হোম > ফিচার > নারী

মেরুদণ্ড সমস্যা করণীয়

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

আজকের নারীরা যেমন ঘর-সংসার সামলাচ্ছেন, পাশাপাশি পেশাগত জীবনে সফলতার জন্য লড়ছেন প্রতিদিন। কর্মজীবী নারী হোন বা গৃহিণী—সবাই ব্যস্ত নিজের দায়িত্বের ঘূর্ণিতে। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনের মধ্যেই যে শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, মেরুদণ্ড বা স্পাইন নীরবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা অনেকেই বুঝতে পারেন না।

মেরুদণ্ড আমাদের শরীরের মূল ভরকেন্দ্র—এটি শুধু দাঁড়ানো বা হাঁটার শক্তিই দেয় না, বরং শরীরের ভারসাম্য, চলাচল ও স্নায়ুর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে পড়লে পুরো শরীরেই নানা অস্বস্তি দেখা দেয়, যা নারীদের জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করে।

নারীদের মধ্যে মেরুদণ্ড সমস্যার বৃদ্ধি

গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের তুলনায় নারীরা মেরুদণ্ডের ব্যথায় প্রায় দ্বিগুণ বেশি ভোগেন। এর পেছনে রয়েছে শারীরিক কাঠামোর পার্থক্য, হরমোনের প্রভাব, সন্তান ধারণ ও দৈনন্দিন কাজের ধরন।

বিশেষ করে গৃহিণীদের ক্ষেত্রে ভারী গৃহস্থালি কাজ, বারবার বালতি বা হাঁড়ি টানা, শিশুকে কোলে নেওয়া, দুধ খাওয়ানো প্রভৃতি কাজের সময় ভুল ভঙ্গি কোমরে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। আবার অফিসে কর্মরত নারীরা সারা দিন কম্পিউটারের সামনে বসে থাকেন, যেটি ঘাড় ও পিঠের হাড়ে ক্ষয় ডেকে আনে।

প্রধান কারণ

হরমোনের পরিবর্তন : গর্ভাবস্থা, সন্তান জন্ম, স্তন্যদান ও মেনোপজের সময় শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ওঠানামা হয়। এতে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায় এবং মেরুদণ্ড দুর্বল হয়।

ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি’র ঘাটতি : অনেক নারী খাবারে দুধ, মাছ, ডিম বা বাদাম অন্তর্ভুক্ত করেন না, আবার সূর্যালোকে পর্যাপ্ত সময়ও কাটান না। ফলে হাড় নরম ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

গর্ভাবস্থা ও সন্তান ধারণের পর শারীরিক পরিবর্তন : গর্ভকালীন ওজন বৃদ্ধি এবং শিশুকে কোলে নেওয়ার সময় ভারসাম্য নষ্ট হয়। এতে কোমরের নিচের অংশে চাপ সৃষ্টি হয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

দীর্ঘক্ষণ এক অবস্থানে থাকা : অফিসের কাজ, সেলাই, রান্না বা অনলাইন ক্লাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক ভঙ্গিতে থাকা মেরুদণ্ডে অস্বাভাবিক চাপ ফেলে।

স্থূলতা : অতিরিক্ত ওজন মেরুদণ্ডের জয়েন্টগুলোয় চাপ সৃষ্টি করে, ফলে হাড় ক্ষয় ও ডিস্ক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে।

সঠিকভাবে না বসা বা দাঁড়ানোর ভঙ্গি : মোবাইল বা ল্যাপটপের দিকে ঝুঁকে থাকা, বাঁকা হয়ে হাঁটা বা ঘাড় নিচু করে কাজ করা স্পাইনের প্রাকৃতিক বক্রতা নষ্ট করে দেয়।

মানসিক চাপ ও ঘুমের অভাব : ক্রমাগত স্ট্রেস ও অনিদ্রা পেশিকে শক্ত করে ফেলে, ব্যথা বাড়িয়ে দেয়।

উচ্চ হিল ও টাইট পোশাকের ব্যবহার : নিয়মিত হাই হিল পরলে ভারসাম্য নষ্ট হয়, কোমর ও হাঁটুর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে।

সাধারণ উপসর্গ

* পিঠ, কোমর বা ঘাড়ে টান বা ব্যথা

* হাতে বা পায়ে ঝিনঝিনি বা অবশভাব

* বেশি সময় দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে ব্যথা বাড়ে

* সকালে ঘুম থেকে উঠলে পিঠ শক্ত লাগে

* ভারী কিছু তুললে বা নিচু হয়ে কাজ করলে ব্যথা বেড়ে যায়

* মাঝে মাঝে মাথাব্যথা বা ঘাড়ে অস্বস্তি

মেরুদণ্ডের সাধারণ সমস্যার ধরন

সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস : ঘাড়ের হাড় ক্ষয়ে মাথা, কাঁধ ও হাতে ব্যথা ছড়ায়।

লম্বার স্পনডাইলোসিস : কোমরের হাড় ক্ষয়ে ব্যথা নিতম্ব বা পায়ে ছড়িয়ে যায়।

ডিস্ক প্রোলাপ্স বা স্লিপ ডিস্ক : হাড়ের মাঝের ডিস্ক সরে গিয়ে স্নায়ুতে চাপ দেয়, ফলে তীব্র ব্যথা হয়।

অস্টিওপোরোসিস : বয়স বা হরমোনের কারণে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

স্কোলিওসিস : কিশোরী বয়সে মেরুদণ্ড বেঁকে গেলে তা বড় হয়ে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

স্পাইন সুরক্ষায় করণীয়

সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখুন : কাজের সময় মেরুদণ্ড সোজা রাখুন। বসলে পিঠ চেয়ারের সঙ্গে লাগানো এবং দুই পা মাটিতে সমানভাবে রাখুন।

নিয়মিত ব্যায়াম করুন : হাঁটাহাঁটি, যোগব্যায়াম, স্ট্রেচিং বা হালকা ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট করুন।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন : সুষম খাদ্য ও নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপের মাধ্যমে শরীরের বাড়তি ওজন কমান।

পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন : দুধ, ডিম, ছোট মাছ, শাকসবজি, বাদাম ও তিল খাওয়ার অভ্যাস করুন। এগুলো হাড়কে মজবুত রাখে।

সূর্যের আলোতে সময় দিন : প্রতিদিন অন্তত ১৫-২০ মিনিট সূর্যালোকে থাকলে শরীরে প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি তৈরি হয়।

সঠিক বিছানা ও বালিশ ব্যবহার করুন : খুব নরম ম্যাট্রেস বা উঁচু বালিশ স্পাইনের স্বাভাবিক অবস্থান নষ্ট করে দেয়। মাঝারি শক্ত বিছানা সবচেয়ে ভালো।

উচ্চ হিল পরা সীমিত করুন : দৈনন্দিন ব্যবহারে আরামদায়ক ও নিচু জুতা ব্যবহার করুন।

দীর্ঘক্ষণ এক ভঙ্গিতে থাকবেন না : অফিসে প্রতি ৩০-৪৫ মিনিট পর উঠে কিছুক্ষণ হাঁটুন বা শরীর নড়াচড়া করুন।

বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার সময় ভঙ্গি ঠিক রাখুন : কোমর বাঁকিয়ে নয়, হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হয়ে শিশুকে তুলুন।

মানসিক শান্তি বজায় রাখুন : স্ট্রেস কমাতে ধ্যান, গান শোনা বা পছন্দের কাজে মন দিন। মানসিক প্রশান্তি শরীরের ব্যথাও কমায়।

গৃহিণী নারীদের জন্য বিশেষ পরামর্শ

রান্না বা কাপড় ধোয়ার সময় মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিন, টানা দাঁড়িয়ে কাজ করবেন না। ভারী বালতি বা হাঁড়ি তোলার সময় হঠাৎ নিচু না হয়ে হাঁটু ভাঁজ করে নিচু হোন। শিশুকে কোলে নেওয়ার সময় পিঠ সোজা রাখুন; কোলে নেওয়ার পর অতিরিক্ত সময় একপাশে ভর দেবেন না। মেঝেতে বসে দীর্ঘ সময় রান্না বা সেলাই করার বদলে আরামদায়ক উচ্চতায় টেবিল ব্যবহার করুন। ঘরের কাজের ফাঁকে কিছু সময় নিজের জন্য রাখুন—হালকা স্ট্রেচিং বা যোগব্যায়াম করুন।

কর্মজীবী নারীদের জন্য বিশেষ পরামর্শ

অফিসে বসার চেয়ার এমন নিন, যাতে পিঠের সাপোর্ট থাকে এবং দুই পা মাটিতে থাকে। ল্যাপটপ বা কম্পিউটার চোখের সমতলে রাখুন; ঘাড় নিচু করে স্ক্রিন দেখবেন না। প্রতি আধা ঘণ্টা পর উঠে একটু হাঁটুন বা শরীর নড়াচড়া করুন। ভারী ব্যাগ এক কাঁধে না ঝুলিয়ে দুই কাঁধে সমানভাবে রাখুন। অফিস থেকে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন, তারপরই ঘরের কাজ শুরু করুন।

দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করলে হাত উঁচু করে নয়, টেবিলে রেখে ব্যবহার করুন।

স্পাইনের যত্নে সচেতনতা জরুরি

নারীরা প্রায়ই নিজের ব্যথা বা অস্বস্তিকে অবহেলা করেন। ‘কাজের ক্লান্তি’ বা ‘বয়সের ফল’ ভেবে চিকিৎসা নেন না। কিন্তু এই সামান্য ব্যথা ভবিষ্যতে ডিস্ক প্রোলাপ্স বা স্নায়ুর ক্ষতি পর্যন্ত গড়াতে পারে।

পরিবারের সদস্যদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন—বিশেষত গৃহিণীদের ক্ষেত্রে। দীর্ঘ সময় রান্না বা কাপড় ধোয়ার পর সামান্য বিশ্রাম, কাজের মাঝে অবস্থান পরিবর্তন ও সঠিক বসার ভঙ্গি বজায় রাখা মেরুদণ্ডকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।

পরিশেষে, নারীদের মেরুদণ্ড শুধু শরীরের ভর নয়, এটি তাদের জীবনের ‘ভিত্তি’। এই স্পাইনই তাকে মা, কর্মী ও সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে শক্তি দেয়। তাই ব্যথা বাড়ার আগে সচেতন হোন, ভঙ্গি ঠিক করুন, শরীরের যত্ন নিন। সুস্থ মেরুদণ্ড মানেই সুস্থ নারী—আর সুস্থ নারী মানেই শক্তিশালী পরিবার ও সমাজ।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

মোমের আলো ছড়ান জেবা

বিহারি নারীর ভাষান্তরের গল্প

পড়াশোনার পাশাপাশি সুছন্দার ফ্রিল্যান্সিংয়ে সাফল্য

দক্ষিণ বনশ্রীতে উদ্যোক্তাদের মিলনমেলা

ডলি খানমের কোয়েল পাখির পরিধি সারা দেশে

নওশিনের সাফল্যের গল্প

কার্টুন কণ্ঠে মুগ্ধতা আনেন জেরিন

সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন

অজ পাড়াগাঁয়ের ওয়াসিকার অনন্য সাফল্য

শীর্ষ ৫০ নারী নেত্রীর তালিকায় শিফা