‘মুহাম্মদের ইলহাম’
জর্মন আধুনিকতাবাদী কবি রাইনার মারিয়া রিলকের Mohammeds Berufung কালামের তর্জমা, ‘মুহাম্মদের ইলহাম’, নিয়ে আমি কিছুদিন থেইকাই পেরেশান ছিলাম। এই কবিতাটা তিনি আমাদের রাসুল (সা.)-কে নিয়ে ১৯০৭ ঈসায়ীতে রচনা শুরু করসিলেন; ১৯০৮ ঈসায়ীতে, তার ‘Neue Gedichte anderer Teil (New Poems, Part Two)’ সংকলনে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়।
বুদ্ধদেব বসু তার বিখ্যাত রিলকে অনুবাদ সংকলনে এই কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত করেননি—সম্ভবত কবিতাটির ইসলামি তাৎপর্য তার আয়ত্তে না থাকায়; অথবা Mohammeds Berufung বুদ্ধদেব বসুর কাব্যিক রুচির এত সুদূরে ছিল যে, এই কবিতা ধারণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
Mohammeds Berufung রিলকের রুমি-পাঠ ও ইসলাম নিয়ে দীর্ঘ-চর্চাঘটিত। কবিতাটিকে শুধু কাব্যিক অনুষ্ঠান হিসেবে না দেইখা—বরং য়োরোপীয় মডার্নিটির এপরিয়া (aporia) নিয়া, এক অগ্রগণ্য মনীষীর মরমি-চর্যা হিসাবে দেখা বেহ্তর।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
রিলকে তার জীবনে ধীরে ধীরে ইসলামিক টেক্সটের প্রতি আকৃষ্ট হৈসেন। ১৯০৭-০৮ ঈসায়ীর দিকে বিভিন্ন অনুবাদ ও সেকেন্ডারি সোর্স থেইকা তার কোরআন মজিদের সাথে গভীর পরিচয় ঘটসিলো। তার স্ত্রী ক্লারা ওয়েস্টহফের ১৯০৭ ঈসায়ীর মিসর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও এই সময়ে করা চিত্রকর্ম রিলকের প্রাচ্য-ভাবনাকে আলোড়িত করসিলো। রিলকের ইসলাম-বিষয়ক আগ্রহের বীজ ক্লারার ভ্রমণের অনেক আগেই, যদিও উপ্ত হৈসিলো, কিন্তু ক্লারার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রিলকের এই আগ্রহকে আশেকানায় রূপান্তরিত করে। য়োরোপে তখন ইজিপ্টোলজির ফ্যাড প্রায় শেষের দিকে; ইন্ডোলজি নিয়ে হাঁকডাক জোরেশোরে চলতেসে, অনুবাদের জোয়ার আসতেছে। এই প্রেক্ষাপটে জর্মন প্রাচ্যবিদ্যা, বিশেষ করে ফ্রিডরিখ র্যুকার্টের কোরআন মজিদ অনুবাদ এবং মাক্স মুলারের মতো পণ্ডিতদের ইন্ডোলজির প্রতিষ্ঠা রিলকের প্রজন্মকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করসিলো।
কিন্তু, বলাই বাহুল্য রিলকের ওপর ইসলামের দাবাও শুধু ফ্যাশন-দুরস্ত নয়। বিশেষত ‘মুহাম্মদের ইলহাম’ তার পারিসে, ভাস্কর অগুস্ত রোদাঁর সাথে, দীর্ঘ শিক্ষানবিশি সম্পর্কের সূত্রে আরব্ধ দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইউরোপীয় গুপ্তবিদ্যা (হারমেটিক ও রোসিক্রুশিয়ান ঐতিহ্য) থেইকা সুফি ‘কালামের’ জগতে আসার একটি সুস্পষ্ট বিবর্তনের চিহ্নায়ন। রিলকের এই যাত্রা ইসলামিক আধ্যাত্মিকতাকে বোঝার জন্য এক অদ্ভুত লেন্স হিসেবে কাজ করসে, যা একই সাথে অনেক কিছুকে আলোকিত করসে, আবার বিকৃতও করসে।
রিলকের মিসর যাত্রা
১৯১১ ঈসায়ীর শেষ দিকে রিলকে স্বয়ং মিসর সফর করেন। তিনি মুসলমানদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার আধ্যাত্মিক তাৎপর্যে শিহরিত হন। তিনি ক্লারাকে এক পত্রে লিখসিলেন: ‘মনে হয় যেন নবী (সা.) গতকালই এখানে হাজির ছিলেন, আর এই শহর যেন তাঁরই অধিকৃত রাজ্য।’ এই উদ্ধৃতিটি রিলকের রোমান্টিক ইউরোপীয় প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্ভূত, যা তার আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের একটি অংশ, কিন্তু ইসলামের প্রকৃত বোধ থেইকা, হয়তো, বেশ কিছুটা ভিন্ন। রিলকে বিশ্বাস করতেন যে মুসলিম-প্রাচ্য এক ‘অসীম উন্নত ও জ্ঞানতান্ত্রিক বাস্তবতা।’ পরবর্তী সময়ে তিনি লিখসিলেন: ‘খ্রিষ্টধর্ম ক্রমাগত ঈশ্বরকে একটি সুন্দর কেকের মতো টুকরো টুকরো করে; কিন্তু আল্লাহ এক, আল্লাহ সম্পূর্ণ।’
দার্শনিক তাৎপর্য
‘মুহাম্মদের ইলহাম’ কবিতায় রিলকে কেবল ইসলামের নবীর জীবনের একটি মুহূর্ত, আসলে, চিত্রিত করেননি—তিনি নিরক্ষর ও অজ্ঞান ইনসানের ‘ভাষার রাজ্যে প্রবেশের’ সেই আদিম ও রহস্যময় অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরসেন, প্রতি প্রকৃত সত্যান্বেষী, এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন, নিজ অন্তরের হেরায়, অন্তত একবার। রিলকে এই ধারণাটি আপ্ত করে বারবার বোঝার চেষ্টা করেছেন, কীভাবে জ্ঞানের বোঝা থেইকা মুক্ত এক পবিত্র আধারেই ঐশীবাণী প্রবেশ করতে পারে। অক্ষরের ক্লিষ্টতা ও মিডিয়েশন ছাড়া কীভাবে মাকলুকাত সরাসরি বস্তু ও প্রাণ থেকে জ্ঞান অর্জন করতে পারে, এই বিষয়টি বোঝার আকুতি রিলকের সময়ের একটি সাধারণ দার্শনিক অভিক্ষেপ। যদিও আজকে আমাদের মনে হতেই পারে, রিলকের এই আন্তরিক আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান আসলে য়োরোপীয় রোমান্টিক প্রাচ্যবাদের সীমার মধ্যেই থেকে গেসিল।
মুহাম্মদ (সা.)-এর নিরক্ষরতা এখানে কেবল ঐতিহাসিক সত্য নয়—এটি সেই ‘পবিত্র অজ্ঞতার’ (উম্মি—এই পদটি পবিত্র কোরআন মজিদে ছয়বার উল্লেখিত হইসে, কিন্তু রিলকের জন্য মূল আয়াতটি ছিল: সুরাহ আল আ‘রাফ, ৭ :১৫৭: ‘যারা রাসুলের অনুসরণ করে, সেই উম্মি নবী, ... ...’) প্রতীক যা প্রকৃত জ্ঞানার্জনের পূর্বশর্ত। বিশ্বাসী পাঠকের কাছে এই নিরক্ষরতা আসলে অদৃশ্য জ্ঞান অর্জনের জন্য নির্বাচিত হওয়ার এক বিশেষ যোগ্যতা।
রিলকে ও সুফি ঐতিহ্য
রিলকের এই কবিতায় শুধু যে আমাদের রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের প্রতি আগ্রহ দেখান হইসে তা নয়, বরং ইসলামের সুফি ঐতিহ্য, বিশেষত মাওলানা রুমির প্রতি, রিলকের, তীব্র আকর্ষণও ‘মুহাম্মদের ইলহাম’ কবিতায় প্রকাশিত। রিলকে মাওলানা রুমির মসনবীর থিম, যেমন ঐশী মদিরা বা রহস্যময় আবরণ উন্মোচনের ধারণাগুলা নিয়া মন্ত্রমুগ্ধ হৈসিলেন এবং ‘মুহাম্মদের ইলহাম’ কালামটিতে ঐশী অভিজ্ঞতাই বুনিয়াদি; সেই থিম, কালামের, বিশেষত শেষ ছত্রে, একদম ফর্সা হইয়া ফুটে ওঠে, যা বিশেষ ইসলামিক নান্দনিকতার সঙ্গেও সাযুজ্যপূর্ণ।
ছন্দ
রিলকে তার Neue Gedichte সংকলনে জর্মন ছন্দের বাঁধন থেইকা সরে এসে এক ধরনের মুক্তছন্দ বা প্রায় ইংরেজি ফ্রি ভার্স-এর মতো একটি ছন্দ ব্যবহার করসিলেন। এই পর্যায়ে, তার কবিতার পঙ্ক্তিগুলোয় কোনো নির্দিষ্ট মিটার বা শ্বাসাঘাতের বিন্যাস থাকে না। বরং এটি গদ্যের সাবলীলতায় কিছু কাব্যিক মুহূর্ত স্ফূর্ত করে। আমি ‘Mohammeds Berufung’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ দলিলকে ঢিলেঢালা ভাবানুবাদ করতে চাইনি।
এই বিষয়ে আমার ছন্দ ও ভাষা ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হইসে। এই অনুবাদটির ছন্দ কাঠামো মূলত স্বরবৃত্ত আর এটিই রিলকের মুক্তছন্দ বাঙলায় আনার উপযোগী বইলা আমার ধারণা হয়।
স্বরবৃত্তের দ্রুত, সচল ছন্দ—যার মূল একক ৪ ও ৬ মাত্রার বিন্যাস—ঐশী সাক্ষাৎকারের মনস্তাত্ত্বিক চাপ এবং রিলকের আধুনিকতাবাদী শৈলী দুটোকেই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হইসে বলে আমি ধারণা করি। নজরুলের কবিতায় স্বরবৃত্ত, বাঙালি মুসলমানের, স্বভাবজাত তীব্র আবেগ ও কথ্যভাষার স্পন্ধন প্রকাশ করসে; এই আদর্শ সামনে থাকায়, রিলকের কবিতার সম্পূরক চাহিদা পূরণের জন্য স্বরবৃত্তের ব্যবহার খুব ভুল হবে বইলা আমার মনে হয় নাই। নমুনা হিসেবে দেখতে পারেন:
‘যখন খলওয়াতের গুহায় নামলেন সেই আযীম কুদরত’ (৪+৪+৬ মাত্রার বিন্যাস)
‘আমি না, আমি না, ছাড়েন অধমরে’ (৩+৩+৪ মাত্রার বিন্যাস)
‘আলফাজের অমিয় ওজন’ (৪+৪ মাত্রার বিন্যাস)
এই কালামে ‘খলওয়াত’, ‘ফারিস্তা’, ‘মুস্তাকিম’, ‘তিলাওয়াত’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার, এক ধরনের নিজস্ব রিদম তৈরি করে। এই রিদমটি কানে হয়তো প্রথাগত ছন্দের মতো লাগে না, কিন্তু এটি রিলকের মূল কবিতার অনিয়মিত, আবেগঘন ও নাটকীয় মেজাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অনুবাদের ‘আমি না, আমি না’ লাইনটি নবীর শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিরোধকে স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রকাশ করসে—যা দ্রুত, জরুরি এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রামাণ্য।
এখানে আমার আমোদ, এতুটুকুই যে, আমাদের গ্রামবাংলার দাদি-নানিদের মুখের স্বরবৃত্ত দিয়ে, আমি ঠিক সেই আধুনিকতাবাদী কাজটিই বাংলা ভাষায় করতে প্রয়াস পাইসি, যা রিলকের অনিয়মিত ছন্দ জার্মান ভাষায় করসিলো—অনির্বচনীয় উপলব্ধিকে মানুষের ভাষায় প্রকাশের জন্য সাহিত্যের নিয়ম মুচড়ে দেওয়া, একটু।
এখানে এলান থাকুক, আমি সামান্য গদ্য লেখক; কবি খ্যাতি আমার নাই; ছান্দসিকদের ডরাই। আমার এই প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য, কোন প্রকৃত কবি, রেগেমেগে, এখন, এই কালামটির কোনো অসাধারণ অনুবাদ করবেন।
ভাষা প্রসঙ্গে বলতে চাই, আমি ভাল্টার বেনইয়ামেনের ‘বিশুদ্ধ ভাষা’ নির্মাণে প্রলুব্ধ হইসি, এখানে; বিশুদ্ধ ভাষা, বেনইয়ামেন বলছেন—যা উৎস ও লক্ষ্য উভয় ভাষাকে অতিক্রম করে; তারপর, এক authentically new yet faithful বা মূলানুসারী নূতন ও অর্থের প্রতি বিশ্বস্ত জবান তৈরি করতে উদ্যত হয়।
অনুবাদ প্রসঙ্গে
সম্প্রতি আমার কায়রোতে কয়েকটি দিন অতিবাহিত করার সুযোগ হইসে। কায়রো থেইকা প্রায় ৩০০ মাইল দূরে এক অপূর্ব ভূমধ্যসাগর উপকূলীয় শহরের সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে আমি যেমন খায়রুদ্দীন বার্বারোসার অটোমান নৌবহর, চক্ষুর সামনে দেখতে পাই, তেমনি নুবিয়ান নারীর মতো লাবণ্যময় নাইলের অবশেষ, আমার মনে হাজার বছর ধইরা, এখানে, গড়ে ওঠা বিবিধ সাধনা-ঐতিহ্যের স্মৃতি জাগায় দেয়।
আশ্চর্য যে, য়োরোপে নয়, বরং কায়রোতে আইসাই রিলকের জিন্দেগিভর অস্থির অন্বেষণের তাৎপর্য আমার কিছু বোধগম্য হয়। রিলকে যেভাবে মরমি এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া ঐশী কালামের ওজন অনুভব করসিলেন, নাইলের তীরে দাঁড়ায়া আমি যেন সেই গভীরতা অনুভব করসি। এই বঙ্গানুবাদ সেই অভিজ্ঞতারই ক্লেদজ কুসুম।
‘মুহাম্মদের ইলহাম’
যখন খলওয়াতের গুহায় নামলেন
সেই আযীম কুদরত—এক লমহায় চেনা ফারিস্তা:
জিব্রাইল, মুস্তাকিম, নূরানী,
অদৃশ্য জ্যোতির আমির—
ফানার রূপে এলেন তিনি জ্যোতির্ময়।
আমার রাসুল উজালা রাহা ত্যাগি আরজি জানান:
‘আমি না, আমি না, ছাড়েন অধমরে,
থাকি প্রারব্ধ ক্ষয়ে দীর্ণ,
সফরে সফরে পেরেশান—
আমি সামান্য সওদাগরই, নিরক্ষর, অবিন্যস্ত,
কালাম-কিতাবে অজ্ঞ,
আন্দাজ নাই আলফাজের অমিয় ওজন।
আপনি যা পড়তে বললেন—
তার ভার নিতে আমি অক্ষম!’
কিন্তু ফারিস্তা আজ্ঞা দেন—
আবার দেখান সহিফা,
তাতে মাকতুব, অনন্ত জ্যোতির ইশারা।
ফারিস্তা বলেন: ‘ইকরা!’—
তিনবার সেই আহ্বান, আবির আশ্বাস।
রাসুল আমার তখন—
এমন গভীর তিলাওয়াতে রত হইলেন,
জিব্রাইল কাঁপতে কাঁপতে সিজদায় পড়েন।
তারপর থেকে সেই দম-এ-ওয়াহিদে
রূপ নিলেন আমার রাসুল—
তিনি কারি, আরিফ, মুআদ্দি,
আর বাতেনী কালামের দ্বার।’