হোম > ফিচার > নারী

মাহিনূরের ‘শৈল্পিক’ যাত্রা

ইভা আক্তার

সব মেয়েই কি শুধু কাগজে ফুল আঁকে? না, কিছু মেয়ে জন্মায় তুলি হাতে নিয়ে। জন্ম থেকেই তারা জানে, জীবন এক বিশাল ক্যানভাস। প্রতিটি দিন একেকটা তুলির আঁচড়ে জীবনের প্রতিচ্ছবি। তারা ক্যানভাসে আঁকে জীবনের মানচিত্র। প্রতিটি দিন তাদের কাছে একেকটি তুলির টান, অনুভবে ভেজা রঙ। যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে শিল্প থেমে যায় না।

মাহিনূর ইসলাম। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তবে তার পরিচয় এখানেই থেমে থাকেনি, তার আরেক নাম ‘শৈল্পিক’। একটি শিল্পভ্রমণ, রঙ আর তুলির কাব্য।

এক বিকেল। ভৈরবের ছাদে উড়ছিল কিছু রঙিন পাতা। হাওয়া গায়ে মেখে সেসব পাতায় আঁকা ছিল ছোট ছোট স্বপ্ন। মাহিনূরের তুলির ছোঁয়ায় সেই পাতাগুলো রঙ পেয়েছিল, ভাষা পেয়েছিল। শব্দের চেয়েও গভীর, অনুভবের মতো সত্য সে ভাষা।

স্কুল শেষে অন্য বাবারা যখন ফিরতেন বিস্কুট আর পানীয় হাতে, মাহিনূরের বাবা হাতভর্তি করে চারুকলার ফর্ম আর প্রতিযোগিতার পোস্টার নিয়ে ফিরতেন । সেই কাগজগুলো ছিল না শুধু সুযোগ। সেগুলো ছিল এক শিল্পীর জন্মঘণ্টা। তিনি বলতেন, ‘গড়িয়ে চলা পাথরে শ্যাওলা জমে না, মা। কিছু হলেও করো, যত অল্পই হোক।’ এই কথাগুলোই হয়ে উঠেছিল মাহিনূরের শক্তি, আত্মার রঙিন মূলসূত্র।

ভৈরব শিল্পকলা একাডেমিতে প্রথম আঁচড় বসানোর দিনই বুঝেছিলেন, তার জীবন ক্যানভাসেই গড়া। একদিন এক কলেজশিক্ষক বলেছিলেন, ‘তুমি ছোটদের শেখাও না কেন?’ সেদিনই তিনি বুঝেছিলেন, শিল্প কেবল নিজের জন্য নয়, তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, অন্যের স্বপ্নেও রঙ ছোঁয়াতে।

বন্ধুরা জামা, ব্যাগ ও শাড়ি এনে বলতেন, ‘এই শাড়িটা নীলে ভাসিয়ে দে না, মাহিনূর!’ ছেলেরা বলতেন, ‘এই পাঞ্জাবির গলায় একটু কাজ করে দিবি?’ তুলির টানে মাহিনূরের অনুভব ভেসে উঠত কাপড়ে। শুধু শিল্প নয়, স্মৃতি হয়ে থাকত কারো জীবনের একটা প্রিয় উপহার হয়ে।

একদিন নিজের মনেই প্রশ্ন করলেন—‘শুধু নিজের জন্য আঁকি কেন? শিল্প তো আলো, ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটা কণায়।’

সেই ভাবনার বীজ থেকেই জন্ম নেয় ‘শখের ক্যানভাস’—একটা ছোট্ট অনলাইন পেজ। বন্ধুদের সঙ্গে শুরু সেই যাত্রার। নতুন উদ্যোক্তা হয়েও ভালো সাড়া পেয়েছিলেন। কারণ শিল্পের ভাষা, ভাষার চেয়েও নিঃশব্দে ছুঁয়ে দেয় সমঝদার মানুষের মন।

আর এই যাত্রার সবচেয়ে বড় সংগ্রাহক তার মা। অনেকবার এমন হয়েছে—মাহিনূর কিছু বানিয়েছেন, আর তার মা সেটার তিন-চার গুণ দাম দিয়ে কিনে নিয়েছেন। ‘আমার মেয়ের বানানো জিনিস কাউকে দিতে ইচ্ছা করে না। চোখের সামনে রাখতে চাই সবটুকু,’ হেসে বলতেন মা। টাকার অঙ্ক নয়, যেন মেয়ের স্বপ্নের মূল্যায়ন করতেন ভালোবাসায়। মাহিনূর বলত, ‘মা আমার ক্রেতা নন, আমার সংগ্রাহক। ভালোবাসার দাম কখনো টাকায় মাপা যায় না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসে নিজের আঁকা জামা পরে যান মাহিনূর। একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘জামাটা কোথা থেকে নিয়েছ?’ তিনি হেসে উত্তর দেন, ‘আমি বানিয়েছি।’ সেই মুহূর্তে তিনি নিজেকে বলেন, ‘আমি কি শুধু জামা বানাই? না, আমি অনুভব পরিয়ে দিই।’

একদিন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক মোখলেসুর রহমান স্যারের উৎসাহে তিনি প্রথমবার নিজের পণ্য নিয়ে স্টল দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে। অচেনা মুখ, অপরিচিত পরিবেশ—তবে তার রঙ মানুষ ঠিকই চিনে নেন । একজন অলংকার হাতে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা অন্যরকম।’ সেই চোখের চমক হয়তো তার জীবনের প্রথম বড় স্বীকৃতি।

‘শখের ক্যানভাস’ নামটা তখন বদলে যায়। হয়ে ওঠে ‘শৈল্পিক’। নাম পাল্টায়, শিল্পের গভীরতা আরো বাড়ে।

এ যাত্রার অন্যতম বড় প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তানিয়া আহমেদ। তিনি শুধু প্রশংসা করেননি, অর্ডারও দিয়েছিলেন হ্যান্ডপেইন্টেড পণ্য। সেই অর্ডার ছিল না কেবল ব্যবসা, ছিল এক ধরনের বিশ্বাস। এক শিক্ষিকার আস্থা, আর এদিকে এক শিল্পীর আত্মবিশ্বাস।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা প্রোগ্রামে মাহিনূর বারবার কম দামে বিক্রি করেছেন নিজের আঁকা জামা, ব্যাগ, শাড়ি ও গয়না। কারণ তার বিশ্বাস, ‘শিল্পের দামে ভালোবাসা কমানো যায় না, ছুঁতে দেওয়া যায়।’

রাতভর চলে রঙের সঙ্গে তার আলাপ। চা বানাতে গিয়ে ফিরতে ভুলে যান, হাতে উঠে আসে তুলির জল। এসব কাণ্ডে হেসে ফেলতেন তিনি নিজেই। ‘রঙই তো এখন আমার চা, আর ক্যানভাস আমার কাপ,’ বলতেন মনে মনে।

এ বছরের শুরুতে, এক শান্ত দুপুরে প্রিয় বান্ধবীর নতুন রেস্টুরেন্টের দেয়ালজুড়ে আঁকেন তিনি। সেই দেয়ালে শুধু দৃশ্য নয়, ছিল গল্প, সংগ্রাম আর শিল্পে গড়া জীবন্ত ক্যানভাস। দেয়ালজুড়ে লেখা থাকে একজন মেয়ের নিঃশব্দ শিল্পযাত্রা, যেখানে প্রতিটি স্বপ্ন রঙ হয়ে দ্যুতি ছড়ায়।

এখন আর তিনি শুধু আঁকেন না, তিনি বুনে চলেন পরিচয়, রঙে গড়ে তোলেন ভাষাহীন আত্মকথন। ‘শৈল্পিক’ শুধু তার ব্র্যান্ড নয়, একটি দর্শন, একটি কণ্ঠ—‘আমি সেই মেয়ে, যার কণ্ঠ তুলিতে। আমি সেই তুলি ধরি, যা রঙ দিয়ে জীবনের প্রতিচ্ছবি আঁকে। আমি শৈল্পিক।’

মেরুদণ্ড সমস্যা করণীয়

মোমের আলো ছড়ান জেবা

বিহারি নারীর ভাষান্তরের গল্প

পড়াশোনার পাশাপাশি সুছন্দার ফ্রিল্যান্সিংয়ে সাফল্য

দক্ষিণ বনশ্রীতে উদ্যোক্তাদের মিলনমেলা

ডলি খানমের কোয়েল পাখির পরিধি সারা দেশে

নওশিনের সাফল্যের গল্প

কার্টুন কণ্ঠে মুগ্ধতা আনেন জেরিন

সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন

অজ পাড়াগাঁয়ের ওয়াসিকার অনন্য সাফল্য