হোম > ধর্ম ও ইসলাম

যে ওয়াজ-মাহফিল উপকারী নয়

আবদুল কাইয়ুম শেখ

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে ‘ওয়াজ মাহফিল’ এক জনপ্রিয় ধর্মীয় আয়োজন। ইসলামি শিক্ষার প্রচার, মানুষকে নৈতিকতার পথে আহ্বান ও সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে এই মাহফিলের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, ওয়াজ মাহফিল অনেক ক্ষেত্রে তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে উল্টো বিভ্রান্তি, বিদ্বেষ ও বিভেদ তৈরির উৎসে পরিণত হচ্ছে।

ফলে মাহফিলের সংখ্যা বাড়লেও এর কার্যকারিতা ও উপকার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। আজ আমরা জানার চেষ্টা করব কেন ওয়াজ মাহফিল এতটা উপকারী হচ্ছে না।

ইখলাস না থাকা

মহান আল্লাহর কাছে কেবল সেই আমলই গ্রহণযোগ্য, যা ইখলাস ও লিল্লাহিয়তের ওপর নির্ভরশীল। অনেক বক্তা ইখলাসের সঙ্গে ওয়াজ না করে লৌকিকতা অবলম্বন করেন, অথচ কোরআন শরিফে সব আমলের ক্ষেত্রে ইখলাস অবলম্বন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও জাকাত দিতে, এটাই সঠিক দীন।’ (সুরা বাইয়্যিনাহ : ০৫)

জ্ঞান ও গবেষণার ঘাটতি

ইউটিউবে ভাইরাল বেশিরভাগ বক্তা ইসলামি শাস্ত্রের গভীর জ্ঞান রাখেন না। তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোরআন, হাদিস, ফিকহ ও তাফসিরের প্রমাণভিত্তিক শিক্ষা না নিয়ে কেবল মৌখিক প্রচলিত গল্প ও উপাখ্যানের ওপর নির্ভর করেন। ফলে তাদের বক্তব্যে অপ্রমাণিত হাদিস, বানোয়াট কিসসা ও অতিশয়োক্তি বেশি দেখা যায়। এ কারণে তাদের ওয়াজ উপকারী হয় না। অথচ মহাগ্রন্থ আল কোরআন মনগড়া কথাবার্তা বলা থেকে নিরুৎসাহিত করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না; কর্ণ, চোখ, হৃদয়—এদের প্রত্যেকটি সম্পর্কেই কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা বনি-ইসরাইল : ৩৬)

বক্তা আমলদার না হওয়া

যে আলেম ওয়াজ করবেন তাকে আমলদার হতে হবে। যদি কোনো আলেম আমল না করে ওয়াজ করেন, তাহলে তার কথার প্রভাব মানুষের মধ্যে পড়বে না। যেসব আলেম অন্যদের সদুপদেশ দেন, অথচ নিজেরা সৎ আমল করেন না, তাদের প্রতি হুঁশিয়ারবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এসেছে—‘তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও, আর নিজেদের বিস্মৃত হও? অথচ তোমরা কিতাব অধ্যয়ন কর। তবে কি তোমরা বোঝ না।’ (সুরা বাকারা : ৪৪)

ওয়াজের বিনিময়-চুক্তি করা

ওয়াজ করার ক্ষেত্রে বক্তাদের জন্য উচিত ছিল নিঃস্বার্থভাবে বিনিময়-চুক্তি ছাড়া ওয়াজ করা এবং আয়োজকদের জন্য প্রয়োজন ছিল বক্তাদের আসা-যাওয়ার খরচ বহনসহ প্রয়োজনীয় সম্মানী দেওয়া। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ওয়ায়েজরা চুক্তি করে ওয়াজ করতে যান। যদি নির্ধারিত টাকা দেওয়ার চুক্তি না করা হয়, তাহলে ওয়াজে যেতে সম্মত হন না। আবার উল্টোটাও দেখা যায়, অনেক কষ্ট করে বক্তারা মাহফিলে যাওয়ার পর তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকুও আয়োজকরা দেন না এবং আসা-যাওয়ার ভাড়া ও প্রয়োজনীয় সম্মানী দিতে কার্পণ্য করেন। এমন দুঃখজনক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আয়োজকরা বক্তাদের আল্লাহর জন্য সম্মান করলে এবং ওয়ায়েজরা নিঃস্বার্থভাবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দ্বীন প্রচারের লক্ষ্যে ওয়াজ করলে, তা উপকারী হতে বাধ্য। নবী-রাসুলরা দ্বীন প্রচারে কোনো ধরনের পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না। আল কোরআনে এসেছে—‘আমি তোমাদের কাছে এটার জন্য কোনো প্রতিদান চাই না; আমার পুরস্কার তো জগৎসমূহের প্রতিপালকের কাছেই আছে।’ (সুরা শুআরা : ১০৯)

বিনোদন ও ব্যবসায় রূপান্তর

ওয়াজ মাহফিল এখন অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিনোদন বা বাণিজ্যিক ইভেন্টে পরিণত হয়েছে। দুনিয়া লাভ করার উদ্দেশ্যে ওয়াজ করা বিপজ্জনক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ইলমের দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা যায়, কোনো লোক যদি দুনিয়াবি স্বার্থ লাভের জন্য তা শেখে, তবে সে কেয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না।’ (আবু দাউদ : ৩৬৬৪)

বিভেদ সৃষ্টি ও কটূক্তি

কোনো কোনো ওয়াজ মাহফিলে মতবাদগত বিরোধ ও রাজনৈতিক ইঙ্গিত অশোভন পন্থায় উল্লেখ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্য মাজহাব ও সম্প্রদায়ের নিন্দা করা হয়। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতা নষ্ট হয়। অথচ আল্লাহ তায়ালা মানুষের বোধগম্য ভাষায় ও সুন্দর পন্থায় দাওয়াত দিতে উৎসাহিত করেছেন। ইসলামে দাওয়াতের পদ্ধতি হলো যুক্তি, ভালোবাসা ও উদাহরণের মাধ্যমে মানুষকে সত্যের পথে ডাকা। আল-কোরআনে এসেছে—‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশ দিয়ে এবং এদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়। তোমার প্রতিপালক, তাঁর পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়, সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা নাহল : ১২৫)

ইসলামি শিক্ষার বিকৃতি

ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে অনেক সময় ইসলামকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন সেটি কেবল ভয়, অলৌকিক কাহিনি বা মৃত্যুভয়ের ধর্ম। অথচ ইসলামে বুদ্ধিবৃত্তি, ন্যায়বিচার, মানবতা ও বিজ্ঞানও অন্তর্ভুক্ত । আল কোরআনে ভাষ্য হলো, ‘তবে কি তারা কোরআন সম্বন্ধে অনুধাবন করে না? এটা যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে আসত, তবে তারা তাতে অনেক অসংগতি পেত।’ (সুরা নিসা : ৮২)। অর্থাৎ চিন্তা, বিচার ও প্রমাণভিত্তিক জ্ঞানই ইসলামি শিক্ষার ভিত্তি, কিন্তু অনেক ওয়াজে তা অনুপস্থিত।

শেষ কথা

ওয়াজ মাহফিল সত্যিকার অর্থে সমাজের জন্য উপকারী হতে পারে, যদি তা ইখলাস, জ্ঞান ও নৈতিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। আলেম ও বক্তাদের উচিত গবেষণাধর্মী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা, অপ্রমাণিত হাদিস বা বক্তব্য প্রচার থেকে বিরত থাকা এবং দ্বীনি দাওয়াতকে সংক্ষিপ্ত, সুশৃঙ্খল ও হৃদয়স্পর্শীভাবে উপস্থাপন করা। আয়োজক ও মিডিয়ার দায়িত্ব হলো, ওয়াজকে বাণিজ্য বা বিনোদনে রূপান্তরিত হতে না দেওয়া এবং সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি রোধ করা। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ওয়াজ মাহফিল শুধু মানুষের ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধি করবে না; বরং নৈতিকতা, মানবিকতা ও সমাজ সংস্কারের আলোও জ্বালাবে।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা

সংসারের কাজে নারীর নেকি

মাসুম খাঁর তিন গম্বুজবিশিষ্ট শাহি মসজিদ

সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ঈমান রক্ষা

সৌদি আরবের চতুর্থ গ্র্যান্ড মুফতি আল ফাওজান

কাবার হাতিম অংশে নামাজ আদায়ের সময়সূচি

খাবার শুধু শরীরের আহার নয়, আত্মারও প্রশান্তি

নবীরা আসমানি বার্তাবাহক

অলি-আওলিয়াদের পরিচয়

১৫০০ বছরের কোরআনি বিস্ময়

সমকামিতা ও সমলিঙ্গ বিবাহ ইসলামবিরোধী