বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক অদ্ভুত অস্বস্তির ভেতর দিয়ে হাঁটছে। ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে বিরোধী শক্তি—সবাই যেন এক অজানা চাপ, দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার আবর্তে বন্দি। জুলাই সনদ নিয়ে সরকারের অস্বস্তি যেমন স্পষ্ট, তেমনি একটি গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতিতেও রয়েছে দৃশ্যমান চাপ। কারণ, একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন এখন শুধু রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়, তা সরকারের নৈতিক বৈধতার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।
তবে অস্বস্তির ভার শুধু সরকারের কাঁধে নয়। ফ্যাসিস্টবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের অবস্থান ও কৌশল নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগছে। কে কার সঙ্গে নির্বাচনি জোটে যাবে, কার সঙ্গে যাবে না—এই হিসাব-নিকাশে যেন কেউই নিশ্চিত হতে পারছে না। রাজনীতির মঞ্চে চলছে পুনর্বিন্যাসের এক নীরব প্রক্রিয়া; কিন্তু তার দিকনির্দেশ এখনো অস্পষ্ট। ফলে সৃষ্টি হয়েছে দ্বিধা, অবিশ্বাস এবং এক ধরনের রাজনৈতিক স্থবিরতা। কোনো ক্ষেত্রে সংহিংসতা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিহিংসামূলক হুংকার দেখছি। অমুক দলকে ভোট দেওয়া যাবে না, দিলে খবর আছে বলে ভোটারদের ভয় দেখানো শুরু হয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই আমরা দেখছি বিএনপি নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েছে। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে। এতে সাধারণ মানুষের আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের রাজনীতি এক অদ্ভুত মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দিন দিন আরো জটিল হয়ে উঠছে। নির্বাচন কমিশনের সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এখন নতুন করে নেড়ে দিয়েছে রাজনৈতিক মাঠ। সংশোধিত নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে জোটের প্রার্থীরা আর প্রধান দলের প্রতীকে ভোট করতে পারবেন না—প্রত্যেককে লড়তে হবে নিজ নিজ দলের প্রতীকে।
এই ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বড় রাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে চলেছে। কারণ, বাংলাদেশের নির্বাচনি রাজনীতিতে প্রতীক মানেই পরিচিতি, পরিচিতি মানেই ভোট। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে জোট রাজনীতির নেতৃত্বে থেকেছে—তার প্রতীকের জনপ্রিয়তা ব্যবহার করেই সহযোগী দলগুলো অনেক সময় ভোটে টিকে থেকেছে। এখন সেই সুযোগ চলে যাওয়ায় জোট রাজনীতির মূল কাঠামোই প্রশ্নের মুখে।
বিএনপি নেতারা ইতোমধ্যে প্রকাশ্যে বলছেন, নতুন নিয়ম ছোট দলগুলোর জয়ের সম্ভাবনাকে প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের ভাষায়, ‘জোট প্রার্থীদের মাঠের অবস্থান আগেই দুর্বল ছিল। এখন নিজ প্রতীকে লড়াই করতে হলে তাদের পক্ষে বিজয় পাওয়া প্রায় অসম্ভব।’ বিএনপি তাই কমিশনের কাছে এই সংশোধনী বদলাতে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তার অবস্থান থেকে সরে আসবে কি না—সেটি এখনো অনিশ্চিত।
এই পরিবর্তন শুধু জোট রাজনীতির কৌশল নয়, বিশ্বাসের সম্পর্ককেও নাড়া দিয়েছে। ছোট দলগুলো মনে করছে, বিএনপির সঙ্গে থেকে তারা এখন আরো দুর্বল অবস্থানে পড়েছে। জোটের ভেতর দূরত্ব ও সন্দেহ বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপির রাজনৈতিক সমীকরণ আরো জটিল হয়ে উঠছে—বিশেষত যখন আসন ভাগাভাগির আলোচনা শুধু শুরু হয়েছে।
এর মধ্যেই আরেক দিক থেকে রাজনীতিতে এসেছে নতুন এবং বড় বিতর্ক—জুলাই সনদ।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে তৈরি এই সনদকে কেউ দেখছেন ভবিষ্যতের সংস্কারের নীলনকশা হিসেবে, কেউবা বলছেন এটি অচল ও অবাস্তব প্রস্তাব।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আবার সনদের বাস্তবায়নের পক্ষে জোর দিয়েছে। কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাতে তারা জানিয়েছে, আইনি ভিত্তি নিশ্চিত না হওয়ায় আপাতত সনদে স্বাক্ষর দিচ্ছে না, তবে বাস্তবায়নের পক্ষে তারা দৃঢ় অবস্থানে আছে।
একই সঙ্গে এনসিপি একটি নতুন প্রস্তাবও দিয়েছে—সংবিধান সংস্কার শেষে সেটির নাম হবে ‘বাংলাদেশ সংবিধান, ২০২৬’ এবং সাংবিধানিক পদে থাকা সবাইকে নতুন সংবিধানের অধীনে শপথ নিতে হবে। এই প্রস্তাবটি রাজনৈতিক মহলে নতুন করে আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের মতে, ‘জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী দলগুলো এখন দুই ভাগে বিভক্ত—একদল সনদ থেকে নিজেদের নাম মুছে ফেলতে চায়, আরেক দল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে ভেস্তে দিতে চায়।’ তাদের অভিযোগ, বিএনপিসহ কয়েকটি দল সনদে আইনি ভিত্তি দিতে বাধা দিচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি মনে করে, সনদটির আইনি কাঠামোই দুর্বল—এটি রাজনৈতিকভাবে প্রণোদিত এক চুক্তি মাত্র।
ফলে প্রশ্ন উঠছে—জুলাই সনদ কি সমাধানের পথ খুলছে, নাকি রাজনৈতিক জটিলতাকে আরো গভীর করছে? এমন প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে অজানা ও আলোচিত প্রশ্ন—৪০ শতাংশ তরুণ ভোটার কোনদিকে যাবে?
যারা জীবনে একবারও ভোট দেননি, সেই তরুণ প্রজন্ম এখন রাজনীতির বড় ভরসা, আবার সবচেয়ে বড় অজানা সমীকরণও। তাদের মনোভাব, আকাঙ্ক্ষা ও সিদ্ধান্ত—সবই এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু।
তরুণরা চায় কর্মসংস্থান, শিক্ষায় সুযোগ, মুক্ত মতপ্রকাশের পরিবেশ, প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ এবং নিরাপদ নাগরিক জীবন। অথচ রাজনীতি আজও পুরোনো প্রতিশোধ, সংঘাত ও ক্ষমতার লড়াইয়ে আটকে আছে। এই ব্যবধানই তরুণ প্রজন্মকে পুরোনো রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তবে তারা রাজনীতিবিমুখ নয়। তারা জানে কী করতে হবে। ডাকসু-জাকসু-চাকসু-রাকসু উদাহরণ নয়, প্রমাণ।
রাজনীতির এই অনিশ্চয়তার সময়টা সাধারণ মানুষের মধ্যেও তৈরি করেছে এক ধরনের আতঙ্ক। নিত্যদিনের জীবনে এখন ভয় ও অনিশ্চয়তা নিত্যসঙ্গী। বাজারে দ্রব্যমূল্যের চাপ, চাকরির অনিশ্চয়তা, অপরাধ ও চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য—সব মিলিয়ে মানুষ ক্লান্ত। রাজনৈতিক সহিংসতার খবর তাদের আরো ভীত করে তোলে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে প্রভাব খাটানো, দখলদারিত্ব ও ভয় দেখানোর সংস্কৃতি। মানুষ জানে না, কোন দল আসবে; কিন্তু চায় শুধু একটা নিরাপদ ও স্বস্তির জীবন।
এমন অবস্থায় সরকার যেমন দায়িত্বের চাপে, রাজনৈতিক দলগুলোও প্রশ্নের মুখে। জনগণের আস্থা অর্জনের লড়াইয়ে কারো অবস্থানই এখন সুদৃঢ় নয়। কারণ, মানুষ এখন কথায় নয়—চায় কাজে বিশ্বাসের প্রমাণ।
অর্থনীতির মলিন বাস্তবতাও এই অস্বস্তিকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। বিনিয়োগে স্থবিরতা, টাকার মান হ্রাস, প্রবাসে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা—সবকিছু মিলে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি কাঁপছে। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতেও।
আরেকটি বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতেই হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করা যাবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ এক নতুন প্রজন্ম উঠে এসেছে, যারা কোনো অন্ধ আনুগত্যে বিশ্বাস করে না। তারা ভারতের প্রতি বন্ধুত্ব চায়, কিন্তু নতি স্বীকার নয়। তারা চায় পারস্পরিক সম্মান ও সমতাভিত্তিক সম্পর্ক। তাই ‘ভারতপ্রীতি’ যদি রাষ্ট্রনীতি নয়, বরং ভোটের কৌশল হয়ে দাঁড়ায়—তাহলে জনগণের আস্থা সেখানেই হারিয়ে যাবে।
একইভাবে, কোনো দল যদি অন্ধভাবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টিকে পুনর্বাসন করতে চায়, জনগণের চোখে সে দল দ্রুতই প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। সময়ের বাস্তবতা এখন ভিন্ন। মানুষ চায় নতুন রাজনৈতিক ভাষা, যেখানে থাকবে জাতীয় স্বার্থের স্বর, জনগণের কথা আর দেশের মর্যাদার প্রতি অঙ্গীকার।
আজকের তরুণ ভোটাররা রাজনীতি বিচার করে আবেগে নয়, বাস্তবতায়। তারা এমন রাজনীতি চায়, যেখানে নিজের স্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থ আগে আসে। তাই যেসব দল এখনো পরনির্ভরতা, ভারতের তুষ্টি কিংবা ফ্যাসিস্ট ও তার দোসরদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে বা করবে—তাদের প্রতি জন-আস্থা কমছে এবং কমবেই। এ সময়ের স্পষ্ট বার্তা হলো—ভারতপ্রীতি নয়, বাংলাদেশপ্রীতি; দলপ্রীতি নয়, দেশপ্রীতি। যে দল এটি বুঝবে না, সে দল টিকবে না।
৫ আগস্টের আগের বাংলাদেশ আর পরের বাংলাদেশ এক নয়। বদলে গেছে। পাটাতনই উল্টে গেছে। ভয়ের রাজনীতি আর চলবে না। গণঅভ্যুত্থানের পর তরুণরা ভয় পেতে ভুলে গেছে। তারা নির্ভয়ে প্রশ্ন করতে জানে। প্রশ্নের জবাব মনঃপূত না হলে ‘মানি না’ বলে প্রত্যাখ্যান করবে।
তবে এই অস্বস্তির সময়কে শুধু নেতিবাচক হিসেবে দেখলে ভুল হবে। ইতিহাস বলে, প্রতিটি অস্থির সময় নতুন সম্ভাবনারও সূচনা করে। তরুণ প্রজন্মই সেই সম্ভাবনার কেন্দ্র। যদি তারা রাজনীতিতে আস্থা ফিরে পায়, যদি তারা বিশ্বাস করে যে পরিবর্তন সম্ভব—তাহলে এই অস্বস্তি থেকেই হয়তো জন্ম নিতে পারে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু তার জন্য দরকার বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন—যেখানে ভোট হবে উৎসব, ভয়ের নয়। যেখানে তরুণ ভোটাররা মনে করবে, তাদের একটিমাত্র ভোট দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।
সরকারের উচিত সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা—সহিংসতামুক্ত, প্রতিহিংসামুক্ত এবং আস্থাপূর্ণ রাজনৈতিক মাঠ গড়ে তোলা। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোরও প্রয়োজন নিজেদের ভাষা ও ভঙ্গি পাল্টানো। তরুণদের আকৃষ্ট করতে হলে তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের বাস্তবতা ও স্বপ্নকে গুরুত্ব দিতে হবে—অতীতের তিক্ততা নয়। প্রফেসর ইউনূসের সরকার সবার সরকার। এ সরকার ব্যর্থ হলে ব্যর্থ হবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে প্রধানত দায়ী হবে তারাই।
বাংলাদেশ অতীতে বহু সংকট পেরিয়েছে। প্রতিবারই মানুষ আশার আলো খুঁজে নিয়েছে। আজও তারা আশা হারায়নি—তারা শুধু অপেক্ষায় আছে, রাজনীতি কখন আবার মানুষের হয়ে কথা বলবে।
এই অস্বস্তির সময় তাই এক অর্থে আত্মসমালোচনার সময়ও। রাজনীতিকে আবার মানুষের দিকে ফিরতে হবে—সংঘাত নয়, সংলাপের পথে। বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে, রাজনীতির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও তরুণদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে।
কারণ, মানুষ রাজনীতি চায় না ক্ষমতার জন্য—চায় স্বস্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তার জন্য। রাজনীতি যদি তা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে অস্বস্তির এ সময় আরো দীর্ঘ হবে। এখন দেখার বিষয় রাজনৈতিক দলগুলো কী করে।
লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন