মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়। এটি মুসলিম সমাজের হৃদয়কেন্দ্র। যেখানে আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা ও সামাজিক চেতনাসমবেত হয়। ইসলামের সূচনালগ্নে মসজিদ ছিল জ্ঞান, নেতৃত্ব, ন্যায়বিচার এবং সমাজকল্যাণের কেন্দ্র। নবী করিম (সা.) মসজিদের মিম্বর থেকে যেমন ঈমান ও আমলের দাওয়াত দিতেন, তেমনি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দারিদ্র্যবিমোচন ও মানবিক মূল্যবোধ প্রচার করতেন। কিন্তু আজকের দিনে মিম্বর অনেক জায়গায় সীমিত, শুধু ধর্মীয় উপদেশের মধ্যে। সময় এসেছে—মিম্বরকে উন্মুক্ত করার, যেন তা সমাজের জন্য দিকনির্দেশনা এবং নৈতিক পুনর্জাগরণের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
ইতিহাসের আলোকে মিম্বরের গুরুত্ব
নবীজি (সা.) তাঁর মসজিদের মিম্বরকে শুধু আধ্যাত্মিক শিক্ষার আসন হিসেবে ব্যবহার করতেন না। সেখানে সমাজের বাস্তব সমস্যা, ন্যায়বিচার, দারিদ্র্যবিমোচন এবং পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যার দিকনির্দেশনা দেওয়া হতো। সাহাবায়ে কিরামরা শিখতেন কীভাবে একজন মুসলিম দুনিয়া ও আখিরাতের সফল নাগরিক হতে পারে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারিমে বলেছেন—‘আর তোমরা মানুষের সঙ্গে কথা বলো সৌজন্য ও মনের প্রশান্তির সঙ্গে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫৯)
বর্তমান বাস্তবতা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা
আজকের দিনে মসজিদের মিম্বর অনেক জায়গায় সীমিত। অনেক সময় খুতবা শুধু আধ্যাত্মিক বা নৈতিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সমাজের সমস্যাগুলো যেমন—দারিদ্র্য, বেকারত্ব, পারিবারিক ভাঙন, কিশোর অপরাধ, নারী নির্যাতন, প্রযুক্তির অপব্যবহার, সামাজিক বৈষম্য—এসব বিষয়ে সচেতনতা কম। সর্বোপরি রাজনৈতিক এবং পারিপার্শ্বিক প্রতিবন্ধকতা মিম্বরকে প্রভাবিত করে। কখনো কখনো রাজনৈতিক প্রভাব, দলীয় আগ্রহ, স্থানীয় ক্ষমতার চাপ বা সামাজিক অসহযোগিতা বক্তাকে স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ দেয় না। এতে সমাজে নৈতিক ও সামাজিক বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছায় না। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের জন্য উপকারে আসে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে বসাবে।’ (মুসলিম)
এখান থেকে বোঝা যায়, মিম্বরে সমাজের বাস্তব সমস্যার কথা তুলে ধরা এবং সমাধানের পথ দেখানো ইসলামিক দায়িত্ব।
উন্মুক্ত মিম্বরের প্রয়োজনীয়তা
উন্মুক্ত মিম্বর মানে শুধু বক্তার স্বাধীনতা নয়, বরং জ্ঞান ও সচেতনতার মুক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করা। ইসলামে বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়কে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে আর (যদি কখনো বিতর্কের দরকার পড়ে, তবে) তাদের সঙ্গে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়।’ (সুরা নাহল : ১২৫)
উন্মুক্ত মিম্বরে শিক্ষিত তরুণ, আলেম, সমাজকর্মী ও চিন্তাবিদরা ইসলামিক মূল্যবোধের আলোয় সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশেষত—
* যুবসমাজের সামনে আধুনিক জীবনের সমস্যাগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে তুলে ধরা।
* নারীর শিক্ষা ও অধিকার বিষয়ে ইসলামের সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করা।
* সামাজিক সম্প্রীতি, মানবতা ও নৈতিকতার প্রচার।
* প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও নৈতিকতার সমন্বয় নিয়ে সচেতনতা তৈরি।
মিম্বরের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা
উন্মুক্ত মিম্বর শুধু বক্তার জন্য নয়, সমাজের জন্যও দায়িত্বের। এটি হতে হবে সংযত, যুক্তিসংগত এবং মানবকল্যাণমুখী। রাজনৈতিক প্রভাব বা পারিপার্শ্বিক চাপের মুখেও মিম্বরকে সমাজের সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের বার্তা প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘উত্তম মানুষ হচ্ছে যে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে তার দ্বারা।’ (বুখারি)
সামাজিক শান্তি ও ঐক্য বজায় রাখা মিম্বরের প্রধান লক্ষ্য। রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও, যদি মিম্বর থেকে সত্য, ন্যায় ও মানবিক দিকনির্দেশনা দেওয়া যায়, সমাজে বিভাজন কমে এবং সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
আধুনিক যুগে মিম্বরের পুনর্জাগরণ
প্রযুক্তিনির্ভর যুগে ইসলামবিরোধী চিন্তা ও সংস্কৃতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে ভোগবাদ, অবিশ্বাস এবং অসৎ সামাজিক প্রবণতায়। এ অবস্থায় মসজিদের মিম্বর হতে পারে ইসলামি চিন্তার পুনর্জাগরণের প্রধান হাতিয়ার। যদি মিম্বর বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ ও জ্ঞানচর্চার সমন্বয়ে ব্যবহার করা হয়, মুসলিমরা আবার ফিরে পাবে হারানো নেতৃত্ব।
শেষকথা
মসজিদের মিম্বর শুধুই কাঠের ধাপ নয়। এটি জাতির আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং সামাজিক উত্থানের প্রতীক। তাই সময় এসেছে মিম্বরকে উন্মুক্ত করার—জ্ঞানের, প্রজ্ঞার এবং নৈতিকতার আলোয় আলোকিত করার। নবী কারিম (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে যদি আমরা মিম্বরকে সমাজ উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলি, ইনশাআল্লাহ মসজিদ হবে শান্তি, ঐক্য এবং প্রগতির কেন্দ্রÑযেমনটি ছিল ইসলামের সূচনালগ্নে। উন্মুক্ত মিম্বর শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সামাজিক, নৈতিক, শিক্ষামূলক এবং মানবকল্যাণমুখী বার্তা প্রচারের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে মুসলিম সমাজকে শক্তিশালী করবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, আস-সুফফাহ মডেল মাদরাসা গাজীপুর