হোম > ফিচার > আমার জীবন

এক ছোট্ট দ্বীপের গল্প

বন্যা নাসরিন

কাপ্তাই হ্রদের ভেতর অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপের দেখা মেলে রাঙামাটিতে। সেই সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করা কঠিন। এই অপরূপ প্রকৃতি দেখতে রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার এক দ্বীপে দুদিনের ভ্রমণ ছিল স্বপ্নের মতো।

কাপ্তাইয়ের এক ছোট্ট দ্বীপে গড়ে উঠেছে রাঙামাটি জেলার প্রথম হোমস্টে। সেখানে গেলে থাকা যাবে চাকমাদের বাড়ি, খাওয়া যাবে তাদের হাতের রান্না, উপভোগ করা যাবে কাপ্তাই হ্রদের জল আর পাহাড় সারির স্নিগ্ধতা। এসব তথ্য জানার পর থেকেই ইচ্ছা ছিল সেখানে ঘুরতে যাওয়ার। অবশেষে সেই সুযোগ এলো এবার হেমন্তে। পান্থপথ থেকে রাত সাড়ে ১০টার বাসে রওনা হলাম কাপ্তাইয়ের উদ্দেশে। বৃহস্পতিবার হওয়ার দরুন ব্যস্ত নগরীর জ্যাম ঠেলে ঢাকা পার হতেই চলে গেল প্রায় তিন ঘণ্টা। মাঝরাতে যাত্রাবিরতি ছিল কুমিল্লায়। বাসে সরাসরি কাপ্তাই সদরের নতুন বাজারে নামতে হয়। আমরা বুঝতে না পেরে লিচু বাগানে নেমে পড়েছিলাম। সেখান থেকে পাবলিক সিএনজিতে করে জনপ্রতি ৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে পৌঁছালাম নতুন বাজারে। ততক্ষণে ১০টা বেজে গেছে। নতুন বাজার থেকে আবার পাবলিক সিএনজিতে ৩০ টাকা জনপ্রতি ভাড়ায় গেলাম এসএসডি ঘাট। লিচুবাগান থেকে এসএসডি ঘাট পর্যন্ত বেশ কিছু পর্যটন স্পট চোখে পড়েছিল, আর পুরো রাস্তাটাও ছিল নয়নাভিরাম। কিন্তু সময়ের অভাবে আমরা কোথাও নামতে পারিনি। নতুন বাজার থেকে এসএসডি ঘাট পর্যন্ত যেতে তিনবার সেনাবাহিনীর চেকিং হলো। ঘাটে পৌঁছে পাহাড় আর কাপ্তাই হ্রদের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঘাট থেকে সামান্য নাস্তা সেরে নিলাম। সেখানে নাস্তা করার মতো তেমন সুব্যবস্থা নেই। নতুন বাজার বা কাপ্তাই থেকে নাস্তা সেরে আসাই উত্তম। সেখানে অনেক খাবার হোটেল আছে। এসএসডি ঘাট থেকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে মাত্র পাঁচ মিনিটের জলপথ অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু তার জন্য ভাড়া দিতে হয় বেশ কিছু টাকা। মনে হবে, টাকাটা একেবারে গচ্চা গেল। নৌকা বা ট্রলারের আকার অনুযায়ী ভাড়ায় তারতম্য আছে। আমরা যেই ট্রলারটা নিলাম, তাতে ১৬ জন উঠলাম ১ হাজার ৬০০ টাকায়। প্রথমে গেলাম ধনপাতা বাজারে, যা আমাদের দ্বীপ ‘গরবা গুদি’ থেকে খুব কাছে। এই বাজারটি বেশি বড় নয়। আশপাশের মানুষদের জন্য এটাই একমাত্র স্থানীয় বাজার। বাজার থেকে জাম্বুরা, কলা আর চাকমাদের পোশাক কিনে আবার ট্রলারে চড়ে বসলাম। এ বাজারের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হলো একদম কাপ্তাই হ্রদের গা ঘেঁষে শতবর্ষী একটা বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে ডালপালা মেলে। খুব সুন্দর সেই দৃশ্যটা।

ধনপাতা বাজার থেকে গরবা গুদিতে যাওয়ার পর আমরা বাঁশের মাচাং ঘরে চলে গেলাম। আমাদের পাহাড়ি পেঁপে খেতে দেওয়া হলো। দীর্ঘ যাত্রার পর এমন একটা খাবার খেতে খুব ভালো লেগেছে। গরবা গুদি ভ্রমণের সময় ১২টা থেকে ১২টা। তাই প্রথম দিন সকালের খাবার মেলে না সেখানে। আমরা একটু বিশ্রাম নিলাম। হ্যামকে দোল খেলাম। তারপর দুপুরের খাবারের জন্য ডাক এলো। খাবার ঘর থেকেও কাপ্তাইয়ের মনোরম দৃশ্য চোখ জুড়ায়। আর পেট জুড়াল কাপ্তাই হ্রদের চাপিলা মাছ ভাজা, চিংড়ি মাছের তরকারি, মুরগির মাংস আর ডাল ও গরম ভাত খেয়ে। খাবারটা এককথায় অমৃত ছিল। ইচ্ছা করছিল প্রতি বেলায় এই একই খাবার খেতে। খাওয়া শেষে মাচাংয়ে ফিরে গেলাম। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে নেমে পড়লাম গোসলে। হ্রদের ঠান্ডা জলে গোসল করতে কী যে ভালো লাগছিল। আমি সাঁতার পারি না; কিন্তু লাইফজ্যাকেট ছিল, সেটাই ব্যবহার করে ইচ্ছামতো দাপাদাপি করেছি।

কাপ্তাই হ্রদে সবচেয়ে ভালো লাগে বিকাল নেমে এলে। বিকালে হেমন্তের হাওয়া গায়ে মেখে গরবা গুদির নিজস্ব নৌকায় কিছুক্ষণ ঘুরলাম। সন্ধ্যা নামি-নামি করছে, এমন সময় হ্রদের পাশে বেঞ্চে বসে পাহাড়ি জাম্বুরা খেলাম। সন্ধ্যায় মাচাংয়ে চা আর নুডুলস চলে এলো। বলা বাহুল্য, এ খাবারটাও খুব মজা ছিল। তারপর মাচাংয়ের খোলা বারান্দায় বসে আকাশের তারা দেখতে দেখতে ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও আমি ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া মোমবাতি জ্বালালাম। তাতে বাঁশের মাচাং আর বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি আরো মায়াময় হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামল। তারপর আবার বারান্দায় গিয়ে বসলাম। দূরের কিছু কৃত্রিম আলো এসে পড়ছিল হ্রদের জলে। সেই আলোয় নৌকা চলাচল দেখছিলাম। রাতদিন নৌকা চলাচল করে সেখানে। আর জলের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে মাচাংয়ের কাছে। কী যে মোহনীয় সেই ঢেউয়ের শব্দ। মেঘ কেটে আবারও তারার দেখা মিলল। তারা দেখতে দেখতে জীবন ও যাপনের অনেক গল্প করলাম আমার ভ্রমণসঙ্গীর সঙ্গে। রাতের খাবারের ডাক পড়ল। খাবার ঘরটা আমাদের মাচাং থেকে একটু দূরে। বৃষ্টিভেজা আবহে রাতের খাবার খেলাম ডিমভাজি, বেগুনভর্তা, মাছের তিন রকম পদ, পাতাকপি আর বরবটি-সিদ্ধ দিয়ে। শেষের খাবারটা একদম নতুন ছিল আমার জন্য। স্বাস্থ্যকর খাবার। খেতেও ভালো।

মধ্যরাতে রীতিমতো ঝড় শুরু হলো। চারপাশ থেকে বৃষ্টির জল এসে পড়ছিল মাচাংয়ের ভেতর। আমরা ব্যাগপত্র, তোশক কিছুটা গুটিয়ে নিরাপদ দূরত্বে রাখলাম। বৃষ্টিটা খুব উপভোগ করেছি। এটা যেন আমাদের জন্য বাড়তি পাওয়া ছিল। সানরাইজ দেখার অতি আগ্রহে হোক কিংবা রাতের প্রতি বিমুগ্ধ আবেশে, আমার ঘুম হলো না বললেই চলে। মাচাংয়ের পেছনের খোলা দরজা বরাবর যখন প্রথম সূর্য উঁকি দিল, তখনো হ্রদের জলে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। সোনারঙা আলো একটু একটু করে ছড়াতে শুরু করল। মাছ ধরা নৌকাগুলো তখনো চলাচল করছে। পেছনে বড় বড় পাহাড় আর অবাক সে সূর্যোদয়। আমি যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। জীবনে এত সুন্দর সকাল বোধহয় কমই আসে। সানরাইজের মুগ্ধতা চোখেমুখে নিয়ে ফ্রেশ হলাম। পুরো দ্বীপে একটাই বাড়ি, আর সেখানে অনেক প্রজাতির ফুলগাছ। বাড়িটা যেন ফুলের বাড়ি। ভোরের নরম আলোয় পুরো দ্বীপ হেঁটে বেড়ালাম একা। শিউলি, নয়নতারা ও অলকানন্দা ফুল কুড়ালাম। কিছুক্ষণ পর সকালের নাস্তা চলে এলো। আলুভাজি, ডিমভাজি, পরোটা আর চা। পরোটা আনা হয় ধনপাতা বাজার থেকে। আর বাকিগুলো তারা নিজেরাই রান্না করে।

নাস্তা সেরে আমরা পাহাড়ি পোশাকে সাজালাম নিজেদের। পাড়া বেড়ানোর জন্য বের হলাম। দ্বীপের আশপাশে জনবসতি খুব কম। আমরা ঘন জঙ্গল পেরিয়ে কয়েকটা মাত্র বাড়ি দেখতে পেলাম। খানিকটা দূর থেকে কাপ্তাইয়ের বিখ্যাত নারিকেল বাগান দেখে ফের চলে এলাম। এসেই পরলাম লাল টুকটুকে পাহাড়ি শাড়ি। কিছু ছবি তুলে তারপর শাড়ি বদলে নিলাম। নেমে পড়লাম গোসলে। অনেকটা সময় নিয়ে গোসল করলাম। গোসলের চেয়ে গল্প, আনন্দ আর গান হলো বেশি। পাহাড়ি সংগীত শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। গোসল শেষে মাছের দুই পদ, ডাল আর গরম ভাত খেলাম। তারপর মাচাংয়ে বসে খেলাম চাইনিজ টি। ততক্ষণে ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছি। ঢাকা ফিরতে হবে। ১২টা থেকে ১২টা সময় থাকলেও আমরা সেখানে ফেরার দিন বিকাল পর্যন্ত কাটালাম ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে। ফেরার সময় ২৫০ টাকা নৌকাভাড়া দিয়ে চলে এলাম এসএসডি ঘাটে। ছোট নৌকার ভাড়া ৩০০, তবে পরিচিত নৌকা হওয়ার দরুন কিছুটা কম রেখেছে। সোনারঙা সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আমরা ঘাটে পৌঁছালাম। পেছনে পড়ে রইল সবুজে ঘেরা মায়াভরা গরবা গুদির ছোট্ট দ্বীপ। আবার আসব এখানে—এ প্রত্যাশা নিয়েই ফিরলাম। ঘাট থেকে সিএনজি নিয়ে কাপ্তাই গিয়ে বাসের টিকিট সংগ্রহ করলাম। বাস ছাড়তে তখনো প্রায় ঘণ্টা তিনেক দেরি। তাই কাপ্তাই জেটি ঘাট এলাকায় ঘোরাফেরা করলাম, কিছু কেনাকাটা করলাম। বাস ছাড়ল প্রায় পৌনে ৯টায়। যথারীতি কুমিল্লায় যাত্রাবিরতি দিয়ে ঢাকা পৌঁছালাম ভোরের আগেই, ৪টার দিকে।

বলে রাখি, গরবা গুদিতে বাঁশের মাচাং ঘর, মাটির ঘর, তাঁবু—সব জায়গায়ই থাকার সুযোগ আছে। চাইলে দিনে গিয়ে দিনেও ফিরে আসতে পারেন। ক্যাম্পিং করতে চাইলে বিকাল থেকে সকাল পর্যন্ত খাওয়া-থাকাসহ ১ হাজার ৩০০ টাকা প্যাকেজ। দুপুরের খাবারসহ প্যাকেজ নিলে ১ হাজার ৫০০ টাকা। ক্যাম্পিংয়ে বাড়তি পাওয়া হলো বারবিকিউ আর বিভিন্ন ধরনের অ্যাক্টিভিটিস। আর যদি ক্যাম্পিং ছাড়া মাটির ঘর বা মাচাংয়ে থাকতে চান, সেক্ষেত্রে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত প্যাকেজ জনপ্রতি ১ হাজার ৩০০ টাকা। তবে মিনিমাম পাঁচজন হতে হবে। দু-তিনজন হলে প্যাকেজ মূল্য ১ হাজার ৫০০ টাকা। দুপুর থেকে সকাল প্যাকেজ জনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং কমপক্ষে পাঁচজনের গ্রুপ হতে হবে। দু-তিনজন হলে প্যাকেজমূল্য ১ হাজার ৮০০ টাকা। আন্তরিকতা আর আতিথেয়তার কোনো কমতি নেই সেখানে। একবার গেলে আবারও যেতে ইচ্ছা করবে।

যাতায়াত ব্যবস্থা

ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাপ্তাইয়ের বাস চলাচল করে। যেমন- পান্থপথ, কলাবাগান, আবদুল্লাহপুর ও আরামবাগ। ভাড়া নন-এসি ৭৫০-৮০০ টাকা।

কাপ্তাইয়ে আরো যা যা দেখতে পারেন

কাপ্তাই বাঁধ ও কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, নেভি ক্যাম্প, কর্ণফুলী কাগজ কল, চিৎমরম বৌদ্ধবিহার, বনশ্রী পর্যটন কমপ্লেক্স, প্যানারোমা জুম রেস্তোরাঁ, রিভারভিউ পার্ক প্রভৃতি।

শীতে পায়ের যত্নে করণীয় কী

শীতে পায়ের যত্নে করণীয়

অন্দর সাজুক আয়নায়

সন্তানের সার্বিক বিকাশে সাধারণ জ্ঞানের গুরুত্ব

ঢাকা টু জিরো পয়েন্ট: পথে যেতে দেখা…

দেখে এলাম চীন

শিশুর পড়ার ঘর

জুতা কেনার আগে...

হারিকেন-কুপি বাতি, হারিয়ে যাওয়া আলোর গল্প

দেখে এলাম চীন