গুরুশিষ্য পরম্পরা
কর্ণফুলী থেকে নাফ দুই নদীর মধ্যবর্তী চট্টগ্রামের এলাকা জীববৈচিত্র্যে যেমন অনন্য, রাজনীতিক বৈশিষ্ট্যেও অনন্য। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো এ অঞ্চল অরণ্যসংকুল, সমুদ্রউপকূলবর্তী ও পর্বতবেষ্টিত। এত বৈচিত্র্য বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। মধ্যযুগব্যাপী এ অঞ্চল ছিল আরাকানের অংশ। ষোড়শ শতকে এ অঞ্চল ছিল আরাকান ও ত্রিপুরার মাণিক্য রাজাদের সংঘর্ষের সবচেয়ে বড় উর্বরক্ষেত্র, সতেরো শতকে তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয় পর্তুগিজরা।
ভাষার বৈচিত্র্য রাজনৈতিক বৈচিত্র্যের মতোই। আরবি, ফারসি, উর্দু ও সংস্কৃতের সঙ্গে এসে মিশেছে পালি ও বর্মি। পুঁথিসাহিত্য তারই প্রমাণ বহন করছে। ভাষা আন্দোলনের কিংবদন্তি প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের জন্ম এ অঞ্চলেরই সেবন্দি গ্রামে। মোগলদের চট্টগ্রাম অভিযানের সময় তিন দিক দিয়ে আরাকানিরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং দক্ষিণ দিকে পালিয়ে যায়, যার জন্য গ্রামের নাম হয় সেবন্দি। ফারসি ভাষায় সে মানে তিন, বন্দি মানে শৃঙ্খলিত। শত্রু-অধ্যুষিত এলাকা থেকেই প্রদীপ্ত হয় স্বাদেশিকতার শিখা। জানা যায়, ভাষাসংগ্রামী আবুল কাসেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে নৈশ বিদ্যালয়ে পুঁথিপাঠের আসর বসাতেন।
কর্ণফুলী থেকে নাফ নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগকে এককথায় বলা হয় দক্ষিণ চট্টগ্রাম। আরাকানের পর্বতমালা থেকে উদ্ভূত সাঙ্গু নদীর অববাহিকায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়ার অবস্থান। চট্টগ্রামের মধ্যে যেমন উত্তর চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম, তেমনি পটিয়ার মধ্যে উত্তর পটিয়া ও দক্ষিণ পটিয়া। এই দুই পটিয়ার মধ্যে উত্তর পটিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও পুঁথিবিশারদ আবদুস সাত্তার চৌধুরী। সাহিত্যবিশারদ ও পুঁথিবিশারদ ছিলেন আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ। আবদুস সাত্তার চৌধুরীর জন্ম দক্ষিণ হুলাইন গ্রামে (বাবা আবদুল মজিদ চৌধুরী ও মা রফেয়া খাতুন)। বংশলতিকায় জানা যায়, আবদুস সাত্তার চৌধুরীর পূর্বপুরুষ ছিলেন দৌলত মুহাম্মদ হামজা খাঁ চৌধুরী। তিনি বাংলার শাহি আমলের একজন প্রতাপশালী ভূঁইয়া ছিলেন পাঠান তরফদার দৌলত মুহাম্মদ হামজা খাঁ চৌধুরী নামে ছিলেন সমধিক খ্যাত। হামজা খাঁর ঊর্ধ্বতন তৃতীয় পুরুষ হজরত শেখ শাহ খোয়াজ মুহাম্মদ খাঁ সিলেটের শাহজালালের সেনাপতি সৈয়দ নাসিরউদ্দীনের অধস্তন সৈয়দ সুলতানের (১৫৫০-১৬৪৮) প্রপৌত্র সৈয়দ গদা হাসানের শিষ্য ছিলেন।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের জন্ম সুচক্রদণ্ডী গ্রামে। তার বাবার নাম মুন্শী নুরউদ্দীন (১৮৩৮--১৮৮১)। তার মা মিস্রীজান ছিলেন হুলাইনেরই প্রাচীন প্রখ্যাত পাঠান তরফদার দৌলত হামজা বংশের মেয়ে। বংশপরম্পরায় সাহিত্যবিশারদ ও পুঁথিবিশারদ দুজন একই পরিবারের সদস্য। পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহের দিক থেকেও দুজন ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। সাহিত্যবিশারদের কাছেই আবদুস সাত্তার চৌধুরীর পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহের হাতেখড়ি।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের (১৮৭১-১৯৫৩) জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয় ১৯৬৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। সে উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান। তার অর্ধশতাব্দী পর পালিত হয় পুঁথিবিশারদ আবদুস সাত্তার চৌধুরীর (১৯১৯-১৯৮২) জন্মশতবার্ষিকী। জন্মের দিক থেকেও দুজনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ৫০ বছর। লোকসাহিত্য সংগ্রহের দিক থেকে সাহিত্যবিশারদ প্রথম প্রজন্মের আর পুঁথিবিশারদ দ্বিতীয় প্রজন্মের।
দুটি জাতীয় অভ্যুত্থান দুজনকে মৃত্তিকাসংলগ্ন সংগ্রাহকে রূপান্তরিত করে। স্বদেশি আন্দোলন প্রেরণা জোগায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে, আর ভাষা আন্দোলন অনুপ্রাণিত করে আবদুস সাত্তার চৌধুরীকে। সাহিত্যবিশারদ যে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এবং স্বদেশি আন্দোলন ও অসহযোগের পক্ষে ছিলেন, তা তার কোনো কোনো প্রবন্ধ থেকে জানা যায়। সাহিত্যবিশারদ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফসল, পুঁথিবিশারদ ভাষা আন্দোলনের ফসল। দুটি অভ্যুত্থানই ঘটে অর্ধশতাব্দীর ব্যবধানে একটি ব্রিটিশ আমলে, অন্যটি পাকিস্তান আমলে। দুজনই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীন মুক্ত সাহিত্যতত্ত্বের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে তাদের স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। এটি এমন একটি অঞ্চল, যাকে বলা যায় মধ্যযুগে মুসলিম প্রতিভা বিকাশের সবচেয়ে উর্বরক্ষেত্র, অন্য ভাষায় বলা যায় পুঁথিসাহিত্যের সূতিকাগার।
বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার আগে মৃত্যুবরণ করেন সাহিত্যবিশারদ। আহমদ শরীফ বলেন, বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান তার জীবৎকালে প্রতিষ্ঠিত হলে হয়তো বহু কাব্য সম্পাদনা এবং মধ্যযুগের সমাজ, সাহিত্য, লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মৌলিক গ্রন্থ রচনায় উৎসাহ পেতেন। কিন্তু এমন একটি প্রতিষ্ঠানের অভাবে শুধু সংগ্রহ ও প্রবন্ধ রচনার মধ্যেই তার কাজ সীমাবদ্ধ থাকে। তবে ভাষা আন্দোলনের ফসল বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার (৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৫) পর পুঁথিসাহিত্য সংগ্রহ ও পুস্তক প্রকাশনার ক্ষেত্রে এ ধরনের বাধা কেটে যায়। বিশেষত সৈয়দ আলী আহসান পরিচালক হিসাবে যোগদান করার (১৫ ডিসেম্বর ১৯৬০ – ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭) পর ১৯৬০-১৯৬৬ কালপর্বে আবদুস সাত্তার চৌধুরী সংগ্রহ করেন সাতশ’র বেশি পুঁথি। এ সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লোকসাহিত্যের তুলনামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেছেন। পাশ্চাত্য রীতিপদ্ধতি অনুসৃত ফোকলোর চর্চা করেছেন মযহারুল ইসলাম ও আশরাফ সিদ্দিকী। তারা উভয়েই আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। তবে সংগ্রহে পারদর্শিতা দেখান সিরাজউদ্দীন কাসিমপুরী ও আবদুস সাত্তার চৌধুরী। আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সম্পাদনাকালে ভাষাসংগ্রামী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আঞ্চলিক শব্দ সংগ্রহ করেন স্কুল-কলেজের শিক্ষক সংগ্রাহকদের মাধ্যমে। পুঁথিসাাহিত্যও সংগৃহীত হয় একই পদ্ধতিতে। বাংলা একাডেমি ১৯৫৮-১৯৬৭ সালে লোকসাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করে নিয়মিত ১৪ জন ও ১১২ জন অনিয়মিত সংগ্রহকারীর মাধ্যমে। ১৯৬৬ সালে গবেষণা বিভাগে একটি লোকশিল্প সংরক্ষণাগার চালু করা হয়। ড. শহীদুল্লাহ্ ফোকলোর বিভাগ চালু করে পত্রিকার নাম রাখেন লোকসাহিত্য সংকলন।
বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের ইতিহাস দেড়শ বছরের পুরোনো। লোকসাহিত্য সংগ্রহে পুরোধা ব্যক্তিত্ব ধর্মযাজক রেভারেন্ড লালবিহারী দে, তার সংগ্রহ প্রকাশিত হয় লন্ডন থেকে ১৮৮৩ সালে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের (১৮৭৭-১৯৬৭) ঠাকুরমার ঝুলি প্রকাশিত হয় ১৯০৭ সালে। দীনেশচন্দ্র সেনের ময়মনসিংহ গীতিকা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে; চার খণ্ডে ইস্টার্ন বেঙ্গল ব্যালাডস ১৯২৩, ১৯২৬, ১৯২৮ ও ১৯৩২ সালে। চন্দ্রকুমার দে সংগ্রহ করেন মৈমনসিংহ গীতিকা, আশুতোষ চৌধুরী পূর্ববঙ্গ গীতিকা, আবদুস সাত্তার চৌধুরী চট্টগ্রাম গীতিকা। ২৬টি পালাগানের মধ্যে ১৩টি প্রকাশিত হয় ড. মোমেন চৌধুরীর সম্পাদনায় পাঁচ খণ্ডে চট্টগ্রাম গীতিকা নামে। তাদের সংগৃহীত অনেক পালাই অপ্রকাশিত। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপ্রকাশিত আবদুস সাত্তার চৌধুরীর পালা।