হোম > মতামত

আজাদ রহমান : বাংলা উচ্চাঙ্গসংগীতের নবধারার স্রষ্টা

কামরুন্নেসা হাসান

উচ্চাঙ্গসংগীত—উপমহাদেশের সংগীত ঐতিহ্যের এক মহার্ঘ শাখা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা বা তরানা রীতি পরিবেশিত হয়ে এসেছে হিন্দি ও উর্দু ভাষায়। দিল্লি, লক্ষ্ণৌ, বেনারস বা পাটনার মঞ্চে রাতের পর রাত শ্রোতারা মুগ্ধ হয়েছেন ওস্তাদদের সুরলহরিতে। বাংলা ভাষা, যেন এই ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে শুধু শ্রোতার ভূমিকা নিয়েছিল। কেউ ভাবেননি—খেয়ালও একদিন বাংলায় গাওয়া সম্ভব।

কিন্তু ষাট দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় এসে এই ভাবনাকেই পাল্টে দিলেন এক তরুণ সংগীতশিল্পী, সুরকার ও চিন্তাশীল সংগীতজ্ঞ—আজাদ রহমান। তিনি ছিলেন এমন এক শিল্পী, যিনি শুধু সুর দিতেন না—সুরের ভেতরে নতুন ভাষা, নতুন চিন্তা, নতুন দিগন্ত নির্মাণ করতেন।

রেডিওর দিনগুলো যেন ছিল এক নবজাগরণের শুরু। তখনকার বাংলাদেশ রেডিও (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেডিও) ছিল দেশের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সেখানে একে একে যোগ দিচ্ছেন সময়ের শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞরা—আব্দুল আহাদ, সমর দাস ও ধীর আলী মিয়া। সাহিত্য শাখায় কর্মরত ছিলেন কবি ফররুখ আহমেদ ও গীতিকার আজিজুর রহমান। এই ঐতিহ্যমণ্ডিত পরিবেশেই তরুণ আজাদ রহমান রেডিওর সংগীত বিভাগে যোগ দিলেন।

রেডিওর স্টুডিও তখন যেন ছিল সুরের পরীক্ষাগার। প্রতিদিন নতুন গানের রেকর্ডিং, নতুন শিল্পীদের আবিষ্কার এবং সুরের ওপর অনবরত গবেষণা চলত। এই পরিবেশে আজাদ রহমান খুব দ্রুত নিজের স্বাক্ষর রেখে দিলেন। তার সুরে ছিল এক অদ্ভুত ব্যঞ্জনা—শাস্ত্রীয়তার মাধুর্য আর আধুনিকতার কোমল সংবেদনশীলতা।

মনে পড়ে, তার সুরে শিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ গেয়েছিলেন আবু হায়দার সাজেদুর রহমানের লেখা—‘আমায় কেন মুক্ত হতে বলো’, যা আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে অনুরণিত হয়। আবার আলীমুজ্জামান চৌধুরীর লেখা ‘আর নেমো না অথৈ জলে সই’ বা জেবুন্নেসা জামালের লেখা ‘কে যেন সোনার কাঠি ছোঁয়ায় প্রাণে’—এসব গান যেন নতুন ভাষা এনে দিল বাংলা সুরে।

ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে ‘প্রিয়তম তুমি আমার’, রেবেকা সুলতানার কণ্ঠে ‘পথের আমি কুড়িয়ে পেলাম বাঁশি’ কিংবা মোহাম্মদ খুরশিদ আলমের কণ্ঠে ‘তোমার দুহাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম’—প্রতিটি গান যেন সুরের পরিমিত শিল্পে ভরপুর। এসব গান প্রমাণ করে—আজাদ রহমান বাংলা গানের ভুবনে শুধু সুরকার নন, ছিলেন এক নতুন ধারার সূচনাকারী।

বাংলা উচ্চাঙ্গসংগীতের উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি। খেয়াল বা ঠুমরি সাধারণত হিন্দি বা উর্দু ভাষাতেই পরিবেশিত হতো। কিন্তু আজাদ রহমান সেই দীর্ঘ ঐতিহ্যে এক যুগান্তকারী সংযোজন আনলেন—বাংলা ভাষায় উচ্চাঙ্গসংগীত। এটি ছিল এক বিপ্লব।

একদিন তিনি হাতে কয়েকটি সিডি নিয়ে আমার কক্ষে এলেন। হাসতে হাসতে বললেন—

‘মেনকা, আমি বাংলা ভাষায় উচ্চাঙ্গসংগীত রেকর্ড করেছি। এখন থেকে আমি এটাকেই জীবন দিয়ে লালন করতে চাই।’

তার চোখে তখন দীপ্ত আগুন। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম সেই মুহূর্তেই।

পরে তার পরিকল্পনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হয় ‘বাংলা উচ্চাঙ্গসংগীত’ অনুষ্ঠান। এটি ছিল সংগীত ইতিহাসের এক যুগান্তকারী মুহূর্ত—যেখানে খেয়ালের অলঙ্কার, তাল ও রাগের বুননে বাংলা ভাষা তার নিজস্ব সুরভি ছড়িয়ে দিল।

চলচ্চিত্রে সুরের জাদু ছিল তার। শুধু রেডিও বা টেলিভিশন নয়, চলচ্চিত্রেও আজাদ রহমান ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

তার সংগীত পরিচালনায় তৈরি গানগুলো আজও শ্রোতাদের মুখে মুখে।

মনে পড়ে—বাবুল চৌধুরী পরিচালিত ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রের সেই অমর গান—

‘বন্দি পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’—গেয়েছিলেন মোহাম্মদ খুরশিদ আলম।

অথবা অশোক ঘোষের ‘মাস্তান’ ছবির সেই হৃদয়গ্রাহী গান—

‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি কেন একা একা বয়ে বেড়াও’—মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে।

মহসিন পরিচালিত ‘আগুন’-এর রুনা লায়লার গাওয়া গান—

‘মাগো, তোর কান্না আমি সইতে পারি না’—ছিল এক মর্মস্পর্শী মাতৃভক্তির আর্তি।

‘রাতের পর দিন’, ‘জাদুর বাঁশি’, ‘মাসুদ রানা’—সব চলচ্চিত্রেই তার সুরে ছিল এক আলাদা মাত্রা। ‘আকাশ বিনা চাঁদ হাসতে পারে না’ বা ‘মনের রঙে রাঙাবো’—সেলিনা আজাদের কণ্ঠে এসব গান আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে অমর।

তার নিজের কণ্ঠেও কিছু গান কালজয়ী হয়ে আছে—

‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়’ বা ‘ভালোবাসার মূল্য কত আমি জানি না’—এই গানগুলো তার সুরকার ও গায়ক দুই সত্তাকেই অমর করে রেখেছে।

দেশাত্মবোধক সৃষ্টিতে ঐতিহাসিক অবদান ছিল তার। আজাদ রহমান শুধু প্রেম বা আধুনিক গানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি সৃষ্টি করলেন এক অনবদ্য দেশাত্মবোধক গান—নঈম গহরের কথায়—‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো, আমায় তুমি ডাকো’।

গানটির একটি বিশেষ ইতিহাস আছে।

এটি প্রথম সমবেত কণ্ঠে রেকর্ড করা হয় পাকিস্তানের লাহোরে, একটি স্টুডিওতে।

সেই সমবেত কণ্ঠে ছিলেন কিংবদন্তি ফিরোজা বেগম, কোকিলকণ্ঠী সাবিনা ইয়াসমিনসহ আরো অনেকে। পরে সাবিনা ইয়াসমিন এককভাবেও গানটি রেকর্ড করেন। কিন্তু সেই সমবেত কণ্ঠের সংগীতায়োজন—যন্ত্রানুষঙ্গ, কণ্ঠের ওঠানামা—ছিল এক অনন্য শিল্পধর্মী পরিবেশনা।

একদিন আমি আজাদ ভাইকে ফোনে বলেছিলাম,

‘আপনি যদি গানের ডিস্কটা দেন, আমি চিত্রায়ণ করে টেলিভিশনে প্রচার করতে চাই।’

তিনি হেসে বললেন—

‘দিতে পারি, তবে কাজ শেষে ফেরত দিতে হবে।’

তার এলিফ্যান্ট রোডের ‘মুভিটোন’ স্টুডিও থেকে আমি নিজে গিয়ে ডিস্কটি নিয়ে আসি। গানের সঙ্গে প্রাকৃতিক দৃশ্য চিত্রায়ণ করে যখন সেই ভিডিও বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হলো, তিনি আপ্লুত হয়েছিলেন আনন্দে।

পরে রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণের পর গানটি নিয়মিত বাজানো হতো।

আজাদ রহমান আজ নেই, কিন্তু তার সুর বেঁচে আছে আমাদের প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে।

তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় একেকটি নতুন পথের সূচনা করেছে—

বাংলা উচ্চাঙ্গসংগীতে তিনি পথিকৃৎ, চলচ্চিত্রে তিনি অমর,

আর গানে গানে তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির আবেগের পরম আশ্রয়।

সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বহুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন, পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমির স্বীকৃতি। কিন্তু আসল পুরস্কার ছিল মানুষের ভালোবাসা, যা আজও তাকে ঘিরে রেখেছে।

আজাদ রহমান প্রমাণ করেছিলেন—

সংগীত শুধু সুর নয়,

সংগীত এক জীবনদর্শন।

তিনি যেন বাংলার সুরে রাগদরবার খুলে দিয়ে বলেছিলেন—

বাংলাও পারে উচ্চাঙ্গ হতে।

আজাদ রহমান আমাদের সংগীত-ঐতিহ্যের এক জীবন্ত অধ্যায়।

তার সৃষ্ট সুর আমাদের হৃদয়ে আজও বাজে—খেয়ালের তানে, রাগের অনুরণনে, ভালোবাসার মৃদু স্পন্দনে।

বাংলা উচ্চাঙ্গসংগীত তার হাত ধরে এক নতুন ভাষা পেয়েছিল।

তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি—

বাংলা সুরের রাজপথে যে আলো তিনি জ্বালিয়েছিলেন, তা যুগে যুগে আমাদের পথ দেখাবে।

লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন

অজানা চাপ, দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার রাজনীতি

রক্তের ঋণ বনাম ক্ষমতার উৎসব

নির্বাচন আয়োজনে সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে শঙ্কা

সেক্যুলারিজম না মাল্টিকালচারালিজম

জুলাই বিপ্লব, ডাকসু এবং ভারতের খুশি–অখুশি

তালেবানকে স্বাগত জানাচ্ছে ভারত

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণরায় চাই

ভেনেজুয়েলায় মার্কিন হামলা কি আসন্ন?

অগ্নিকাণ্ড : নিরাপত্তাহীন নগরজীবন

জুলাই সনদ নিয়ে বিপরীতধর্মী অবস্থান