সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে মসজিদ নামক প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় মুসলিমদের জন্য সামাজিক ও সম্মিলিত উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ভূমিকা রাখে। এসব দেশে যখন কোনো এলাকায় একজন, দুজন করে মুসলমান পরিবার বসবাস করতে শুরু করে, এক সময় সে এলাকায় তারা একটি মসজিদ বানানোর চেষ্টা করে। পরবর্তীতে সেই মসজিদকে কেন্দ্র করে নিয়মিত ধর্মীয় কার্যক্রম সংঘটনের সুবাদে সে এলাকায় মুসলমান জনসংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। মাল্টি কালচার সংস্কৃতিতে প্রতিটি ধর্মের মানুষদের জন্যই এ ধরনের অধিকার চর্চাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়।
বহুজাতিক সংস্কৃতি এবং অভিবাসীদের দেশ অস্ট্রেলিয়াকে গত সোয়া দুইশ বছর যাবৎ মূলত ইউরোপিয়ান অভিবাসীরাই গড়ে তুলেছে। বর্তমানে এদেশের মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ নেহাত কম নয়।
সর্বশেষ ২০২১ সালের জনশুমারী অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ান জনসংখ্যার ৩.২ শতাংশ নিজেদের পরিচয় হিসেবে ইসলাম ধর্মকে চিহ্নিত করেছে। সংখ্যাটি হলো প্রায় আট লক্ষ তেরো হাজার মানুষ। এই মুসলিম জনসংখ্যার বড় অংশই সাম্প্রতিক অভিবাসী। এদের মাঝে আছে লেবানন, আফগানিস্তান, তুরস্ক, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মিশর সহ নানা দেশ থেকে আসা মানুষ।
২০২১ সালের সেই শুমারি অনুযায়ীই এই জনসংখ্যার মাঝে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা ছিলো প্রায় সাড়ে একান্ন হাজার। বর্তমানে এ দেশের বাংলাদেশি মানুষের সংখ্যা সম্ভবত এক লাখের কাছাকাছি অথবা বেশিই হবে। এদের অর্ধেকেরও বেশি বসবাস করেন নিউ সাউথ ওয়েলস বা এনএসডব্লিউ প্রদেশে, সিডনি যে প্রদেশের রাজধানী শহর।
পুরো অস্ট্রেলিয়াতে, সবগুলো প্রদেশ মিলে সিডনির লাকেম্বা এলাকাকে মনে করা হয় দেশ-বর্ণ-জাতি-ভাষা নির্বিশেষে মুসলিম জনসংখ্যার কেন্দ্রবিন্দু। বর্তমানে সিডনি এবং মেলবোর্নে অনেকগুলো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা গড়ে উঠলেও এক সময় লাকেম্বা ছিলো পুরো দেশে একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। নব্বই এর দশকে একমাত্র লাকেম্বাতে আসলেই মুসলিম সংস্কৃতি এবং জীবনাচরণের প্রকাশ দেখা যেতো।
বর্তমানে অবশ্য পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। সিডনিতে অবার্ন, ওয়াইলি পার্ক, গ্রিন একর, পাঞ্চবোল এবং মেলবোর্নে ডেন্ডিনং, ফকনার, লালর, ক্যাম্পবেল ফিল্ড এসব এলাকায় গেলে বিভিন্ন দেশ এবং জাতির সংস্কৃতির সাথে মুসলিম সংস্কৃতির মিশেল পরিষ্কারভাবে চোখে পড়ে।
মুসলিম জনসংখ্যার ঘনত্ব বর্তমানে সিডনি এবং মেলবোর্নের পাশাপাশি অন্যান্য প্রদেশ এবং এলাকাতে গড়ে উঠলেও সিডনির লাকেম্বা এলাকার ঐতিহ্যবাহী প্রভাব এখনো পুরো দেশে বুঝা যায়। পবিত্র রমজান মাসে পুরো দেশের মাঝে একমাত্র মাসব্যাপী ‘রামাদান ফেস্টিভ্যাল’ এই লাকেম্বা এলাকাতে আয়োজন করা হয়। বর্তমানে লাকেম্বাতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনসংখ্যাও প্রচুর। লাকেম্বার একটি অংশকে সবাই সাধারণত ‘বাংলাদেশি এলাকা’ হিসেবেই গণ্য করে।
প্রাচীন মুসলিম এলাকা হিসেবে লাকেম্বাতে স্বাভাবিকভাবেই বেশ কয়েকটি মুসাল্লা এবং মসজিদ রয়েছে। মুসাল্লা বলা হয় কোনো ভবনের একটি অংশকে যখন নামাজের জন্য বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়। এই এলাকাতে সম্পূর্ণ ভবন বা এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ আছে তিনটি, বেশ বড় পরিসরের মুসাল্লা রয়েছে অন্তত চার থেকে পাঁচটি। তারপরও মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট নয়। প্রতি শুক্রবারেই লাকেম্বার কোনো মসজিদ বা মুসাল্লায় জায়গা পাওয়া বেশ কষ্টকর বিষয়।
এই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি লাকেম্বা এলাকার একদম কেন্দ্রবিন্দুতে এবং লাকেম্বা স্ট্রিটের ওপর একটি পূর্ণ পরিসরের মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা স্থানীয় মুসলিমদের মাঝে বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশীদের জন্য আনন্দের বিষয় হলো এ মসজিদটি নির্মাণের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশি প্রবাসীদেরই একটি সংগঠন, ইসলামিক প্র্যাকটিস অ্যান্ড দাওয়াহ সার্কেল (আইপিডিসি)।
আইপিডিসি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সব কটি প্রদেশে বেশ কয়েকটি মসজিদ, মুসাল্লা এবং মাদ্রাসার মাধ্যমে মুসলিম জনসংখ্যার ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে এর মাঝে লাকেম্বার মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল স্থানে মসজিদ নির্মাণ নিঃসন্দেহে একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প।
লাকেম্বা স্ট্রিটের উপর অবস্থিত প্রায় শতবর্ষ পুরোনো একটি চার্চ ভবন বিক্রির ঘোষণা আসার পরই আইপিডিসি এ প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করে। সেপ্টেম্বর মাসে সংগঠনটি প্রথম একটি ফান্ড রেইজিং ডিনার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মূলত, বাংলাদেশি প্রবাসীদের অনুদানে প্রথম সপ্তাহে প্রায় এক লক্ষ ডলার বা বাংলাদেশি আশি লক্ষ টাকার সমপরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
সম্পূর্ণ প্রজেক্টের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল খরচের তুলনায় এটি বেশ ছোট অঙ্ক হলেও স্বপ্নপূরণের জন্য এটি সবাইকে ন্যূনতম সাহস যোগায়। এ সময় দেখা যায় এদেশে স্থায়ী নাগরিক সহ অনেক অস্থায়ী প্রবাসী এবং এমন কী সাধারণ ছাত্ররাও অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের সামর্থ্যের তুলনায় বিপুল আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে প্রজেক্ট শুরুর কাজে অংশগ্রহণ করে।
প্রজেক্টের সাথে জড়িত একজন জানান, তাঁর পরিচিত একজন ছাত্র যেদিন পাঁচশ ডলার অনুদান দেয়, সেদিন তিনি কিছু বলার মতো বাক্য খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এ দেশে সীমিত সময় কাজ করে একজন ছাত্রের জন্য নিয়মিত জীবনযাত্রা এবং ইনস্টিটিউট বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন যোগাড় করা কতোটা কষ্টের বিষয় তা সবাই জানে।
সত্যিকার অর্থেই ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল’ বাক্যটির মতো করে প্রথম মাসে প্রপার্টিটি কেনার জন্য ঋণ নিতে প্রয়োজনীয় অর্থের কাছাকাছি পরিমাণের জোগান হয়। চার্চ ভবনটি বিক্রির নিলাম অনুষ্ঠিত হয় ২৭ সেপ্টেম্বর। প্রায় দেড় মিলিয়ন বা পনেরো লক্ষ ডলার মূল্যে ছয়শ বিশ স্কয়ার মিটার জায়গাটি ক্রয় করতে সক্ষম হয়েছে আইপিডিসি।
পুরো প্রজেক্ট বাস্তবায়নের অনুমিত খরচ হবে তিন মিলিয়ন বা ত্রিশ লক্ষ ডলারেরও বেশি। উদ্যোক্তাদের পরিকল্পনার মাঝে আছে মসজিদে নিয়মিত নামাজের পাশাপাশি শিশু-কিশোর-তরুণ-বৃদ্ধ এবং নারীদের জন্য সামাজিক কর্মকাণ্ডের স্থান সংকুলান করা। তারা জানান, প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড়-সাপেক্ষে তারা ২০২৬ সালের মাঝে মসজিদটি সবার ব্যবহারে উন্মুক্ত করে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে লাকেম্বার মতো এলাকায়, যেখানে জায়গার মূল্য অন্য অনেক জায়গার তুলনায় অনেক বেশি, সেখানে এমন একটি লোকেশনে অনেক প্রয়োজন থাকার পরও নানা বাস্তবতা বিবেচনায় একটি পূর্ণ পরিসরের মসজিদ প্রতিষ্ঠার চিন্তা কারো ছিলো না। বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয় ও জাতীয় সংগঠনগুলো সাধারণত নতুন এলাকাগুলো মসজিদ বা মুসাল্লা প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করে। যদিও সবাই নানা উপলক্ষ্যে ও প্রয়োজনে নিয়মিতই লাকেম্বা এলাকায় আসে। এমন একটি এলাকায় এ মসজিদটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনন্য এক উদাহরণ তৈরি করেছে।