শুরুতে, আলাপের ব্যাকগ্রাউন্ড হিসাবে তিনটা জিনিস বইলা রাখাটা দরকার—১. কোনো ‘ধারণা’ই অ্যাবসলুট বা শাশ্বত কোনো জিনিস না, সময়ের সাথে সাথে ধারণা তৈরি হয়, বদলায় এবং মারাও যায়। আর সমাজের কনটেক্সট অনুযায়ীও এর মিনিং নানান রকমের হয়। তো, এইটা মাথায় রাখতে পারলে ভালো যে, কোনো স্ট্যাটিক ধারণার কথা আমরা বলতেছি না। যেমন, ‘এলিট’-ধারণাটা একটা সময়ে সম্ভ্রান্ত বা sophisticated জিনিস বুঝাইত, কিন্তু এখন অই পজিটিভ মিনিংটা নাই পুরাপুরি, অনেক বেশি নাক-উঁচা, snobby লোকজনরেই বুঝায়, যারা কমন পিপলের এগেনস্টে থাকে। মানে, এই ধারণার একটা মিনিং তো আছেই, কিন্তু সবসময় এবং সব সমাজে সেইটা একইরকম জিনিস না, এইটা হইতেছে আমার কথা।
২. সেকেন্ড হইতেছে, হিস্ট্রি, কালচার ও পলিটিকস—এই তিনটা এলিমেন্ট আমি বাছাই করতেছি। এইটারে আরো এক্সপান্ড করার সুযোগ আছে—ইকোনমি, ফিলোসফি, রিলিজিওন বরং আরো স্ট্রং ক্যাটাগরি… মানে, চিন্তার জায়গাগুলা এতটা আলাদা আলাদা কিছু না। কিন্তু আমি এই তিনটা ক্যাটাগরি ধইরা কিছু জিনিস সামনে আনতে চাইতেছি, তার মানে এইটা না যে, এর বাইরে আলাপের কোনো স্কোপ নাই, বরং এইটা একটা সিলেকশনের ঘটনাই।
৩. থার্ড যেই জিনিসটা ক্রুশিয়াল, সেইটা হইতেছে একটা চিন্তার সিলসিলা ও কিছু রেফারেন্সের জায়গা থিকাই আমি দেখতেছি বা কথাগুলা বলতেছি; এইখানে আরো কিছু চিন্তার সিলসিলা আছে বা থাকতে পারে, এবং রেফারেন্সের জায়গাগুলাও যদি চেইঞ্জ হয় বা আরো ব্রডার হয়, তাইলে আলাপের জায়গাগুলাও তো বদলাবে আসলে।
কিন্তু ঝামেলার জিনিস যেইটা, আমি তো এইসব বিষয়ে সাবজেক্ট-ম্যাটার এক্সপার্ট না! মানে, একাডেমিক* লাইনের লোক আমি না; তারপরেও কথা বলতেছি, কারণ আমি লিটারেচারের লোক—কবিতা লেখি, সাহিত্য করি এবং এইসব বিষয়ে ভাবতে গিয়া দেখছি যে, ঘটনাগুলা খুবই ইন্টার-রিলেটেড এবং বিচ্ছিন্ন জিনিস না!
মানে, হিস্ট্রির কোন ন্যারেটিভটারে আপনি মানেন এবং কোন কালচারাল সিলসিলারে আপনার নিজস্ব জিনিস বইলা মনে হয়, তার উপরে আপনার সাহিত্যের টেস্ট ডিপেন্ড করে। দেখবেন, সাহিত্য-মেটেরিয়ালগুলার অ্যানালাইসিস ঠিকঠাকমতো না করতে পারলে হিস্ট্রি ও কালচারের জায়গাগুলারেও লোকেট করতে পারবেন না (এডওয়ার্ড সাঈদের অরিয়েন্টালিজম দিয়া বুঝতে পারবেন অনেকটা)। তো, বিসমিল্লাহ্ বইলা শুরু করি!
আলাপটা দুইটা পার্টে করব আমি। এক হইতেছে, ‘বাংলাদেশ-ধারণা’ বইলা কিছু আছে কিনা বা থাকা উচিত কিনা, আর সেইটা আসলেই মিসিং ঘটনা কিনা? বা কীভাবে মিসিং থাকতেছে?
সেকেন্ড হইতেছে, তাইলে কীভাবে বাংলাদেশ-সেন্ট্রিক চিন্তা-ভাবনা করতে হবে আমাদের, বা কেমনে পসিবল হবে সেইটা?
এক.
আমার একটা ইচ্ছা ছিল ২-৩ বছর আগে (এখনো কিছুটা আছে) যে, বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়া লেখা বইগুলা আমি পড়ব; মানে, যেইগুলার কথা লোকজন পাবলিকলি বলে বা একাডেমিয়াতেও পড়ানো হয়। তো, কিছু লিস্ট করছিলাম, কমপ্লিট করতে পারলে ভালো হইত। আমার অনেক কাজের মতোই এইটাও ঠিকমতো শুরুই করতে পারি নাই। তারপরও কয়েকটা বই পড়ছিলাম, এর মধ্যে একটা হইতেছে ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস’, অতুল সুরের। ভয়াবহ একটা বই! হিন্দু মহাসভা থিকা ছাপানো হইছিল ১৯৪২/৪৩ সালে। এখনো দেখবেন লোকজন এইটার প্রশংসা করে! অথচ খুবই রেসিয়াল একটা বই। যে কেউ এইটা পড়লে টের পাওয়ার কথা। তার পরে, ইটনের ‘The Rise of Islam and the Bengal Frontier’. ভালো একটা বই। অইটা নিয়া কিছু কথা আসবে এই আলাপে।
কিন্তু যেই বইপত্র বা লেখালেখিই আমি ব্রাউজ করছি, সেইখানে ইতিহাসের মগধ > মৌর্য > গুপ্ত > পাল > সেন > সুলতানি আমল > মোগল আমল > ব্রিটিশ শাসনÑএইরকম একটা ক্রনোলজি আছে, সেইখানে খেয়াল করছি যে, জিওগ্রাফিকাল লোকেশনগুলারে ইগনোর করা হয়; একেকটা টাইমে দেখবেন একেকটা লোকেশন জেগে উঠতেছে এবং অইটারেই পুরা ‘বাংলা’ বইলা কন্সিডার করা হইতেছে!
২-১টা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে, যখন ইখতিয়ার উদ্দিন বিন বখতিয়ার খিলজি গৌড় থিকা লক্ষ্মণ সেনরে হটায়া দিলেন, তখন গৌড় হইতেছে ‘বাংলা’; চিটাগাং, বরিশাল, সিলেট, এমনকি ঢাকাও বাংলা না! অথচ লক্ষ্মণ সেন তো পালায়া আসছিলেন বিক্রমপুরের দিকেই। অইটা আর ‘বাংলা’ না যেন!
তার চাইতে আরো ঝামেলার জিনিস হইতেছে, হিস্ট্রিরে দেখা হইতেছে ইনভেডরদের জায়গা থিকা। যেন একটা সাম্রাজ্য তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত এইখানে কোনো মানুষ ছিল না! এবং যেহেতু বেশিরভাগ হিস্ট্রি লেখা হইছে ব্রিটিশ পিরিয়ডে ও কলকাতাতে, অই লিগাসিই কম-বেশি কন্টিনিউ হইতে থাকতেছে, এখনো, লার্জ স্কেলে।
আর সেইখানে, ইন্টারনাল কোনো হিস্ট্রি নাই, এক্সটারনাল দখলগুলাই মেইন ফিচার হয়া আছে। আর যেহেতু অই ঘটনাগুলা মোগলদের আগে পদ্মার অই পাড় পর্যন্ত ঘটছে, অইগুলাই মেইন হিস্ট্রি, যেইখানে আজকের যেই বাংলাদেশ জিওগ্রাফিকালি, সেইটারে সেন্টার করা আলাপ কমই পাইবেন।
মানে, আমার কথা হইতেছে, ‘বাংলার ইতিহাসে’ বাংলাদেশ অঞ্চলের জিওগ্রাফি খুব কমই আছে। আর যতটুকই আছে, খুব বিচ্ছিন্নভাবে এবং পেরিফেরির ঘটনা হয়া আছে। আমার অনুমান হইতেছে, এইখানে ল্যান্ড ফর্মেশনটা যেমন ধীরে ধীরে হইছে, সমাজও ধীরে ধীরেই তৈরি হইছে। কিন্তু অই রিকগনিশনের জায়গাগুলাও মিসিংই কম-বেশি।
তো, যেহেতু হিস্ট্রির ন্যারেটিভটাতে আলাদা কইরা কোনো রিকগনিশন নাই। এই অঞ্চলের কালচাররে আলাদা কইরা নোটিস করার ঘটনাও অইভাবে ঘটে নাই! এবং এর কন্সিকোয়েন্স খুবই fatal একটা জিনিস হইছে! সবসময় একটা ‘আদারিং’ করার ঘটনা ঘটছে, এবং ‘আঞ্চলিক’ হিসাবে ট্রিট করা হইছে।
আপনি আলাদা কইরা চিটাগাংয়ের ইতিহাস পাইবেন, সিলেটের ইতিহাস পাইবেন, রংপুর ও রাজশাহীর ইতিহাস পাইবেন, এবং এই সবকিছু মিলায়া ‘বাংলাদেশের আঞ্চলিক ইতিহাস’ পাইবেন। কিন্তু একসাথে করলে পাইবেন ‘বাংলার ইতিহাস’, নট ‘বাংলাদেশ!’ কারণ, এইখানে যেন কোনো সেন্টার-পয়েন্ট নাই! কারণ সেন্টার-পয়েন্ট হইতেছে কলকাতা!
যেহেতু ব্রিটিশ আমলের হিস্ট্রিকাল রিডিংয়ের ভিতরে আমরা আছি। এর কালচারাল সেন্টার হইতেছে কলকাতা এবং এইভাবে ডাবল-কলোনাইজেশনের ঘটনাটা বাংলাদেশের ব্যাপারে ঘটতেছে! কলকাতা শহরের বাইরে বিশাল একটা বাংলাদেশ আছে, যার পুরাটাই হইতেছে ‘গ্রামবাংলা’!
যেইসব কালচারাল উপাদানগুলা আছে, যেমন গান, কবিতা, গল্প, সিনেমাÑঅইখানে ‘বাংলা-গান’, ‘বাংলা-কবিতা’, ‘বাংলা-গল্প’ ও ‘বাংলা-সিনেমা’ পাইবেন; কিন্তু ‘বাংলাদেশি গান’, ‘বাংলাদেশি কবিতা’, ‘বাংলাদেশি গল্প’, ‘বাংলাদেশি সিনেমা’ ইউটিউবে বা যেকোনো প্লাটফর্মেই ক্যাটাগরি হিসাবে পাইবেন না, বা পাইলে পাইবেন এক ধরনের সাব-ক্যাটাগরি হিসাবে।
মূল বা সেন্টার হইতেছে ‘বাংলা’! আর ‘বাংলাদেশি’ হইতেছে আলাদা কোনো কালচারাল ঘটনা না; বরং ১৯৭১ সালের পরে যেহেতু আরেকটা দেশ হইছে, এই কারণে আলাদা কইরা বলা লাগতেছে, এমনিতে আলাদা কিছু না! এই যে একটা কালচারাল ইন-সিগনিফিকেন্স—এই জায়গা থিকা আলাদা কইরা ‘বাংলাদেশি’ বানানোর একটা পলিটিকাল চাহিদাও তৈরি হইতেছে ইদানীং, যেইটা আরেক দফা ঝামেলার একটা ঘটনা।
আমার কথা হইতেছে, আমাদের চিন্তার মধ্যে আলাদা কইরা ‘বাংলাদেশি’ বইলা কোনো কালচারাল সিগনিফেকন্স এগজিস্ট করে না, যৎসামান্য যা আছে, সেইটা হইতেছে একটা সাব-ক্যাটাগরির ঘটনা! ইনফিরিয়রিটির ঘটনা!
(বাংলাদেশি সিনেমা নিয়া আমি একটা বই লেখছি, সেইখানে এই কালচারাল ডিফরেন্সের জায়গাটা নিয়া আমি বলছি যে, যেহেতু সিনেমা একটা নতুন ফর্ম এবং এর শুরু হইছিল মোস্টলি আফটার ১৯৪৭, সেইখানে ‘বাংলাদেশি সিনেমার’ সিগনেচারগুলা খুব প্রমিনেন্ট, কিন্তু অইগুলারে মিউজিকাল ড্রামা হিসাবে আপগ্রেড না কইরা ‘যাত্রা-সিনেমা’ বা ‘ফোক-সিনেমা’ বইলা ঘৃণা করতে শিখছি আমরা…।)
তো, এই হিস্ট্রিকাল ও কালচারাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং না থাকার কারণে বাংলাদেশের পলিটিকাল ইতিহাস শুরু হয় ১৯৭১ সাল থিকা (১৯৪৭-ও না)। যেহেতু এই সময় থিকা পলিটিকাল এনটিটি তৈরি হইছে। কিন্তু যেহেতু এর কোনো আলাদা হিস্ট্রি নাই এবং কালচারাল সিগনিফেকন্সও নাই, পলিটিকাল বাংলাদেশও তৈরি হইতে পারে নাই! বরং জোরজবরদস্তি কইরা, গোঁজামিল দিয়া কিছু ইতিহাস বানানোর ট্রাই করা হয়।
হিস্ট্রিকাল ন্যারেটিভ একটা গোড়া বা বেইজ হিসাবে কাজ করে। আবার পলিটিকাল প্রয়োজনেই অনেক সময় হিস্ট্রি ও কালচাররে ইনভেন্ট করা হয়। কিন্তু সারফেইস লেভেলে যা আছে, সেইগুলারে যদি আমরা কন্সিডার করি, সেইখানে ব্রিটিশ আমলের যেই বেঙ্গল প্রভিন্স, সেইটা এখনো আমাদের হিস্ট্রি, কালচার ও পলিটিকসের বেইজ হয়া আছে।
তবে বাংলাদেশের রাজনীতির শুরু মেবি ১৮৭১ সালের আদম-শুমারি থিকা। তখন দেখা গেল যে, ‘আরে, এই অঞ্চলে তো অনেক মানুষ!’ এর পলিটিকাল রিকগনিশন আসছে ১৯০৫ সালে ‘বঙ্গভঙ্গে’র ভিতর দিয়া। কিন্তু এস্টাবলিশড হিস্ট্রি ও কালচারের সাথে এক ধরনের ডিজ-অ্যাসোসিয়েশনের শুরুয়াতও তখনই। যেইটা এখনো কন্টিনিউ হইতেছে, এবং অই পাজলটারে আমরা সল্ভ করতে পারতেছি না বইলাই আমার কাছে মনে হইছে।
এখন, আমি যদি একটু সামারাইজ করি, তাইলে ঘটনাগুলা এইরকম হবে—
১. একটা এগজিসটিং হিস্ট্রির ন্যারেটিভে বাংলাদেশ বইলা আলাদা কিছু নাই, রিসেন্ট কিছু পলিটিকাল ডেভেলপমেন্ট আছে।
২. ‘বাংলাদেশি’ বইলা আলাদা কোনো কালচারাল সিগনিফেকন্সও নাই তেমন। বরং একটা সাব-ক্যাটাগরি হিসাবে দেখার ঘটনা আছে।
৩. যার ফলে পলিটিকালি বাংলাদেশের দিশাও খু্ব একটা স্পষ্ট হইতে পারে নাই।
কিন্তু ক্রুশিয়াল প্রশ্নটা হইতেছে, এইরকম কোনো ‘বাংলাদেশ-ধারণা’র দরকার আছে কিনা! পলিটিকাল কারণে তো দরকার আছেই; কারণ যদি পলিটিকালি ‘বাংলাদেশি’ আইডেন্টিটিতে আপনি বিলিভ না করেন, তাইলে আলাদা রাষ্ট্র হয়া কেন থাকবেন! আর যেহেতু পলিটিকাল একটা রাষ্ট্র তৈরি হইছে, এর পেছনে কালচারাল ও হিস্ট্রিকাল কোনো ইচ্ছা বা ট্রেন্ড না থাকলে সেইটা তৈরি হওয়াটা তো কঠিনই হওয়ার কথা, তাই না? তো, সেই এলিমেন্টগুলা কী? আমি মনে করি, অই জায়গাগুলাতে কোনো ডিসিশানে পৌঁছানোর আগে আমাদের প্রশ্নগুলা করতে পারাটাই জরুরি বেশি।
আমি বলতে চাইতেছি, বাংলাদেশ বইলা একটা রাষ্ট্র তৈরি হইছে বইলা এখন ‘বাংলাদেশি’ বইলা আইডেন্টিটি তৈরি করতে হবে বা জাগায়া তুলতে হবে—এইরকম পলিটিকাল নিডের জায়গা থিকা দেইখেন না! বরং এই যে পলিটিকাল জায়গাটাতে আইসা আমরা পৌঁছাইছি, কোন হিস্ট্রিকাল ও কালচারাল কনটেক্সটের ভিতর দিয়া আমরা আসছি? সেইটা যদি এগজিসটিং ন্যারেটিভের লগে কম্পিটেবল না হয়, তাইলে অই জায়গাগুলারে নতুন কইরা দেখা দরকার না আমাদের? এই জায়গা থিকা আমি বলতে চাইতেছি, ‘বাংলাদেশ-ধারণার জায়গাটারে আমাদের এগজামিন করা উচিত।
(পরের অংশ আগামী সংখ্যায়)