লেখক যেমন তার লেখার মাধ্যমে ঝড় তুলতে পারেন, তেমনি একজন শিল্পী তার রঙ-তুলিতে একটি ছবিকে জীবন্ত করে তুলতে পারেন। তাসমিয়া রশিদ মালা। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকাআঁকির প্রতি তার তীব্র নেশা। বর্তমানে পড়াশোনা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রথম বর্ষে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার বড়গাংদিয়া গ্রামে।
মালা ছোটবেলা থেকেই আঁকতে ভীষণ ভালোবাসেন। চোখের সামনে কোনো জিনিস ভালো লাগলেই সেটা রঙ দিয়ে হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় বন্দি করে রাখেন কাগজের মাঝে। মনের গভীরতা সবটুকু মিশিয়ে আঁকিবুঁকি করেন। এমনও হয়েছে, কেউ একটা গল্প বললে সেটাকে কল্পনা করে ছবি এঁকে ফেলেছেন।
মালা বলেন, ছবি আঁকা নিয়ে সব প্রতিযোগিতায় আমি অংশগ্রহণ করতাম এবং সবসময় প্রথম হতাম। শিক্ষক-শিক্ষিকা ও আমার সহপাঠীরা আঁকার অনেক প্রশংসা করতেন এবং আমাকে খুব অনুপ্রেরণা দিতেন। সেইসঙ্গে আমাকেও সবাই অনেক পছন্দ ও স্নেহ করতেন। আমার স্কুলে ক্লাসে শিক্ষক এসে আমাকে দায়িত্ব দিতেন সবাইকে ছবি আঁকা শেখাতে, আমিও মনের আনন্দে বিষয়টি উপভোগ করতাম । তবে বলা বাহুল্য, আমি নিজে কোনোদিন কারো কাছে ছবি আঁকা শিখিনি। যতটুকু যা পারি সম্পূর্ণ নিজ থেকে শেখা, ভালোলাগা থেকে করা।
মালা শুধু যে ছবি আঁকেন, তা কিন্তু নয়; তিনি এর পাশাপাশি আরো অনেক কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস, যেমন লেখালেখি করা, হ্যান্ড এমব্রয়ডারি, সুই-সুতোর কাজ, হস্তশিল্প, ফটোগ্রাফি ও ভিডিও এডিটিং নিয়ে কাজ করেন। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে একটি চিত্রনাট্য প্রদর্শন করেছেন, যা সম্মানীয় শিক্ষকমণ্ডলীসহ ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইবোন ও সহপাঠীদের দ্বারা বিপুল প্রশংসিত হয়েছে।
মালা বলেন, আমি ঠিক সেটাই করতে পছন্দ করি, যা আমার মনে ইতিবাচক হিসেবে সায় দেয়, আগ্রহ সৃষ্টি করে। আমি মনে করি, সফলতা ও ব্যর্থতা পরের হিসেব; প্রথমে আমাদের উচিত চেষ্টা করা। চেষ্টা করলে মানুষ কি না পারে? চেষ্টা আমার কাছে সবার আগে। বুকে সাহস নিয়ে আমি আমার গন্তব্যে এগিয়ে যাই। পরিশেষে ফলাফল আমার ধারণার চেয়েও সুন্দর হয়, যা আমাকে আরো বেশি সৃজনশীল হতে অনুপ্রেরণা দেয়। আমরা মানুষ, আমাদের মধ্যে হাজারো প্রতিভা লুকিয়ে আছে—কেউ আমরা এটাকে খুঁজে পাই এবং কাজে লাগাই, কেউ খুঁজে পেয়েও সাহসের অভাবে পিছিয়ে যাই, আবার কেউ খোঁজার চেষ্টাও করি না। সবকিছুর জন্য আত্মবিশ্বাস থাকাটা জরুরি।
মালার অনুপ্রেরণার জায়গা তার বাবা। তিনি বলেন, আমার সবচেয়ে ভরসার জায়গা আমার বাবা, যার কাছ থেকে আমি সাহস পাই। মাও আমার পাশে থেকে সাহায্য করেন। আমার হাতের কাজ দেখে তারা খুশি হন। আমার জীবনের সাফল্য দেখার জন্য তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আমার একটা বড় বোন আছে, নাম শিমু। তিনি এই আঁকিবুঁকির প্রতি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দেন।
আমি আঁকতাম নিজের ভালোলাগা থেকে। তারপর ফেসবুকে একটা পেজ তৈরি করি, যার নাম দিই ‘মালা’স আর্ট গ্যালারি’। আমার আঁকা পেইন্টিংগুলো প্রতিনিয়ত সবাই দেখতে থাকে। অনেকেই বিশ্বাস করত না যে, এভাবেও ছবি হাতে আঁকা যায়—অনেকে ছুঁয়ে দেখতে চাইত সত্যি কিনা! এগুলো থেকে আরো বেশি আগ্রহ বাড়ত, অনেক সময় এ কাজ আমার মন ভালো রাখতেও সাহায্য করে।
মালা আরো বলেন, জীবনের চলার পথের গতিবিধি সবসময় সমান থাকে না। ঢেউয়ের মতো উত্থান-পতনের সম্মুখীন হতে হয়, তারপর আবারও উঠে দাঁড়াতে শিখতে হয়। বাধা আসা মানে হেরে গিয়ে দমে যাওয়া নয়, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আবারও নতুনভাবে বাঁচতে শেখা। আমি চাই না কোনো ছোট কারণে আমার জীবনের গতি থেমে যাক। তাই সবসময় চেষ্টা করি এগুলো এড়িয়ে চলতে এবং খারাপ জিনিস থেকে দূরে থাকতে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, যত ঝুঁকিই আসুক না কেন তা কোনোদিন আমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে পারে না। আমার আত্মবিশ্বাস যথেষ্ট মজবুত।
আমি চাই, আমার নিজের একটা গল্প তৈরি হোক, পুরো দুনিয়া আমার পরিচয়ে আমাকে চিনুক। এ থেকেই ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে একজন উদ্যোক্তা হওয়ার এবং সেই পথেই এরই মধ্যে যাত্রা শুরু করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই নিজের গল্প তৈরি এবং স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে চলছি।
মালা শেষে বলেন, আমি এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চাই, যেখানে সৃজনশীল চিন্তাধারার মানুষদের একত্র করে কাজ করতে পারব। মানুষের সুপ্ত প্রতিভাগুলো খুঁজে বের করে এনে সবার সামনে প্রদর্শন করতে পারব। বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলতে পারব। আমি তাদের জীবনের সফলতার গল্প তৈরির যাত্রাপথের সারথি হতে চাই। সবার মুখে হাসি ফুটুক—এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। আমি আমার স্বপ্নের পথে বহুদূর এগিয়ে যেতে চাই।