শান্তিতে নোবলজয়ী প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশংসায় এখন ভাসছে দেশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার সফলতা তুলে ধরা হচ্ছে। নাগরিকদের অনেকে ড. ইউনূস যেন চার-পাঁচ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকেন, এমন প্রস্তাবও করেছেন। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ ব্রিফিং করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ডক্টর ইউনূসের আলোচনাকে বাংলাদেশের জন্য আশার আলো বলে বর্ণনা করেছেন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-কূটনীতিকরা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ ইতিবাচক কূটনীতিতে ফিরে এসেছে। কারণ এত দিন পর বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়গুলো সঠিকভাবে এবং গুরুত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফোরামে তুলে ধরা হচ্ছে।
ডক্টর ইউনূসকে মানুষ এমনিতেই ভালোবাসেন। কারণ তিনি বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েট। গরিব মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ রয়েছে। দারিদ্র্য নিরসনে তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশেই শুধু নয়, বিশ্বব্যাপী এক ‘সাকসেস স্টোরি’র নাম। তিনি দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তার দেওয়া সামাজিক ব্যবসার মডেল প্রয়োগ করে দেশে দেশে তরুণ উদ্যোক্তারা উপকৃত হচ্ছেন। তার তিন শূন্যের তত্ত্বও আলোচিত।
অর্থাৎ শূন্য কার্বন, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য দারিদ্র্য। নারীদের ক্ষমতায়ন ও স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রেও ডক্টর ইউনূস অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তবে তার প্রতি সাম্প্রতিক যে অভূতপূর্ব ভালোবাসা ও উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে, তা এসব কারণে নয়। বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়া খুব কম। অল্পতেই মানুষ তুষ্ট হয়। শান্তিমতো দুবেলা ভাত খেতে পারলেই হলো। আর দেশটা যাতে ঠিকমতো চলে, স্বাধীনতা বিপন্ন যাতে না হয়। কেউ যাতে দেশটার ক্ষতি না করে। ডক্টর ইউনূস মানুষের এই চাওয়া-পাওয়াকেই ধারণ করেছেন। ফলে এত খুশি মানুষ।
শেখ হাসিনার জমানার শেষদিকে বাংলাদেশের এই নোবেল বিজয়ীকে কোর্টের বারান্দায় বারান্দায় দৌড়ানো হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে লিফট বন্ধ রাখায় সাত-আটতলা পর্যন্ত সিঁড়ি বেয়ে তাকে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়েছে। কোর্টের লোহার খাঁচার ভেতর ঢুকে হাত-জোর করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, শেখ হাসিনায় নিষ্ঠুরতা কোথায় গিয়ে ঠেকেছিল, তাও প্রত্যক্ষ করেছে মানুষ। তাকে লক্ষ করে শেখ হাসিনা উপহাস করে বলেছিলেন, পদ্মা সেতু থেকে ফেলে দিয়ে পানিতে তিনটি চুবানি দেবেন। এসব কাণ্ডে তখন মানুষ দুঃখ পেয়েছেন। তবে তাদের তখন করার কিছু ছিল না। শেখ হাসিনার দাবনীয় শাসনের ভয়ে মানুষ ছিল কাবু। গুটিকয়েক ব্যক্তি ছাড়া তখন কেউই তার পক্ষে সাহস করে কথা বলতে এগিয়ে আসেননি। যদিও ভয়কে জয় করা আমাদের উচিত ছিল। সেটা করতে পারলে শেখ হাসিনা দেশের এত সর্বনাশ করে যেতে পারতেন না।
জুলাই বিপ্লবের পর ছাত্রদের অনুরোধে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে রাজি হন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। তার এই সিদ্ধান্তে মানুষ খুব আশান্বিত হয়। তিনি দেশটাকে ভালো করতে পারবেন এই বিশ্বাস মানুষের আছে। বিপ্লবী ছাত্ররা, রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনীসহ সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই গত বছরের ৮ আগস্ট ডক্টর ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। আজ তার দায়িত্ব গ্রহণের আট মাস পূর্ণ হলো। এই আট মাসে আমরা দেখেছি অনেক চড়াই-উতরাই পার করেছেন তিনি। কখনো কখনো মনে হয়েছে তিনি পারবেন না। তার সরকার ফেল করে যেতে পারে।
যেকোনো বিপ্লবের পরই পরিস্থিতি টালমাটাল বা এলোমেলো থাকে। শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে না পারলে বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যায়। ডক্টর ইউনূস কঠোর হতে পারছিলেন না। তাই বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যায় কি না, একটা সন্দেহ ছিল। আমাদের একটা বদ-অভ্যাস আছে, সবকিছু তাড়াতাড়ি পেতে চাই। তাৎক্ষণিক লাভটাই বড় করে দেখি। সে কারণে হতাশা এসেছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ডক্টর ইউনূস নিরাশ হননি। তার হিসাবটা ছিল আলাদা। দেশের মানুষ গত ১৫ বছর এমনিতেই মার খেয়েছেন। মানুষ আর কত মার খাবেন, তাই এত দাবি-দাওয়ার বহর সত্ত্বেও এবং তিন শতাধিক বিক্ষোভের মুখেও তিনি র্যাব-পুলিশ দিয়ে দমনের প্রক্রিয়ায় যাননি। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিক্ষোভ নিরসন করেছেন। এর মধ্যে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র ছিল, সরকার যাতে ব্যর্থ হয় উসকানিও ছিল। ডক্টর ইউনূস সবকিছু ধৈর্যের সঙ্গেই মোকাবিলা করেছেন।
রমজান মাসে শান্তিপূর্ণভাবে রোজা পালন করা এবং দ্রব্যমূল্য কম মূল্যে পাওয়ার ব্যাপারে দেশের মানুষের বড় একটি কনসার্ন। বিষয়টি ভেবে কয়েক মাস আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রাখেন ডক্টর ইউনূস। দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরার জন্য রমজানের আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিভিন্ন দেশ থেকে এনে বাজার সয়লাব করে রাখা হয়। অথচ আমরা কেউ টেরই পেলাম না। এখানে আগে থেকেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট খুব শক্ত। তা ছাড়া প্রতিবেশী ভারত থেকেই আনা হতো বেশিরভাগ পণ্য। ফলে মনে করার কারণ ছিল ভারত হয়তো পণ্য সরবরাহে বাধার সৃষ্টি করবে। একই সঙ্গে সিন্ডিকেটের কারণে রোজার মাসে মানুষের কষ্টের সীমা থাকবে না। আমাদের চিন্তাভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ডক্টর ইউনূসের সরকার ভারতের ওপরই নির্ভর থাকেননি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি নিশ্চিত করে ফেলেন। কখন কোন পণ্য কোথা থেকে আসবে, কোন বন্দরের কী অবস্থা সবকিছু যথাসময়ে মনিটরও করা হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কাজ করেনি। সরবরাহে ঘাটতি ছিল না। বাজারে পণ্যে সয়লাব ছিল। সিন্ডিকেট এমনিতেই ভেঙে যায়। তাই আমরা দেখলাম রমজানে আগের তুলনায় দ্রব্যমূল্য অনেক কম ছিল; এতে স্বস্তি পেয়েছে জনগণ। মূল্যস্ফীতি ফেব্রুয়ারিতে নেমে আসে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশে, যা ছিল বিগত ২২ মাসের তুলনায় সর্বনিম্ন। ডক্টর ইউনূস ঘোষণা করেছেন আগামী জুনের মধ্যে এই মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের নিচে নেমে আসবে। রমজানে আরেকটি বিষয় মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে, তা হলো কী শহর, কী গ্রাম একবারের জন্যও বিদ্যুৎ যায়নি। গরমে মানুষ কষ্ট পাননি। কারণ বিদ্যুৎ উপদেষ্টাকে এ ব্যাপারে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ে থাকতে হয়েছে।
এবারের ঈদকে বলা হয়েছে স্বস্তির ঈদ। নিজেরাই সাক্ষী এবার কত সুন্দর ঈদ করেছি আমরা। ঈদের আগে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস জনগণকে ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা জানান। ঈদটা যাতে এবার স্মরণীয়ভাবে আনন্দদায়ক হয়, এ কামনা করেছিলেন তিনি। সত্যিই ঈদটা স্মরণীয়ভাবেই আনন্দদায়ক হয়েছে। আমাদের মা-বাবা, মুরব্বিরা যে ভাষায় কথা বলেন, সে ভাষাতেই ডক্টর ইউনূস ঈদের আগে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পবিত্র মাহে রমজানকে তিনি বলেছেন, মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি। শবেকদরের পবিত্র রজনিতে মহান আল্লাহ যেন তার সব বান্দার মোনাজাত কবুল করেন, তার প্রার্থনা করেছেন। মানুষকে ঈদ মোবারক জানিয়ে বলেছেন, ঈদে পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্বিঘ্নে এবং আনন্দ সহকারে নিজ নিজ বাড়ি যাবেন। আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করবেন। গরিব পরিবারের খোঁজখবর নেবেন, তাদের ভবিষ্যৎ ভালো করার জন্য চিন্তাভাবনা করবেন, আপনাদের সন্তানদের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেবেন।
তিনি ঈদের জামাতে দলমত-নির্বিশেষে হাজির হয়ে ঈদের নামাজ আদায়ের পাশাপাশি পরাজিত শক্তির সব প্ররোচনা সত্ত্বেও সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকারও পরামর্শ দিয়েছিলেন। সত্যিই আমরা নির্বিঘ্নে বাড়ি গিয়েছি এবং ঢাকায় ফিরে এসেছি। ঈদযাত্রায় আগের ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। তাহলে আপনারাই বলুন, মানুষ কেন তাকে ভালোবাসবেন না? এমন মুরব্বিসুলভ কথাবার্তায় শত্রুও পরাজয় মেনে নেয়। ঈদের দিনটিতে ঢাকার কথা ভাবুন। সত্যিকারের একটা আনন্দের দিনই মনে হয়েছে। জাতীয় ঈদগাহে সাদা পাঞ্জাবি এবং সাদা কিস্তি টুপি পরে নামাজ পড়তে এসেছিলেন ডক্টর ইউনূস। নামাজের আগে তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতাও করেছেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে যেতে বলেছেন। এক ভাই আরেক ভাইয়ের সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে ঈদের কোলাকুলি করতে বলেছেন। তাই আমরা দেখলাম নামাজের পর ঈদগাহে ডক্টর ইউনূসের হাতের একটু ছোঁয়া পেতে, করমর্দন করতে নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে মানুষের যে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা, কী উচ্ছ্বাস তাকে নিয়ে! তেমনি ঈদ আনন্দ মিছিলসহ শহরময় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।
কূটনীতির ক্ষেত্রে কিছুদিন ধরে আমরা লক্ষ করলাম, শুধু সফলতাই নয়, রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছেন ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের রিপোর্ট শেখ হাসিনার বিচারের জন্য এক মস্তবড় দলিল। এই রিপোর্টে পতিত স্বৈরাচারের নিপীড়নের বর্ণনা উঠে এসেছে। গত জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে তাদের ওপর হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগ যে দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালায়, তা পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে জাতিসংঘ এ রিপোর্ট প্রকাশ করে। এ রিপোর্ট পড়লে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের হত্যা করতে শেখ হাসিনা নিজে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার নির্দেশে পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী গুন্ডাবাহিনীর হাতে ১৪০০ মানুষ খুন হন। এর মধ্যে ১৩ শতাংশ ছিল শিশু। কী ভয়াবহতা! একজন প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করিয়েছেন, হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলারও নির্দেশ দিয়েছেন।
ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য পৃথিবীর সব নিষ্ঠুরতা ছাড়িয়ে যান শেখ হাসিনা এটাই জাতিসংঘের রিপোর্টে উঠে এসেছে। ডক্টর ইউনূস দৃঢ়কণ্ঠেই ঘোষণা করেছেন, এই নিষ্ঠুর গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনার বিচার এ দেশের মাটিতে হবেই। শেখ হাসিনা পালিয়ে এখন ভারতে আছেন। ব্যাংককে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনায় ড. ইউনূস শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছেন। বৈঠকে তিনি গণহত্যার প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং জাতিসংঘ রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, বিচারের মুখোমুখি করার জন্যই শেখ হাসিনাকে ফেরত চাই। মোদির সঙ্গে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতের বিএসএফ কর্তৃক হত্যাকাণ্ড, গঙ্গার পানি চুক্তির নবায়ন, তিস্তা সমস্যার সমাধানের কথাও বলেছেন।
রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে একটি বড় সমস্যা। এ সমস্যাও শেখ হাসিনা সৃষ্টি করে গেছেন। এ সমস্যার সমাধানে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিছুদিন আগে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। গুতেরেস ঢাকায় এলে তাকে নিয়ে ড. ইউনূস কক্সবাজারে গিয়েছেন এবং এক কোটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ইফতার করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব সাদা পাঞ্জাবি পরে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়েছেন।
ড. ইউনূসের প্রস্তাবে জাতিসংঘ মহাসচিব আগামী সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে পৃথক একটি অধিবেশনের আয়োজনে সম্মত হয়েছেন এবং এর প্রস্তুতি চলছে। মালয়েশিয়া ও ফিনল্যান্ড এ সম্মেলনের আয়োজকের দায়িত্ব নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জুলি বিশপ এই সম্মেলনে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। চীন সফরকালে সে দেশের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গেও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলেছেন ড. ইউনূস। চীনা প্রেসিডেন্ট তাকে আশ্বস্ত করেছেন মিয়ানমারের সঙ্গে বিষয়টি সুরাহার ব্যবস্থা করবেন তিনি।
ব্যাংককে অনুষ্ঠিত বিমসটক সম্মেলনেও রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস। চতুর্মুখী চাপের ফলে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কিছুটা হলেও রাজি হয়েছে। ড. ইউনূস ব্যাংককে থাকা অবস্থাতেই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আপাতত তারা ১ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেবে এবং পরে আরো ৭০ হাজার নেবে।
ঐতিহাসিক চীন সফরে গিয়ে ড. ইউনূস হইচই ফেলে দিয়েছেন। তার এই সফল ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারত দীর্ঘদিন ধরে টালবাহানা করছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ওপর দায় চাপিয়ে চুক্তিটি ঝুলিয়ে রেখেছে ভারত। তাদের মতলব ধরে ফেলেছেন ড. ইউনূস। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না। আঙুল বাঁকাতে হবে। তিনি তিস্তা সমস্যা সমাধানে চীনের সহযোগিতা চাইলেন। চীনা প্রেসিডেন্টকে বললেন, নদী ও পানি ব্যবস্থাপনায় আপনারা বিশ্বের মধ্যে মাস্টার। বাংলাদেশ ব-দ্বীপের দেশ। নদী ও পানি সমস্যায় আমরা ভুগছি। শুকনো মৌসুমে পানির অভাব আমাদের হাহাকার লেগে যায়। বর্ষা মৌসুমে বন্যায় মরি। চীনা প্রেসিডেন্ট তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নিলেন।
ড. ইউনূসের কাছে তাদের পানিসম্পদমন্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলেন। তার সঙ্গে এলেন চীনের সব নামকরা পানি বিশেষজ্ঞ। তারা দুই ঘণ্টার বেশি আলোচনা করলেন। জানালেন যে, শুধু তিস্তা নয়, নদী ও পানি সমস্যা সমাধানে ৫০ বছরের উপযোগী একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করবে চীন। ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে বাংলাদেশের। আশা করা যায় এর একটা সুরাহা বাংলাদেশ পাবে। তেমনি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য সেভেন সিস্টার্সের অর্থনৈতিক উন্নতির ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে কথা বলেছেন ড. ইউনূস, যা ভারতে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। চীন সফর এবং ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনে ড. ইউনূসের এসব ইতিবাচক তৎপরতা ভারতকে চাপে ফেলেছে। একদিকে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার চাপ, অন্যদিকে বাংলাদেশের ইস্যুগুলো সুরাহা করা।
রাজনীতির ক্ষেত্রেও সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ড. ইউনূস। তার সরকারের করা সবগুলো সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট জমা দিয়েছে। একটি ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলোর ব্যাপারে তাদের মতামত দিয়েছে। প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন ড. ইউনূস।
ইতোমধ্যে তিনি ঘোষণা করেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। ব্যাংককে বিমসটকের সম্মেলনে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, দ্রুত নির্বাচন করা তার সরকারের অগ্রাধিকার। নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির নেতা সারজিস আলম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার আহ্বান জানালেও ড. ইউনূস সেটাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন না। তিনি ভাবছেন, তার উঁচু সম্মানের কথা। এই বিশাল জনপ্রিয়তার মধ্যে ড. ইউনূস যদি সবচেয়ে নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করে দেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণ করিয়ে দিতে পারেন, সেটাই হবে তার বড় সফলতা।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। ব্যাংকক থেকে ফিরেই ড. ইউনূস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি বৈঠক করেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে নিজেই কথা বলবেন। কী দূরদর্শিতা!
ইতোমধ্যে বীর-উত্তম জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাকে তুলনা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি জিয়াও ড. ইউনূসকে পছন্দ করতেন। একবার উত্তরাঞ্চলে দুদিনের সফরে ড. ইউনূসকে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার উন্নয়নে ড. ইউনূসের পরিকল্পনার কথা মাঠপর্যায়ে গিয়ে শুনেছেন। ড. ইউনূস রাষ্ট্রপতি জিয়ার মতোই একজন কাজপাগল মানুষ। আমারও তার সঙ্গে কাজ করার কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে।
সাংবাদিক হিসেবে অন্তত আট-দশটি সাক্ষাৎকার তার নিয়েছি। তার সহধর্মিণী ড. আফরোজী ইউনূস আমার সরাসরি শিক্ষক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আমাকে পদার্থ বিজ্ঞান পড়িয়েছেন। ড. ইউনূস পুরো সফলকাম হবেন আমার এ বিশ্বাস আছে। তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। ভালোবেসে বাংলাদেশের মানুষ তাকে যে গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন, তিনি তার প্রতিদান দেবেন। রাজনীতি, কূটনীতি ও সামাজিকতায় ইতোমধ্যে তিনি বাজিমাত করেছেন।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমার দেশ