হোম > মতামত

ভারতীয় হেজেমনি ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই

মন্তব্য প্রতিবেদন

মাহমুদুর রহমান

জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব ও জীবন দিয়েছে এ দেশের তরুণ ছাত্র-জনতা, যাদের গড় বয়স তিরিশের নিচে। ১১ বছর ফ্যাসিস্ট সরকার কর্তৃক বন্ধ রাখার পর গত বছর ২২ ডিসেম্বর আমার দেশ পুনঃপ্রকাশিত হলে বিস্ময়করভাবে প্রধানত সেই বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মই পত্রিকাটিকে আপন করে নিয়েছে।

মিডিয়ায় আমার লেখালিখি শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে এক-এগারোর সরকারের সময়। তারপর আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্ব নিয়েছিলাম ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে। তখন থেকে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল আমার দ্বিতীয় দফার গ্রেপ্তার এবং আওয়ামী পুলিশের পত্রিকার ছাপাখানার দখল নেওয়ার মধ্যবর্তী প্রায় পাঁচ বছরের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অবিরত ও প্রায় নিঃসঙ্গ লড়াইকালে জুলাইয়ে নেতৃত্বদানকারী প্রজন্মের পুরোটাই বালক কিংবা কিশোর ছিল।

তাদের মানসপটে সম্ভবত আমার দেশ-এর সেই অসম ও দুঃসাহসিক (কেউবা বলেন হঠকারী) লড়াইয়ের স্মৃতি হয় একেবারেই নেই, অথবা ফিকে হয়ে এসেছে। আর মাত্র দুই মাসের মধ্যে আমি ‘বাহাত্তুরে বুড়োতে’ পদার্পণ করব। তাই ভাবলাম, জীবনের শেষ ইনিংস শেষে অবসরে যাওয়ার আগে আমার সহকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ লড়াইগুলোর অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের অভিজ্ঞতা ও প্রেরণার জন্য জানিয়ে যাওয়া আবশ্যক।

সাহসী সাংবাদিকতা যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, নিঃসঙ্গ ও প্রশংসাহীন কাজ, সেটা আমাদের পত্রিকার প্রায় দুই দশকের গল্প থেকেই আপনারা বুঝতে পারবেন। আজকের লেখাটি খানিকটা দীর্ঘ হবে, তাই পাঠকের বিরক্তি উৎপাদনের জন্য আগাম দুঃখ প্রকাশ করে রাখছি। আশা করি বুঝবেন, ২০ বছরের কাহিনি একটিমাত্র লেখায় বর্ণনা করা কতটা কঠিন কাজ। আমাদের লড়াই জেনারেল মইন-মাসুদের জামানা থেকেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল।

২০০৮ সালে মইন-ফখরুদ্দীনের শাসনের ওই সময়টায় ‘দুদক’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই তাবৎ রাজনীতিবিদদের ভয়ে ঘুম হারাম হয়ে যেত। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তখন মূলত চার ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ কারাগারে, দ্বিতীয় ভাগ মান্নান ভূঁইয়ার পাল্লায় পড়ে ভয়ে অথবা লোভে জেনারেল মইনের নির্দেশে দল ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তৃতীয় ভাগ বেগম জিয়া নিযুক্ত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ারের সঙ্গে থেকে শহীদ জিয়ার বিএনপির পতাকা ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন এবং একটি ক্ষুদ্র চতুর্থ ভাগ বিদেশে পালিয়ে আছেন।

এমন সময় দুদক বেগম খালেদা জিয়াকে জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট-সম্পর্কিত দুটি ভুয়া মামলায় অভিযুক্ত করল। এখানে উল্লেখ্য, সেই দুটি বানোয়াট মামলাকে অস্ত্র বানিয়েই পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার বশংবদ আদালত অসুস্থ খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে সাজা দিয়ে বছরের পর বছর জেলে বন্দি করে রেখেছিল। দুদকের সেই অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ আমার দেশ-এর সাংবাদিকরা সংস্থাটির তৎকালীন চেয়ারম্যান জেনারেল হাসান মাশহুদ চৌধুরীর কর্মজীবন অনুসন্ধান করে তার একাধিক ত্রুটির তথ্য বের করতে সক্ষম হন। তিনি সাধারণভাবে একজন সৎ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

সেই কারণে তার সম্পর্কে সব নথিপত্র আমাকে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হয়েছিল। প্রাপ্ত সব তথ্যপ্রমাণে জেনারেল মাশহুদের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে ২০০৮ সালের ২৫ অক্টোবর ‘দুদক চেয়ারম্যান অবৈধ স্থাপনা বৈধ করে দিয়ে এসেছেন’ শিরোনামে একটি সংবাদ আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

প্রায় একই সময় জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীর সেনাপ্রধান হিসেবে ট্রাস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে ব্যাংকটিতে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে ২৩ কোটি টাকার রহস্যময় লোকসান-সংক্রান্ত নথিপত্র আমার দেশ-এর কাছে এসে পৌঁছালে আমি নিজে বাদি হয়ে দুদক আইন ও পেনাল কোডের প্রাসঙ্গিক তিনটি ধারায় দুদকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের করি। আমি দুদক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করতে থানায় গেলে পুলিশ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারা আমাকে উল্টো গ্রেপ্তার যে করেনি, সেটাই বিস্ময়কর।

এসব প্রসঙ্গ নিয়েই ২০০৮ সালের ৭ নভেম্বর ‘চেয়ারম্যানের দায় নেই—সকল দায় প্রধানমন্ত্রীর’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম। আমার যুক্তি ছিল, দুদক চেয়ারম্যান যদি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট-সংক্রান্ত সম্পূর্ণ ভুয়া মামলা দায়ের করতে পারেন, তা হলে একই যুক্তিতে তারই অধীনে ট্রাস্ট ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে ফটকা ব্যবসায় লোকসানের জন্য তার নামেও মামলা হওয়া উচিত।

আমার সেদিনের অবিশ্বাস্য হঠকারিতায় স্তম্ভিত হয়ে ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেছিলেন, ‘মাহমুদ, আপনি এই সেনাশাসনের মধ্যে কি শখ করে জেলে যেতে চাচ্ছেন?’ রফিক ভাই আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। মহান আল্লাহ তায়ালা তার বেহেশত নসিব করুন। বিএনপির কোনো নেতার যখন বেগম খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে কথা বলার সাহস ছিল না, সেই সময় আমার অতি উৎসাহে রফিক ভাই খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। জেলে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আমি দুদক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একাকী দাঁড়ালেও ওই আমলে আমাকে অবশ্য জেলে যেতে হয়নি।

এবার হাসিনার আমলের গল্প। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। অন্য একটি জাতীয় পত্রিকায় কর্মরত আমার এক সাংবাদিক ছোটভাই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের কিছু অতি গোপনীয় নথিপত্র নিয়ে এসে আমাকে জানালেন, সংবাদটি বিপজ্জনকভাবে সংবেদনশীল এবং অতি ক্ষমতাশালী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার কারণে তার সম্পাদক ছাপানোর সাহস পাচ্ছেন না। আমি ছাপানোর সাহস করলে তিনি সব কাগজপত্র আমাকে দেওয়ার প্রস্তাব করলেন। আমি নথিপত্রগুলোয় খানিকটা চোখ বুলিয়ে বেশ চমকে উঠে তাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানালাম। আমার সিনিয়র সহকর্মী এম আবদুল্লাহকে তখনই ডেকে কাগজপত্র দিলাম এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মন্তব্য নিয়ে লিড স্টোরি করতে বললাম। দিন চারেকের মধ্যেই লিড স্টোরি প্রস্তুত হয়ে গেল।

১৭ ডিসেম্বর ‘তৌফিক ইলাহী ও জয়ের বিরুদ্ধে ৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ’ শিরোনামে সাত কলামব্যাপী চাঞ্চল্যকর সংবাদ আমার দেশ-এ প্রকাশিত হলে চারদিকে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। রাজপুত্রের নামে এমন সংবাদে আওয়ামী লীগ ভয়ংকর ক্রোধে ফেটে পড়ল। প্রতিবেদক এম আবদুল্লাহ তার টঙ্গীর বাসা থেকে কারওয়ান বাজারে পত্রিকা অফিসে আসার পথে কাকলীর কাছে আক্রান্ত হলেন। তিনি কোনোরকমে দৌড়ে চলন্ত বাসে উঠে প্রাণ বাঁচাতে পারলেও তার গাড়ি ভাঙচুর করা হলো।

গাড়ির চালককে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা বেদম মারধর করে। এনএসআই’র এক বিশেষ গ্রুপ তেজগাঁও সাত রাস্তার মোড়ে রাতে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে আমার গাড়িতে হাতুড়ি দিয়ে আক্রমণ করলে গাড়ির কাচ চূর্ণবিচূর্ণ হলেও আমি নিজে আঘাতপ্রাপ্ত হইনি। সম্ভবত আমাকে ভয় দেখানোই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। শুরু হয়ে গেল আমার মতো সামান্য এক সম্পাদকের সঙ্গে তৎকালীন বাংলাদেশের একচ্ছত্র ক্ষমতাবান শেখ হাসিনার একেবারে পারিবারিক বিরোধ। শেখ হাসিনার ক্রোধের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়ে ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি লিখলাম, ‘সততায় পারবেন না প্রধানমন্ত্রী’। শেখ হাসিনা যত দ্রুত সম্ভব আমাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিলেন।

২০১০ সালের ১ জুন রাতে পত্রিকা অফিস থেকেই আমাকে গ্রেপ্তার করা হলো। রিমান্ডে নিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন সাহসে আমি প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের বিরুদ্ধে খবর ছাপিয়েছি? আওয়ামী লীগের তরফ থেকে অভিযোগ ছিল, আমি নাকি তারেক রহমানের ইমেজ পুনরুদ্ধারের জন্যই শেখ হাসিনার ছেলের নামে এসব কলঙ্ক আরোপ করেছি। উল্লেখ করা যেতে পারে, এক-এগারোর সরকারের দুই বছর ধরে দেশের দুই প্রভাবশালী সুশীল মিডিয়ায় তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ক্রমাগত অসত্য ও অর্ধসত্য প্রচারণা চালানো হয়েছিল। শেখ হাসিনার পুলিশ আমাকে বলতে চাইল, সেই ক্রমাগত একতরফা প্রচারে তারেক রহমানের ভাবমূর্তির যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি পুষিয়ে নিতেই আমার পত্রিকা জয় ও তৌফিক ইলাহীর দুর্নীতি নিয়ে খবর ছাপিয়েছে।

আমি জবাবে বলেছিলাম, আমরা সর্বদা ‘নিউজ ভ্যালু’-সম্পন্ন ও বস্তুনিষ্ঠ খবর ছাপানোর চেষ্টা করি। সেই খবর কার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে গেল, সেটা আমাদের বিবেচনায় থাকে না। পুলিশ আমার জবাবে রুষ্ট হলেও তাদের সেই অভিযোগ আমি আমলেও নিইনি, কিংবা তাদের আক্রমণাত্মক ব্যবহারে বিস্মিতও হইনি। বেজায় বিস্মিত হয়েছিলাম বিএনপির কতিপয় নেতার মন্তব্যে। তারা বলতে লাগলেন, আমি নাকি হাসিনা সরকারের শুরুতেই তার সঙ্গে লাগতে গিয়ে মহা অন্যায় এবং হঠকারী কাজ করে ফেলেছি।

জেলজীবনে দলটির বিভিন্ন নেতার একই ধরনের মন্তব্য আমার সঙ্গে বিচার বিভাগের লড়াই প্রসঙ্গেও শুনতে হয়েছে। সেই নেতারা দলের বিভিন্ন পর্যায়ে তখন অভিযোগ করছিলেন, আমার সঙ্গে আওয়ামী বিচার বিভাগের লড়াইয়ের কারণে বেগম জিয়াসহ বিএনপির অন্য নেতাদের মামলায় নাকি সমস্যা হতে পারে। বিএনপির নেতাদের এ-জাতীয় আপসকামী মনোভাব রাষ্ট্রপতি জিয়াকে হত্যার পর থেকে বহু সংকটের সময়ই দেখা গেছে।

শেখ হাসিনা ২০১০ সালের প্রথম থেকেই নগ্নভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিচার বিভাগকে ব্যবহার শুরু করেছিলেন। তখনো বিরোধী দল ও ভিন্ন মতের লোকদের খানিকটা ন্যায়বিচার দেওয়ার মতো বিচারকরা হাইকোর্টে অবশিষ্ট ছিলেন। সেই পথ আটকানোর জন্য তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ আপিল বিভাগের চেম্বার জজ মোজাম্মেল হোসেনকে কাজে লাগালেন। সেই সময় কারাগারে বিএনপি আমলের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর বেশ অসুস্থ ছিলেন।

দু-একবার আদালতে তার নাক দিয়ে রক্তপাতের দৃশ্য দেখে আমি তার প্রতি সমবেদনা বোধ করি। তার কয়েকটি মামলায় হাইকোর্ট জামিন দিলে চেম্বার জজ মোজাম্মেল হোসেন সেসব জামিন স্থগিত করে দেন। আপিল বিভাগের চেম্বারে সরকারের পক্ষে এ ধরনের স্থগিত করার ব্যাপার অহরহ ঘটতে থাকলে আমি সিনিয়র সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকে বিষয়টি নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে বলি। ১০ মার্চ ‘চেম্বার মানেই সরকার পক্ষের স্টে’ শিরোনামে অলিউল্লাহ নোমানের তৈরি করা আলোচিত সংবাদ এবং ২০১০ সালের ১০ মে ‘স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা’ শিরোনামে আমার লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আদালত পাড়ায় রীতিমতো ভূমিকম্প ঘটে যায়।

আওয়ামী বিচার বিভাগের স্বরূপ জনসমক্ষে উদোম করে দেওয়ার অপরাধে আমাকে ও অলিউল্লাহ নোমানকে জেলে যেতে হয়। আমি রোজার মাসে নিজে আমার সেই আদালত অবমাননা মামলার শুনানি করি এবং আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে বলি, ‘আমরা যা ছাপিয়েছি এবং লিখেছি সেটা সর্বাংশে সত্য, অতএব সত্য প্রকাশের জন্য আমি কোনো অবস্থাতেই ক্ষমা চাইব না।’ বিচার বিভাগের পচন সম্পর্কে আমার অভিমত যে সঠিক ছিল, সেটা ফ্যাসিবাদের ১৫ বছরে বারবার প্রমাণিত হয়েছে।

প্রথম দফার জেলজীবন শেষ করে আমি ২০১১ সালের ১৭ মার্চ জামিনে মুক্তিলাভ করি। স্মরণে আছে, গাজীপুর জেলগেট থেকে মুক্তি পেয়ে কারওয়ান বাজার অফিসে আসার পথে গাড়িতেই বিবিসির কাছে মন্তব্য করেছিলাম, ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই অসমাপ্ত রেখে জেলে গিয়েছিলাম, আজ থেকেই সেই লড়াই পুনরায় আরম্ভ হলো।’ আমি কথা রেখেছিলাম। ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল সরকার পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমার দেশ পরিবারের সংগ্রাম বিরামহীনভাবে চলেছে।

২০১২ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে আমার দেশ অফিসে একজন অপরিচিত ব্যক্তি এসে জানালেন, তথাকথিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে যে অবিচার বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম করছেন, তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তার কাছে রয়েছে, যা তিনি আমার কাছে দিতে চান। তিনি এটাও বললেন, তার বিশ্বাস একমাত্র আমার দেশ পত্রিকাই বিচার বিভাগের এই চরম অবক্ষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশের হিম্মত রাখে।

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজামুল হক নাসিম সরকারের নির্দেশ মোতাবেক কীভাবে বেলজিয়ামে অবস্থানরত জিয়াউদ্দিন আহমেদ নামে জনৈক প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে মিলেমিশে ফরমায়েশি রায় লিখছেন, তার সব তথ্যপ্রমাণ দু-চার দিনের মধ্যে আমার দেশ-এর ই-মেইলে এসে গেল। আমরা তখনো জানতাম না, একই তথ্য লন্ডনের বিখ্যাত সাময়িকী ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর হাতেও পৌঁছে গেছে। ৯ ডিসেম্বর আট কলাম ব্যানার হেডলাইন করলাম, ‘গভর্নমেন্ট গ্যাছে পাগল হইয়া, তারা একটা রায় চায়’। পরবর্তী চার দিন আমরা একই রকম ব্যানার হেডলাইনের খবর প্রকাশ করে ক্যাঙ্গারু কোর্টের যাবতীয় অপকর্ম ফাঁস করলাম। সারা দেশে ‘আমার দেশ’-এর চাহিদা তুঙ্গে উঠে গেল।

আমরা একাধিক শিফটে তিন লাখ কপি ছাপিয়েও পাঠকের চাহিদা মেটাতে পারছিলাম না। খবর পাচ্ছিলাম, আমার দেশ নাকি ফটোকপি করে বিক্রি হচ্ছে। সেটাও পাঠক লাইন দিয়ে ৫০ টাকা করে কিনছেন। জনমতের চাপে নিজামুল হক নাসিম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। অবাক হয়ে দেখলাম, এত বড় অবিচারের প্রমাণ প্রকাশ হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনাল বয়কটের পরিবর্তে এক দিনের মধ্যেই সেই ক্যাঙ্গারু কোর্টেই ফিরে গেলেন।

আমি আজও মনে করি, জামায়াতে ইসলামীর অনেক রাজনৈতিক ভুলের মধ্যে ক্যাঙ্গারু কোর্টকে বৈধতা দেওয়া একটি অন্যতম ভুল ছিল। ১২ ডিসেম্বর সরকার আমার বিরুদ্ধে প্রথম আইসিটি আইনে মামলা দায়ের করলে আমি সহকর্মী অলিউল্লাহ নোমানের নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। সৌভাগ্যক্রমে তার কাছে যুক্তরাজ্যের ভিসা থাকায় ছয় ঘণ্টার নোটিসে তাকে নিরাপদে লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়ে আমি নিজে গুম এড়াতে পত্রিকা অফিসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাইরে রাতদিন শত শত পুলিশের শ্যেনচক্ষু পাহারা আর ভেতরে আমি পত্রিকা সম্পাদনা আর লেখালেখি করে দিন পার করেছি। এভাবেই ১১ এপ্রিল গ্রেপ্তারের সকাল পর্যন্ত চার মাস কেটে গেছে। এরই মধ্যে আর একটি বিপ্লব ঘটে গেল।

২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী মামলার প্রথম রায় জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছিল। আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলে সেই রায়ের বিরুদ্ধে শাহবাগে এক ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার গ্রুপ আন্দোলন শুরু করে। তাদের দাবি, কাদের মোল্লাকে অবশ্যই ফাঁসি দিতে হবে। সরকার, সুশীল সমাজ ও মিডিয়া মিলে সেই আন্দোলনকে দিনরাত প্রচারের মাধ্যমে জাতীয় আন্দোলনে রূপ দিয়ে ফেলল। শহুরে মধ্যবিত্ত অনেকটা পিকনিকের মতো করে ‘ফাঁসি চাই’ স্লোগান দিয়ে প্রতিদিন শাহবাগে হাজির হতে লাগল। সেইসঙ্গে সব আওয়ামী টেলিভিশনে ২৪ ঘণ্টা লাইভ প্রচার।

পত্রিকার প্রথম পাতায় দিনের পর দিন কেবল শাহবাগের গল্প। শাহবাগ নিয়ে পত্রিকার জ্যাকেট তৈরি হতে লাগল। শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা এই আন্দোলনকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে ঘোষণা দিলেন। বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশকে চিরকালের মতো ভারতের অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করার অশুভ উদ্দেশ্য নিয়েই পুরো নাটকটি মঞ্চায়ন করা হচ্ছে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হলো। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় এসে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের কোনো পরোয়া না করে সদম্ভে বললেন, প্রটোকলে না আটকালে তিনি নিজেই শাহবাগে হাজির হতেন।

শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, তিনি যেখানেই থাকেন না কেন, তার মন সারাক্ষণ শাহবাগেই পড়ে থাকে। বিএনপির অবস্থাও বেশ দোদুল্যমান পরিলক্ষিত হলো। নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় অফিস থেকে শাহবাগের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গুলশান অফিস থেকে দলটির স্ট্যান্ডিং কমিটি শাহবাগকে স্বাগত জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি প্রকাশ করে। সেই সময় বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থান করায় দলের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা প্রকট হয়ে পড়ে।

দেশের এই টালমাটাল অবস্থায় আমি সরাসরি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইসলামবিদ্বেষী ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের এজেন্টদের মুখোশ উন্মোচনের উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের সব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে আট কলাম ব্যানার হেডিং দিলাম ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’। এমন ধৃষ্টতার পর আমার দ্বিতীয় দফা জেলযাত্রা এবং পত্রিকা বন্ধ হওয়া অধিকতর নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। হাসিনার নির্দেশে বন্ধ করে দেওয়া আমার দেশ পুনঃপ্রকাশিত হতে এক যুগ অতিক্রান্ত করে একটি মহান বিপ্লবের প্রয়োজন হয়েছে। ২০১৬ সালের নভেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে জেল থেকে মুক্তিলাভের পর দেশে ও নির্বাসনকালে অন্য রকম লড়াইয়ের গল্প বলতে গেলে আজকের লেখা অতিরিক্ত দীর্ঘ হয়ে যাবে। সেই আট বছরের গল্প পরবর্তী কোনো লেখার জন্য আজ রেখে দিলাম।

আমার দেশ যে আজ বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণের প্রধান মুখপত্রে পরিণত হয়েছে, তার পেছনে দীর্ঘ আপসহীন সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা আজকের অবস্থানে পৌঁছাইনি; বরং শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের অব্যাহত সংগ্রামে রাজনৈতিকভাবে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী লাভবান হয়েছে। মিডিয়ায় সফলতা কিংবা ব্যর্থতা সবটাই একান্তভাবে আমাদেরই অর্জন। মহান আল্লাহ তায়ালা, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও দেশের জনগণ ব্যতীত কারো কাছে আমার দেশ পরিবারের কোনো ঋণ অথবা দায়বদ্ধতা নেই। কর্মজীবনে আমি তিনটি অধ্যায় পার করেছি।

বেসরকারি খাতে ২৪ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন প্রধান নির্বাহীকে টেকনোক্রেট হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য সরকারে এনেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। একটি রাজনৈতিক সরকারে যোগ দিলেও নিজে কখনো রাজনীতিবিদ হতে চাইনি। এক-এগারো না হলে আমার মিডিয়াতে আগমন ঘটত না। সেই সময়কার সরকার যে প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করছিল, সেটি বিভ্রান্ত জনগণকে জানাতেই ২০০৭ সালে হঠাৎ করে একদিন পত্রিকার কলামিস্ট হয়েছিলাম।

বিএনপির বিরুদ্ধে একতরফা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার জবাব দেওয়ার জন্য সেই সময় লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপর ২০০৮ সালে আমার দেশকে কেন্দ্র করে মিডিয়ায় প্রবেশ কাকতালীয়ভাবে ঘটেছিল। সেদিন সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছিলাম, ‘পড়ন্ত বেলায় পেশাবদল’। পড়ন্ত বেলার পেশাই যে আমার জীবনে মুখ্য হয়ে উঠবে, সেটা জানা ছিল না। আজ এ দেশের ১৮ কোটি মানুষের কাছে আমার দেশ-এর সম্পাদকের বাইরে আমার অতীতের আর সব পরিচয় হারিয়ে গেছে।

অনেক জুলুম সহ্য করে এবং অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই পরিচয় আমাকে অর্জন করতে হয়েছে। আমার জীবনের এই দীর্ঘ সফর সম্পর্কে যারা অবহিত তারা নিশ্চয়ই বুঝবেন, আমি যত দিন আমার দেশ পত্রিকার দায়িত্বে থাকব, তত দিন ভারতীয় হেজেমনি ও ফ্যাসিবাদের বিষয়ে সম্পাদকীয় নীতির কোনোরকম পরিবর্তন হবে না। আপসহীনভাবে স্বাধীনতার কথা আমরা বলেই যাব। রাজনীতিবিদরা নানা উদ্দেশ্যে দল ও নীতি বদলালেও একজন প্রকৃত সম্পাদকের অবশ্যই নীতিনিষ্ঠ থাকা উচিত।

এমবি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা : বাংলাদেশের নতুন সম্ভাবনা

মনের তালা এবং শরবতের মতো ভালোবাসা

মোদি-নেতানিয়াহুর মুসলিমবিদ্বেষী দোস্তি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি

শান্তির মুখোশে গাজায় টনি ব্লেয়ারের প্রত্যাবর্তন

মেধা পাচার রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিচ্ছে

রোহিঙ্গা ইস্যুতে কে বেশি অসহায়

মুসলিম বিদ্বেষ ও ভারতের বিনোদন সংস্কৃতি

দুর্ঘটনা না নাশকতা

নেতৃত্ব নির্বাচনে সচেতনতার ঘাটতি

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফল কী বার্তা দেয়