্কা পয়েন্টে ষাটের দশকে এই বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত ছিল গঙ্গা নদী থেকে পানি সরিয়ে ভাগীরথী দিয়ে কলকাতার হুগলি বন্দরের নাব্য বাড়ানো। গঙ্গা থেকে পানি প্রত্যাহারের ফলে প্রতিবেশী রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল কিংবা পদ্মার অববাহিকায় অবস্থিত পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং ঢাকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকায় কী সর্বনাশা প্রভাব পড়তে পারে, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি ভারত। তারা ভালো করেই জানত যে বাংলাদেশের রাজশাহীসংলগ্ন গঙ্গায় বাঁধ নির্মাণ করা হলে শুষ্ক মৌসুমে পানিপ্রবাহের অভাবে মরূকরণ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
কোনো আলাপ-আলোচনা কিংবা সভা-সমিতি ছাড়া এ ধরনের বাঁধ নির্মাণ এবং তা চালু করার বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানিয়ে বাধা দেন আপসহীন নেতা মওলানা ভাসানী। সে বিষয়টি শেখ মুজিব থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত জিয়া সরকারের নজরেও আনেন বর্ষীয়ান এই নেতা এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭৬ সালের ১৬ ও ১৭ মে দুদিনব্যাপী রাজশাহী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে ভাসানী এক ঐতিহাসিক লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাতে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘ পর্যন্ত গড়ায় এবং বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানির হিস্যা প্রদান নিশ্চিত করতে বাধ্য হয়েছিল ভারত।
বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর এই অবিসংবাদিত নেতা নিজে রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করার জন্য কখনো রাজনীতি করেননি। অন্যদের ক্ষমতায় পাঠিয়ে নিজে থাকতেন ক্ষমতার বাইরে। সারা জীবনে মাত্র দুবার তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। একবার আসামের দক্ষিণ ধুবড়ী এবং পরে টাঙ্গাইলের একটি নির্বাচনি এলাকা থেকে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। অথচ এ উপমহাদেশ এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে মানুষের স্মৃতিপটে ভাস্বর হয়ে আছেন তিনি। ভাসানী আমাদের দেশপ্রেম এবং জাতীয় চেতনার প্রতীক।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ‘রাজনীতির অগ্নিপুরুষ ভাসানী’ গ্রন্থের প্রণেতা
gaziulhkhan@gmail.com